ফিনটেক

ডিজিটাল মুদ্রার পথে হাঁটছে বিশ্ব

বিশ্বজুড়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা। আর্থিক লেনদেনে মানুষের চিন্তাধারাকে আমূল বদলে দিচ্ছে সময়োপযোগী এ উদ্ভাবন। নজর কেড়েছে বড় বিনিয়োগকারী ও করপোরেট জগতেরও। বর্তমানে বিটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপল, লাইটকয়েনসহ হাজারো ক্রিপ্টোকারেন্সি ভার্চুয়াল দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে। এতে জুয়া, হুন্ডি, চোরাচালান, সাইবার চাঁদাবাজিসহ অবৈধ লেনদেন উৎসাহিত হচ্ছে, যা চিন্তায় ফেলেছে বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের। তাই বিটকয়েনের মোকাবেলায় তাঁরা হাঁটছেন বৈধ ডিজিটাল মুদ্রার পথে। এসব মুদ্রার ব্যবহার এবং প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। চীনের ২৮ শহরে পরীক্ষামূলক ব্যবহার হচ্ছে এ মুদ্রা। গত বছর বাহামা দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল মুদ্রা ‘সেন্ড ডলার’ চালু করে।

ডিজিটাল মুদ্রা কী?
ডিজিটাল মুদ্রা হচ্ছে সেসব মুদ্রা, যা শুধু ভার্চুয়াল জগতে লেনদেন হয়। বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিনিময়ের সব তথ্য গোপন থাকে, বেশির ভাগ সময়েই থাকে অজ্ঞাত। এ ধরনের ডিজিটাল মুদ্রাকে বলা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি। ২০০৯ সালে বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে বিটকয়েনের সূচনা ঘটে। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির অনলাইন মূল্য থাকলেও কোনো সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিয়ন্ত্রণ করে না। এরই মধ্যে বেশ কিছু চুরির ঘটনাও ঘটেছে। যাতে কোটি কোটি ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি খোয়া গেছে।

আরও দেখুন:
ফিনটেক কী এবং কেন?
ফিনটেক এবং ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ
আগামীর ডিজিটাল ব্যাংকিং কেমন হবে
আধুনিক ব্যাংকিং ও ভবিষ্যৎ চাহিদা
ফিনটেক কি? ফিনটেক ও ব্যাংকিং এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ

অনলাইন লেনদেনে পার্থক্য
বর্তমান প্রচলিত মুদ্রার যে অনলাইন লেনদেন হয় তার সঙ্গে ডিজিটাল মুদ্রার একটি পার্থক্য রয়েছে। যেমন বর্তমানে আমেরিকায় অনলাইনে কেনাকাটা হলেও বিল করা হয় ডলারে, কিন্তু ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে ডলার নয় বরং মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে বিক্রেতার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডিজিটাল মুদ্রা। বর্তমানে ভেনমো, পেপল বা অ্যাপল পের মতো যেসব পেমেন্ট অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ অর্থ পরিশোধ করে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। মুদ্রার ইলেকট্রনিক রূপ এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ডলারের বাহ্যিক ব্যবহার মোট অর্থ সরবরাহের মাত্র এক-দশমাংশ। বাকি লেনদেন অনলাইনে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের মুদ্রা তৈরি ও তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে। যে ডিজিটাল মুদ্রাকে বলা হচ্ছে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি বা সিবিডিসি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সিবিডিসি কী?
সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা, যেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেবে এবং লেনদেন তারা তত্ত্বাবধান করবে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ৮০ শতাংশই এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, জাপান অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এবং এমআইটি যৌথভাবে সিবিডিসি নিয়ে গবেষণা করছে হ্যামিলটন প্রকল্পের মাধ্যমে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রা কিভাবে কাজ করবে এবং এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, তা নিরূপণ করা।

বিশ্বের ৬৫টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর জরিপ চালিয়ে ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্টস (বিআইএস) জানায়, ৮৫ শতাংশ ব্যাংকই সিবিডিসি নিয়ে কোনো না কোনোভাবে কাজ করছে। ১৫ শতাংশ এ নিয়ে গবেষণায় পাইলট প্রকল্পে যাচ্ছে। বিআইএস জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বোঝার চেষ্টা করছে সিবিডিসির মাধ্যমে জনগণ কতটা লাভবান হবে, এর ওপর জনগণের আস্থা, মূল্য স্থিতিশীলতা ও লেনদেনে নিরাপত্তা ইত্যাদি কতটা নিশ্চিত করা যাবে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ব্যাংক অব ইতালির ডেপুটি গভর্নর পিয়ারো সিপোলনে সিএনবিসিকে বলেন, ‘বিশ্ব ক্রমেই নগদ অর্থবিহীন লেনদেনে ধাবিত হচ্ছে। গ্রাহক-ব্যবসায়ী লেনদেন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এখন নগদ অর্থের ব্যবহার কমছে। ফলে সময়ের চাহিদা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সিবিডিসি নিয়ে কাজ করছে।’

ডিজিটাল মুদ্রার পথে বড় দেশগুলো
সিবিডিসি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। চীন গত বছর বড় শহরগুলোতে স্থানীয় মুদ্রা ইউয়ানের ডিজিটাল সংস্করণ ডিসিইপি (ডিজিটাল কারেন্সি ইলেকট্রনিক পেমেন্ট) চালু করেছে। পরীক্ষামুলক এ প্রকল্প ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। ডিজিটাল এ মুদ্রার নাম দেয়া হয়েছে ‘ই-সিএনওয়াই’। করোনায় নগদ লেনদেন কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনও নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা আনার পথে হাঁটছে। যার সম্ভাব্য নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রিটকয়েন’।

সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সিবিডিসি নিয়ে কাজ করতে একটি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আগামী চার বছরের মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা আনার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। এ নিয়ে কাজ করছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও। ভারতে এক গবেষণায় বলা হয়, সিবিডিসি দেশের জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ যোগ করবে। এমনকি যদি জিডিপিতে ১ শতাংশও যোগ হয় তা বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান জেরোমে পাওয়েল ডিজিটাল ডলার তৈরির বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টির সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করছে ফেড। আমরা মনে করি বিষয়টি আগে বোঝা আমাদের দায়িত্ব। এটি কিভাবে কাজ করবে এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন হবে ইত্যাদি।’

তিনি বলেন, ফেড একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করছে, এমনকি ডিজিটাল ডলার কেমন হবে তার ডিজাইনও তৈরি করছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা জনসমক্ষে প্রকাশ করার বিষয়টি তখনই হবে যখন এর প্রভাব পুরোপুরি বোঝা যাবে। তিনি আরো বলেন, ‘ডলার হচ্ছে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা, ডলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল মুদ্রা তৈরির ক্ষেত্রে আমরা প্রথম হতে চাই না। আমাদের ভেবেচিন্তেই এগোতে হবে।’

গত অক্টোবরে পাওয়েল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করছে। তবে সতর্ক করে বলেছিলেন, একটি ডিজিটাল মুদ্রার সুবিধা ও ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় লাগবে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, একটি ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবে।

কিভাবে কাজ করবে সিবিডিসি
সিবিডিসি নগদ অর্থের মতোই কাজ করবে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব বসটনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম চুনহা বলেন, ‘আমি যদি আপনাকে ১০০ ডলারের সিবিডিসি দিই, এটি তাত্ক্ষণিক আপনার অ্যাকাউন্টে যোগ হয়ে যাবে, এটি আপনার। আমি আর ফেরত নিতে পারব না। অন্যান্য ইলেকট্রনিক পেমেন্টের সঙ্গে এটি একটি প্রধান পার্থক্য। যেমন আমি যদি আপনাকে পেপলে অর্থ পাঠাই, এটি আসলে একটি প্রতিশ্রুতি, অর্থ আসছে। আপনার ব্যালান্সে দেখাচ্ছে, কিন্তু এ টাকা এখনো এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যায়নি। ফলে এসব লেনদেনে তৃতীয় পক্ষ টাকা আটকে দিতে পারবে। কিন্তু সিবিডিসি লেনদেন করা হলে টাকা তাত্ক্ষণিক চলে যাবে। প্রত্যাহার করার কোনো সুযোগ থাকবে না।

সিবিডিসির ক্ষেত্রে আরেকটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, এটি হবে আইনগতভাবে বৈধ মুদ্রা। ফলে আর্থিক বিনিময়ে সবাই গ্রহণ করতে বাধ্য।’ তিনি বলেন, ‘আপনি আপনার কর পরিশোধ থেকে শুরু করে কেনাকাটা সব ক্ষেত্রে এ মুদ্রা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন।’ বর্তমানে প্রচলিত ডিজিটাল মুদ্রা আইনগতভাবে বৈধ নয়। ফলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা এটি গ্রহণ করে না। সিডলের ফিনটেক এবং ব্লকচেইন গ্রুপের প্রধান লিলা টেসলার বলেন, ‘বর্তমান যে প্রবণতা তাতে বোঝা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণ করবে। তবে এ ব্যবস্থাটি কেমন হবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। প্রিন্ট মুদ্রারই ডিজিটাল ভার্সন হবে সিবিডিসি।’

যে সুবিধা পাওয়া যাবে
বৈধ ডিজিটাল মুদ্রায় কেনাকাটা, লেনদেন বা অর্থ পরিশোধ সবই হবে দ্রুত। আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তর বা রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যয় কমবে, নগদ অর্থ বহন করতে হবে না, অ্যাকাউন্টের বাইরে বা ব্যাংক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সুবিধা পাবে। সরকারি কর বা ভ্যাট সংগ্রহ সহজ হবে আবার দরিদ্রদের ভাতা বা বৃত্তি পাওয়া সহজ হবে। অর্থ প্রেরণের সহজ সুবিধা পেয়ে মানুষ অবৈধ মুদ্রায় লেনদেন করবে না।

বর্তমানে যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে সেগুলোর মূল্য দ্রুত পরিবর্তিত হয়। এতে ব্যবহারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বিপরীতে সিবিডিসি হবে অনেক বেশি স্থিতিশীল। আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলনে কমে যাবে কাগুজে মুদ্রার প্রিন্টিং। এতে সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব সাশ্রয় হবে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব বসটনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম চুনহা বলেন, ‘বর্তমান ডিজিটাল মুদ্রাগুলো প্রিন্ট মুদ্রায় রূপান্তর করা যায় না, কিন্তু সিবিডিসি যেকোনো মুহূর্তে প্রিন্ট মুদ্রায় রূপান্তর করা যাবে।’

আরও দেখুন:
আর্থিক প্রযুক্তি: স্টার্টআপদের ধারণা, প্রযুক্তি ও নতুন উদ্ভাবন
ডিজিটাল ব্যাংকিং: আর্থিক সেবায় প্রযুক্তি
দেশে ফিনটেক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার জরুরি
সবার কাছে উন্নত ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেবে ফিনটেক
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তি ফিনটেক এর হাতছানি

সোর্সঃ ফোর্বস ম্যাগাজিন, এএফপি, বিবিসি, ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকার ডটকম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button