ফিনটেকবিকল্প ব্যাংকিং

ফিনটেক কি? ফিনটেক ও ব্যাংকিং এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ

ব্যাংক ও ফিনান্সিয়াল কোম্পানির মধ্যে যোগসূত্র তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশের উদীয়মান আর্থিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গতিশীলতা আসবে। ব্যাংক খাতে সিকিউরিটিতে সামনের দিনগুলোতে ফিনটেক ছাড়া উপায় নেই। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে উন্নত দেশের পথে পা বাড়াতে পারে বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে আজ প্রযুক্তির ঢেউ আছড়ে পড়ছে সবখানে। সেখানে কেউ তাল মিলিয়ে টিকে যাচ্ছে নতুবা হারিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফিনটেক একটি নতুন শব্দ। অনেকের কাছে এটি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ফিনটেক কি?
আমাদের চারপাশ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আগামীর দিনগুলোতে আরো বেশকিছু পরিবর্তনের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো হতে পারে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন কিংবা প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন। এরকম একটি পরিবর্তন হচ্ছে ফিনটেক (Fintech)। ফিনটেক (Fintech) আসলে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন সাধন করে। বর্তমানে আলোচিত অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ফিনটেক (Fintech)।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ফিনটেক (Fintech) হচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি (Financial Technology) এর সংক্ষিপ্ত রূপ ফিনটেক (Fintech)। সনাতন ফিনান্সিয়াল সার্ভিসগুলোকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুবিধাজনকভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই হলো ফিনটেক। ফিনটেক নিঃসন্দেহে জীবনকে বদলে দেবে। ফিনটেক এখন বাস্তবতা ও যুগের দাবি।

Investopedia তে ফিনটেক এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
Financial technology (Fintech) is used to describe new tech that seeks to improve and automate the delivery and use of financial services. ​​​At its core, fintech is utilized to help companies, business owners and consumers better manage their financial operations, processes, and lives by utilizing specialized software and algorithms that are used on computers and, increasingly, smartphones. Fintech, the word, is a combination of “financial technology”.

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

Wikipedia তে ফিনটেক এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
Financial technology (abbreviated fintech or FinTech) is the technology and innovation that aims to compete with traditional financial methods in the delivery of financial services. It is an emerging industry that uses technology to improve activities in finance. The use of smartphones for mobile banking, investing, borrowing services, and cryptocurrency are examples of technologies aiming to make financial services more accessible to the general public. Financial technology companies consist of both startups and established financial institutions and technology companies trying to replace or enhance the usage of financial services provided by existing financial companies.

অর্থ প্রদান, বীমা, ঋণ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য আর্থিক সাবসিডিয়ারি পরিসেবা দিয়ে থাকে ফিনটেক। প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক পণ্য ও সেবার ডিজাইন ও সরবরাহের কাজও করে ফিনটেক। এর মাধ্যমে ব্যাংকে চেক ছাড়াই টাকা উত্তোলন ও কোনো কাগজপত্র ছাড়াই লেনদেন ও একাউন্ট খোলা যায়। এছাড়াও ফরেস্ক ও স্টক ট্রেডিং, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড অ্যাপস, এগুলো সবই ফিনটেক এর উদাহরণ। ফিনটেকের মূল ব্যবহারকারি হচ্ছে ব্যাংক, ইনসুরেন্সসহ অন্যান্য ফাইনানসিয়াল প্রতিষ্ঠান করে থাকে। ফিনটেক এর মাধ্যমে সহজেই কম খরচে গ্রাহকদের সেবা দেয়া যায়।

বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফিনটেকের দিকে কেন ঝুঁকছে?
যারা সাধারণ ব্যাংকিং করে না, তাদের কাছেও পণ্য ও সেবা পৌঁছানো যায়। প্রতিযোগিতার যুগে ফিনটেক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে রাখে। বিশ্বব্যাপি দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে ফিনটেক। বিশ্বের অনেক দেশে ফিনটেক ভিত্তিক কোম্পানি কাজ করছে। বিশ্বব্যাপী, আর্থিক সেবা খাতে বাধা দূর করে এর পথ সুগম করে কাজকে সহজ করে চলেছে। আমেরিকার ওয়ারবার্গ পিনকাস, ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট ও এম এন এ, চীনের অ্যান্ট ফিনান্সিয়াল, দুবাইয়ের ফিনটেক ইনোভেশন ইন্টারন্যাশনাল ডিএমসিসি বিশ্বের অন্যতম ফিনটেক কোম্পানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে অ্যাপের মাধ্যমে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কোথাও না গিয়ে ফিনটেক চালু করতে পারে।

কাগজপত্র পূরণের কোনো ব্যাপার নেই। গ্রাহকদের মৌলিক তথ্য যেমন ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য ও ব্যাংক একাউন্টের তথ্য দিলেই ফিনটেকের সাথে যুক্ত হওয়া যায়। কর্তৃপক্ষ তথ্যাদী ভেরিফাই করার পর সঠিক থাকলে তারপর একাউন্টটি চালু হয়। সিকিউরিটি টু সিকিউরিটি মেইনটেইন করা হয় বলে ফিনটেকে আর্থিক লেনদেন নিরাপদ ও ঝুঁকি কম থাকে। পাসওয়ার্ড সচেতনভাবে ব্যবহার করলে ফিনটেকে কোনো সমস্য হবে না।

বিশ্বজুড়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফিনটেক
২০১৮ সালে ব্যাপক বিনিয়োগের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০১৯ সালে ফিনটেক কম পরিসরে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। একই বছর মার্কিন আর্থিক জয়েন্ট ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট ও এমএনএ বিনিয়োগ কার্যক্রম বছরের প্রথমার্ধে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। মার্কিন-চীন উভয় দেশের বাণিজ্য উত্তেজনায় চীনের অনেক চু্ক্তি হ্রাস পায়। চীনের অর্থনীতে হোচঁট খাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ফিনটেক ও ফিনটেক কোম্পানিগুলোর দিকে নজর দিতে থাকে।

সিবি ইনসাইটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফিনটেকের চু্ক্তি ও অর্থায়নের জন্য একটি রেকর্ড বছর ছিল। প্রত্যেক বছরই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফিনটেকের চুক্তি ও অর্থায়ন বেড়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ১৯ শতাংশ ছিলে ২০১৮ সালে তা বেড়ে ১৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সাধারণভাবে, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ফাইনটেক স্টার্টআপগুলো বেশি তহবিল ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। ২০১৮ সালের সবচেয়ে বড় গ্রহীতা ছিল ভিয়েতনাম-ভিত্তিক ফাইনটেক মেজর মোমো। যা ওয়ারবার্গ পিনকাস থেকে সিরিজ সি তহবিল হিসেবে ১০০ মিলিয়ন নেয়।

চীনের টেক জায়ান্ট আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট ফিনান্সিয়াল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগ্রাসীভাবে নিজেদের প্রসারিত করতে চাইছে। অ্যান্ট ফিনান্সিয়াল বিভিন্ন সহায়ক সংস্থার মাধ্যমে অর্থ প্রদান, বীমা, ঋণ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য আর্থিক সাবসিডিয়ারি পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছে। অ্যান্ট ফিনান্সিয়াল একাই ১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে যা ২০১৮ সালের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৩৫ শতাংশ বলে জানায় সিবি ইনসাইট।

সিবি ইনসাইটস জানায়, মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ২০১৮ সালের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালের ঋণের ২৯.৫৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী ১৭০৭টি চু্ক্তি করেছে। বছরে ১৫ শতাংশ চুক্তি বেড়েছে। অনন্য ফিনটেকগুলো বার্ষিক ১৪৬৩ সংস্থার সাথে চুক্তি করেছে। অন্যান্য বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ২৭৪৫, যার বেশির ভাগই কর্পোরেট বিনিয়োগকারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে ১১.৮৯ বিলিয়ন ডলারের ৯৬৫ টি বিনিয়োগ করে শীর্ষ ফিনটেক বাজার হিসাবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে এশিয়া এটিকে প্রারম্ভিক পর্যায়ে দেখছে। ধীরে ধীরে মেগা বিনিয়োগ করছে। এশিয়ায় বছরে ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এশিয়ার ফিনটেক সংস্থাগুলোর তহবিলের পরিমাণ ২২.৬৫ বিলিয়ন ডলার যা ৫১৬ টি চুক্তির মাধ্যমে করেছে।

ফিনটেক ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অনুন্নত আর্থিক ব্যবস্থা, বিশাল অব্যবহৃত জনসংখ্যা ও স্মার্টফোন ব্যবহারের হার, উদ্ভাবনী ডিজিটাল ফিনান্সগুলোর বিকাশ ঘটিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রযুক্তি জ্ঞানসমৃদ্ধ একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পুরানো ধ্যান-ধারণাকে বাদ দিয়ে আধুনকি প্রযুক্তিনির্ভর সেবা ফিনটেক যুগের দাবি। আশির দশকে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের সাথে পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের। মোবাইল ফিনান্সিয়ালের সাথে পরিচয় ঘটে ৪-৫ বছর আগে। বিকাশের মতো নন-ব্যাংকিং ফিনটেক সংস্থা বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের মোবাইল মানি সেবার ক্ষেত্রে বাজারের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম আই পে’র পরে রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলো বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি এক্সিলার, ইনকিউবেটর, স্টার্টআপ ইভেন্ট দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার আলোড়ন তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে দেশের প্রযু্ক্তিতে। মোবাইল মানি সেবা ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার মতো অ্যাকাউন্ট খোলা, ঋণ, বীমা এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবাগুলো প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় করা হয়নি।

ফিনটেক প্রযুক্তি
আধুনিক আর্থিক পরিসেবা খাত ৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো। অর্থ পরিশোধের জন্য সতেরো শতকে চেক প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং এর কয়েক শতাব্দী আগে বীমার কার্যক্রম শুরু করা হয় তবুও, আজ বাংলাদেশের ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই এবং তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম দেশের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ নয়। সঠিক নিয়ামক কাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সহায়তায় গৃহীত হলে ফিনটেক এই দৃশ্য পরিবর্তন করতে পারে। ফিনটেক বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রস্তুত। ফিনটেক বাংলাদেশের অর্থনীতি কার্যক্রমের সংস্কার করতে পারে।

ভারতের মতো অন্যান্য উদীয়মান দেশগুলির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফিনটেকের অনেক উপাদান ইতিমধ্যে গ্রহণ করে এর সুবিধা ভোগ করছে। বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ প্রদানের সুবিধার্থে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির একটি বিশাল অংশকে আনতে সহায়তা করবে। আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির মাধ্যমে অর্থ প্রদান বাড়ানো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে এবং কর আদায়ের কার্যকারিতা উন্নত করবে। ফিনটেক নোট মুদ্রণ ও বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ পরিমাণ লেনদেন হ্রাস করবে। ফিনটেক দেশে জাল মুদ্রার প্রচারের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো স্বয়ংক্রিয়করণে পিছিয়ে রয়েছে। ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর মতো নতুন নন-ব্যাংকিং আর্থিক পরিষেবা সরবরাহকারী গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে ও বাজার দখল করতে পারে। ফিনটেক বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে ও বৃদ্ধির হারকে বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সমর্থন ও তহবিল প্রয়োজন।

ফিনটেকের মাধ্যমে ক্যাশলেশের দিকে যাচ্ছে পৃথিবী
নগদ অর্থের হ্রাস প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যয় হ্রাস ও ঝুঁকি পরিচালনা করতে সহায়তা করবে। প্রচলিত আর্থিক কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করার ক্ষমতা আছে ফিনটেকের। ঋণ আবেদন বা বীমা প্রস্তাব অনলাইনে জমা দেওয়া, যাচাইকরণ ও অনুমোদন প্রক্রিয়া কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন হতে পারে। প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবেদনকারী অনলাইনে বা ইমেলের মাধ্যমে তার আবেদন সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়া পাবেন। ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপগুলোতে ধারাবাহিকতা নিয়ে আসে ও ত্রুটি এবং পক্ষপাতের ঝুঁকি হ্রাস করে। আর্থিক পণ্য বিক্রি করার সময় হ্রাস ও গ্রাহকদের সন্তুষ্টি বাড়ায় ফিনটেক।

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যাক তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে যারা দ্রুত প্রযুক্তি গ্রহণ ও সম্ভাব্যভাবে ফিনটেকের আগ্রহী ব্যবহারকারী হতে পারে। আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিসেবাদি নেটওয়ার্কে আরও গতিশীল করার জন্য বাংলাদেশের আর্থিক সেবা সংস্থাগুলো তাদের রূপান্তর যাত্রায় ফিনটেক গ্রহণ করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফিনটেক ও ডিজিটাল ফিনান্স জনগণের কাছে প্রাথমিক ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা আনতে মৌলিক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রাখে।

ফিনটেকের সুবিধাগুলো কী কী?
ফিনটেকের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার সুবিধা অনেক। যেমন সাধারণ মানুষ কোনো ব্যাংকের শাখায় না গিয়ে শুধু মোবাইল ফোন থেকেই সব ধরনের লেনদেন করতে পারেন। একজন চাকরিজীবী সরাসরি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন পেতে পারেন। তাত্ক্ষণিকভাবেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ তথ্য পেয়ে যাবেন তিনি। ফোন ব্যবহার করেই বাড়িভাড়া দিয়ে দিতে পারেন। শুধু একটি কিউআর কোড স্ক্যান করে দোকানে বা রেস্তোরাঁয় কেনাকাটা করতে পারেন। ফোন ব্যবহার করে যানবাহনের ভাড়া দেয়া কিংবা টিকিট কাটার সুযোগও রয়েছে। যেহেতু প্রতিটি লেনদেনের তথ্য সংরক্ষিত থাকছে, সেহেতু অ্যাকাউন্টধারীও সামগ্রিক ব্যয়ের তথ্য সম্পর্কে ধারণা পান। ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়িয়ে সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়া উন্নত আর্থিক সেবা যেমন ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ, ইন্স্যুরেন্স ও বিনিয়োগের জন্য শেয়ার কেনাবেচায়ও এ সেবা ব্যবহার করা যেতে পারে।

ফিনটেকের মাধ্যমে স্বল্প খরচে অপেক্ষাকৃত বেশি ও উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে গ্রাহক ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা পেতে পারেন। এতে ঝামেলা কমে ও সময় বাঁচে। এছাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করলে গ্রাহকদের নিজের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনা অভ্যাস উন্নত হয়। দেখা গেছে, যদি প্রতিটি লেনদেনের পর গ্রাহক একটি বার্তা পায়, তবে তার খরচের প্রবণতা ১৭ শতাংশ কমে যায়। এছাড়া ফোনের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করলে তা ঝামেলামুক্তভাবেই করা সম্ভব। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনে ১০ টাকা করে সঞ্চয়ের সুযোগ পেলে অনেক গ্রাহকই এ সেবার ব্যাপারে আগ্রহী হবেন। কখনো কখনো মাসের শেষদিকে চাকরিজীবীদের কিছুটা অর্থসংকট দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে স্বয়ংক্রিয় ঋণের সুবিধা পাওয়া গেলে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। আমাদের কৃষকরা যদি সহজে ও স্বল্পমূল্যে নিজের ফোন থেকেই ফসলের বীমা কিনতে পারেন, তবে তাদের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা অনেক সহজ হবে।

ব্যক্তি পর্যায়ের লেনদেনে এটি কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে?
বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা এখন কিছু প্রাথমিক সেবা পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে— এজেন্টের কাছে টাকা জমা দেয়া, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ করা ও বিদ্যুৎ বা পানির বিল দেয়া। যেহেতু আমাদের অনেক গ্রাহক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাই দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমরা জানি উন্নত দেশে লেনদেনের জন্য ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। সেখানে প্রায় প্রতিটি দোকানেই ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের জন্য পিওএস মেশিন প্রয়োজন হয়। অথচ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহার করে গ্রাহকরা খুব সহজেই যেকোনো দোকানে লেনদেন করতে পারবেন। এজন্য দোকানগুলোকে শুধু একটি কিউআর কোডের স্টিকার ব্যবহার করতে হবে। দামি পিওএস মেশিনে বিনিয়োগ করার কোনো প্রয়োজন হবে না তাদের। যেহেতু আমাদের দেশে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড তেমন একটা জনপ্রিয় না, তাই আমরা সরাসরি উন্নততর মোবাইল পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। সহজে ও কম বিনিয়োগে অল্প সময়ে সারা দেশে তা চালু করতে পারি।

এশিয়ার দুটি বড় দেশ চীন ও ভারত ফিনটেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে চীনে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন সব লেনদেন ও আর্থিক সেবার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। চীনে দুপুরের খাবার হিসেবে নুডলস কেনার জন্যও আলিপে অথবা উইচ্যাট ব্যবহার করতে হয়। অনেক রেস্তোরাঁয় নগদ লেনদেন একেবারেই গ্রহণযোগ্য না। আমরা মনে করি, আগামী তিন বছরে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও মোবাইল ফোনভিত্তিক লেনদেন যথেষ্ট প্রসার লাভ করবে।

নিজের ফোন থেকে সব ধরনের আর্থিক সেবা পাওয়া গেলে গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। অধিকাংশ সেবার জন্য তাদের কখনো ব্যাংক ব্রাঞ্চে যেতে হবে না। চেক বই ব্যবহার বা সঙ্গে করে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বহন করতে হবে না। অ্যাপ অথবা এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকরা নিজের ফোনে সব সময় লেনদেনের সব খোঁজখবর পেয়ে যাবেন। যেকোনো ঝামেলায় সহজেই সব ধরনের আর্থিক সেবা গ্রহণ করতে পারবেন গ্রাহকরা।

এক্ষেত্রে ব্যাংক বা সেবাদাতারা কী ধরনের সুবিধা পাবেন?
ফিনটেক জনপ্রিয় হলে ব্যাংক বা সেবাদাতারাও অনেক সুবিধা পাবেন। সব মানুষ ব্যাংকিং সুবিধা পেলে সেবাদাতাদের গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যাবে। পাশাপাশি উন্নত ব্যাংকিং সেবা সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। মোটের ওপরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি আসবে। যেহেতু অধিকাংশ সেবা প্রযুক্তির মাধ্যমে দেয়া হবে, তাই স্বল্পসংখ্যক ব্রাঞ্চ ও সীমিত লোকবল নিয়েই অনেক বেশি মানুষকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রে তিন হাজার গ্রাহকের জন্য একটি শাখা স্থাপন করতে হয়। এতে গড়ে পাঁচজন করে কর্মকর্তা ও অন্যান্য লোকবলের প্রয়োজন হয়। অথচ ফিনটেক ব্যবহার করে দুটি সার্ভার কম্পিউটার ও কিছু সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১০ লাখ গ্রাহককে আর্থিক সেবা দেয়া সম্ভব। ব্যাংকের খরচ কমে গেলে সাধারণ মানুষকে সুলভ মূল্যে সব রকমের আর্থিক সেবা দেয়া সম্ভব হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে, যার ভিত্তিতে এআই ব্যবহার করে ঋণ প্রদানের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এর ফলে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাত, যেমন কৃষি ও এসএমইতে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে। ত্বরান্বিত হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

ইন্টার-অপারেবিলিটি কী?
ইন্টার-অপারেবিলিটির বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি, আমরা সবাই কোনো না কোনো মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করি। এখন এমন যদি হতো, যে অপারেটরের সিম, শুধু সেই সিমের গ্রাহককেই কল করা যাবে, তাহলে কি এটা আমাদের জন্য খুব একটা ভালো জিনিস হতো? হতো না অবশ্যই। ইন্টার-অপারেবিলিটি সেবাগ্রহীতাদের জন্য ভালো। মোটের ওপরে দেশের জন্যও ভালো। এটা যদি না হতো, তাহলে আজ মোবাইল ফোন সেবা এ রকম প্রসার লাভ করত না।

পাশের দেশ ভারতে ন্যাশনাল পেমেন্ট করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এনপিসিআই) মাধ্যমে এখন চমৎকার ইন্টার-অপারেবিলিটি সেবা চালু হয়েছে। তারা এত চমৎকার একটা পেমেন্ট প্লাটফর্ম করেছে, যেখানে যে কেউ যে কাউকে টাকা পাঠাতে পারবে যেকোনো একটা প্লাটফর্ম ব্যবহার করে। আমাদের এখানেও জাতীয় পর্যায়ে ইন্টার-অপারেবিলিটিকে ফ্যাসিলেটেট করার জন্য আরো অনেক কাজ করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিওরক্যাশ কিন্তু চারটি ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের ও এ চারটি ব্যাংকের মধ্যে আবার সম্পূর্ণ ইন্টার-অপারেবিলিটি কার্যকর আছে। আমাদের একটি পেমেন্ট সুইচ আছে, যেটা রূপালী ব্যাংক অপারেট করছে। সুতরাং আপনার যদি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ওয়ালেট হয়, সেখান থেকে রূপালী ব্যাংকে পেমেন্ট করতে পারবেন। সুতরাং ইন্টার-অপারেবিলিটি যে খুব কঠিন জিনিস, সেটা আমরা মনে করি না। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই সবাইকে একসঙ্গেই এগিয়ে আসতে হবে।

ফিনটেকে নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলো কী কী?
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করলে আমাদের অবশ্যই এর নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেন মূলত একটি নিরাপদ সেবা। একটি লেনদেন করতে গেলে আপনার ফোনটি যেমন দরকার, তেমনি গ্রাহকের গোপন পিনটাও অপরিহার্য। এছাড়াও গ্রাহক প্রতিটি লেনদেনের পর এসএমএস পাচ্ছেন ও যেকোনো সময় অ্যাকাউন্টের স্থিতি দেখে নিতে পারছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের ঝুঁকির ক্ষেত্রে গ্রাহকের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন গ্রাহককে তার ফোন ও পিন নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের অধিকাংশ গ্রাহক সুলভ মূল্যের ফিচার ফোন ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করে থাকেন। দুঃখের বিষয় ফিচার ফোন দিয়ে লেনদেন করা কিছুটা জটিল। তাই অনেক গ্রাহক এজেন্ট বা অন্য কারো সহযোগিতা নিয়ে লেনদেন করে থাকেন। এক্ষেত্রে গ্রাহক কিছুটা ঝুঁকির মুখোমুখি হন, যা নিরসনের জন্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এবং রিটেইল এজেন্টসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে যেসব গ্রাহক স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তারা অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই লেনদেন করতে পারেন। তাই আশা করা যায়, আগামী দুই-তিন বছরে স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের লেনদেনের বিষয়ে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button