ব্যাংকার

ব্যাংকারদের দাবি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিভাবকত্ব

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এ প্রেক্ষিতে ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল (রবি-বৃহস্পতি) পর্যন্ত সীমিত আকারে ব্যাংকিং চালু রাখার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সময় অনুযায়ী সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লেনদেন করা যাবে। লেনদেন–পরবর্তী আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করার জন্য ব্যাংক খোলা থাকবে বেলা দেড়টা পর্যন্ত।

এ প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে ব্যাংকাররা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাংকাররা একের পর এক তাদের ক্ষোভ, ভয় ও দাবির কথা শেয়ার করতে থাকে। তাদের মতে, সারা পৃথিবীতে করোনাঘাতক যেখানে মৃত্যু হয়ে প্রতিটি মানুষকে তাড়া করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত প্রাণঘাতী। তাছাড়া করোনা আতঙ্কে পুরো দেশকেই যেখানে সরকারিভাবে লকডাউন করা হয়েছে, সেখানে ব্যাংকারদেরকে কেন ব্যাংকে গিয়ে গ্রাহকসেবা দেওয়ার নামে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

কেও কেও বলছেন, সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা চালু রাখলে গ্রাহকরাও কি সীমিত সংখ্যক ব্যাংকে আসবে? কারণ আগে যে কাজগুলো ৮ ঘন্টায় করতে হত, এখন সেই কাজগুলোই ব্যাংকারদের করতে হবে সাড়ে ৩ ঘন্টায়। আর আগে যে গ্রাহকদেরকে ৬ ঘন্টায় সেবা দিতে হত, সেই সংখ্যক গ্রাহকদেরকেই এখন সেবা দিতে হবে মাত্র ২ ঘন্টায়! এতে করে সময় বিবেচনায় গ্রাহকদের ভীড় এবং ব্যাংকারের কাজের চাপ বাড়বে বৈ কমবে না, যা করোনাভাইরাস সংক্রমণে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

কেও কেও ব্যাংক খোলা রাখার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করারও আরজি জানিয়েছেন। একজন বলেছেন, ‘মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এই দুঃসময়ে কেন অফিস করতে হবে? বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কি এসব মৃত্যুর দায় নিবে?’ আরেকজন বলেছেন, ‘সমস্ত অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে, গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, এমন অনেক ব্যাংকার আছেন যারা এক-দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিলে এসে অফিস করেন। তাহলে সেসব ব্যাংকাররা অফিসে আসবে কীভাবে?’

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এসময় অফিস করতে আসা কর্মীদের জন্য জীবনবীমা সুবিধা ও ঝুঁকিভাতাও দাবি করা হয়েছে। পাশাপাশি এসময়ে কোনো ব্যাংকার মৃত্যুবরণ করলে তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য যথোপযুক্ত ও মানসম্মত শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা চেয়েছেন একজন। অন্য একজন ব্যাংকারদের জন্য একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফরমের (সংগঠন) দাবিও করেছেন। ব্যাংকারদের এসব দাবির পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকতে পারে। তবে এসব দাবির পক্ষে বিপক্ষে আমার কোনো মতামত না থাকলেও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করতে চাই।

প্রায় প্রতিটি শীত, বন্যা, অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সকল জাতীয় দুর্যোগ ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ব্যাংকগুলো আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। রানা প্লাজা ধসে কোনো কোনো ব্যাংক একাই ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে সরকারি ত্রাণ তহবিলে। চলতি বছরের শুরুতেও মুজিব বর্ষ উদযাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে ২২৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে ব্যাংকগুলো। শীতার্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়েছিল ২৭ লাখ কম্বল। চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দু-একটি ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকেরই স্যানিটাইজেশন বিষয়ক নির্দেশনা ছাড়া তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের কথা কোনো খবরে দেখিনি।

করোনাভাইরাস যেখানে ভয়াবহ পর্যায়ের একটি ছোঁয়াচে ভাইরাস, সেখানে ব্যাংকারদের বলা হয়েছে- সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করার জন্য। এতে করে কোনো শাখার একজন ব্যাংকার করোনা আক্রান্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোয়ারেন্টিনে চলে যাওয়া। আর বাস্তবে যদি এমনটা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট শাখাটি চলবে কিভাবে, চালাবেইবা কে?

ব্যাংক খোলা রেখে সেবাদানে ব্যাংকারদের অনীহার সমালোচনা করে কেও কেও বলছেন, শুধু ব্যাংকাররাই জীবন-ঝুঁকিতে নয়। ডাক্তার-নার্সদের জীবনও মৃত্যুর মুখে। পুলিশ-সেনাবাহিনী-র‍্যাব ও প্রশাসনের যারা কাজ করছেন, তাদের জীবনও করোনা ঝুঁকিতে। আজ এমন সময়ে ডাক্তার যদি বলে আমি রোগী দেখব না, নার্স যদি বলে আমি রোগীর সেবা করব না, পুলিশ-সেনাবাহিনী-র‍্যাব ও প্রশাসনের সবাই যদি বলে আমাদের ছুটি দিয়ে দিন, বউ-বাচ্চা নিয়ে নিরাপদে বাসায় থাকি, তাহলে আমরা লাশের পর লাশের সারি দেখব। আর এই সারিতে ব্যাংকাররাও যে থাকব না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে কি? তাছাড়া, কোনো সৈনিক যুদ্ধে গেলে গুলি খেয়ে মারা যেতে পারে বলে ‘যুদ্ধে যাবে না’ বলতে পারে না। তাই ব্যাংকারদেরও জাতীয় প্রয়োজনে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে হলেও গ্রাহকসেবা দিতে হবে।

কিন্তু একজন ব্যাংকার হিসেবে যদি বলি, তাহলে বলব- একজন ডাক্তার, প্রতিরক্ষাবাহিনী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মত ব্যাংকারদের বাস্তবতা এক রকম নয়। এদেশের ডাক্তারদের যে আর্থিক সক্ষমতা, তাতে ১০ বছর ডাক্তারি করার পর কোনো ডাক্তার চাকরি ছেড়ে দিলেও বাকি জীবন সে পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারবে। আর এই শক্তিতেই ডাক্তারগণ পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) না পেলে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমনকি সাধারণ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীকেও ডাক্তাররা এখন সেবা দিচ্ছেন না বলে শুনা যাচ্ছে। নিজের জীবন বাঁচাতে কোনো কোনো ডাক্তার চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিচ্ছেন। কেও কেও নিজের কর্মস্থলে আসছেন না বা গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু একজন ব্যাংকারও কর্ম ছেড়ে পালিয়ে যায়নি, জীবন বাজি রেখেই গ্রাহকসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাই ব্যাংক যদি বন্ধ না-ই হয়, তাহলে ডাক্তারদের মত ব্যাংকারদেরও পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) প্রয়োজন আছে বৈকি।

দেশের একাধিক পেশাজীবীরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা চিকিৎসায় এবং করোনা মোকাবেলায় নিয়োজিত আছেন। এ শ্রেণির সর্বাগ্রে নাম আসবে ডাক্তার ও নার্সদের। এর পর আছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের কর্মী। জরুরি সেবাদাতা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকারদের নামও। আসলে এমন দুর্যোগে সবাই যেখানে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, সেখানে হাতে গুণা কয়েক পেশাজীবীদের সাথে ব্যাংকাররাও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সেবা দিবে– এটা ব্যাংকারদের জন্য অনেক মহৎ কর্ম বটে। কিন্তু এ দায়িত্বটাকে এমন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার মানসিকতাইবা ক’জনের আছে। কারণ সবাই ভাবে, ‘আমি মরে গেলে আমার পরিবারের কী হবে!’ আর এমন ভাবনাটাও নেহাত অমূলক নয়। করোনায় কোনো ব্যাংকার মারা গেলে তার পরিবার আর্থিক ও সামাজিক কী নিরাপত্তা পাবে- এমন কোনো ঘোষণা যে নেই ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশনায়। তাছাড়া যেখানে মৃত্যুর হাতছানি সেখানে যেতে সাহস, শক্তি ও মানসিকতাইবা ক’জনের আছে?

অন্যদিকে পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী আর প্রশাসনের যারা ছুটির দিনেও দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাদের কাছে তো পাবলিক ভীড়ে না, বরং তাদের দেখলে পাবলিক পালিয়ে বেড়ায়। তাই করোনা রোগী তাদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম; কিন্তু ব্যাংকারদের হাতে হাতে ময়লা টাকা, আর নাকের ডগায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা করোনা সম্ভাবনাময় শত শত গ্রাহক! তাছাড়া সরকারি এসব বাহিনীর আছে নিজস্ব সরকারি পরিবহন। কিন্তু ব্যাংকারদের ক’জনের আছে নিজস্ব গাড়ি। আর গাড়ি থাকলেও তো তা চলাচলে আছে নিষেধাজ্ঞা। শুনেছি, ২৯ মার্চ থেকে যে ব্যাংক খোলা তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেও কেও জানেই না। তাই ২৯ মার্চে অফিস পথে ব্যাংকারদের পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনা ও জেরার মুখে।

আসলে ছুটির দিনে অফিস করা, বেতন, বোনাস, ছুটি, প্রমোশন, কাজের চাপ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ব্যাংকারদের ক্ষোভ নতুন নয়। ঈদের আগের দিন অফিস করা ও গরুর হাটে গিয়ে জাল নোট সনাক্ত করা, শুক্র-শনিতে আয়কর ও নির্বাচনের জামানতের টাকা জমাগ্রহণ ব্যাংকারদের জন্য এখন নিয়মিত ও সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিআইবিএম-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ৬৭ শতাংশ ব্যাংকার। এ প্রতিবেদনের পরেও ব্যাংকারদের অসন্তোষ লাঘবে তথা ব্যাংকারদের উন্নয়ন ও কল্যাণে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ কেও নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যাংক ও ব্যাংকারদের হুকুম দেওয়াটা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতার মধ্যে পড়ে, ঠিক তেমনি হুকুম পরিপালনে তদারকির দায়িত্বটাও নিশ্চয় বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু ব্যাংকারদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি এবং দায় কতটুকু, চলুন একটু সেদিকেও নজর দেই।

২০১৮ সালে ব্যাংকারদের ১৫ দিনের টানা বাধ্যতামূলক ছুটি কমিয়ে ১০ দিন করা হয়েছে। কিন্তু এই ১০ দিনের ছুটিটাও ব্যাংকাররা পাচ্ছে কিনা- এটা কি বাংলাদেশ ব্যাংক খবর নিয়েছে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুন শেষে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রারম্ভিক পর্যায়ে কর্মরত নারী কর্মীর সংখ্যা ১৮ শতাংশ, যা ক্রমশ বর্ধমান। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার ইস্যু করে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে যে, কোনো নারী কর্মীকে সন্ধ্যা ছ’টার পর অফিসে থাকতে বাধ্য করা যাবে না। এই নির্দেশনাটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং ব্যাংকার মহলে যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছে– এই মর্মে যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকারদের নিয়েও ভাবে! কিন্তু এই নির্দেশনাটি ব্যাংকগুলো বাস্তবায়ন করছে কিনা বা ব্যাংকগুলো এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা- এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান আছে কি?

আর ব্যাংকগুলোতে লোকবলের যে অবস্থা এতে করে কোনো ডেস্কের একজন কর্মকর্তাকে তার কাজ শেষ করার আগেই তাকে অফিস ত্যাগ করতে দিলে তার দিনের অসম্পূর্ণ কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো কোনো ব্যাকআপ অফিসার বা এমন মানসিকতার অফিসার খুব কম শাখাতেই আছে। যেমন আমার পরিচিত এক ব্যাংকার বন্ধু তার প্রধান কার্যালয়ে পিএফ লোনের আবেদন করে দশ দিন পর লোন মঞ্জুর হয়েছে কিনা জানতে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে ফোন দিলে তাকে জানানো হয়, ‘ডিলিং অফিসার হজ করতে সৌদি চলে গেছেন, ওনি হজ সেরে আসার পরে ফোন দিয়েন।’

তাছাড়া ছ’টার পর নারীকর্মীরা অফিসে থাকবেন না, পুরুষ কর্মীরাইবা থাকবেন কেন? একজন নারী কর্মী এবং একজন পুরুষ কর্মীর অফিস ত্যাগ করার সময়ের ব্যবধান আধা ঘন্টা হলে সমস্যা নেই, কিন্তু একজন নারীকর্মী সন্ধ্যা ৬ টায় অফিস থেকে বের হয়ে গেল, আর একজন পুরুষ কর্মী রাত ৮ টায়ও যদি অফিস থেকে বের হতে না পারেন, তখন কিন্তু ওই নারী কর্মীটি অন্যান্য পুরুষ কর্মীদের জন্য কায়ক্লেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অফিসে সর্বসাকুল্যে দু-একজন নারী কর্মী হলে হয়ত তাদের কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু যেসব শাখায় পুরুষ কর্মীর চেয়ে নারী কর্মী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যেসব শাখা ৬টার মধ্যে গুটানো সম্ভব হয়না, সেসব শাখার সব নারী কর্মীই যদি ৬টা বাজলেই অফিস ত্যাগ করেন, তাহলে বাকি পুরুষ কর্মীরা কি নিজেদের কাজ করবেন নাকি নারী সহকর্মীদের ফেলে যাওয়া কাজ করবেন। ফলশ্রুতিতে এই নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন এখনো পুরোপুরি বাস্তবতা দেখেনি।

আমি নারীবিদ্বেষী নই। আমার শাখায় আমি নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে সবসময়ই মানবিক এবং তাদের যথাসময়ে অফিস ত্যাগে এবং তাদের সমস্যায় বরাবরই উদার। কিছু দিন পর আমার স্ত্রীও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে। তাই আমি বলতে চাচ্ছি, কর্মপরিবেশ এবং কর্মবণ্টন এমন হওয়া উচিত যাতে নারী-পুরুষ উভয় কর্মীই যথাসময়ে কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করতে পারেন। তাই যথাসময়ে অফিস ত্যাগের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শাখার আমানত, ঋণ, বার্ষিক আমদানি ও রফতানি, ঋণ হিসাবের সংখ্যা, খেলাপি ঋণের সংখ্যা, দৈনিক ভাউচার সংখ্যা, দৈনিক নগদ গ্রহণ ও প্রদানের পরিমাণ, বিভিন্ন ইউটিলিটি ও কালেকশন একাউন্টের ভাউচার সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে শাখার লোকবল সংখ্যা নির্ধারণ করে পোস্টিং নিশ্চিত করার বিষয়টিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি করা উচিত।

শ্রম আইন অনুসারে নিয়মিত কর্মঘন্টার (আট ঘন্টা) অতিরিক্ত সময়ে কাজ করার জন্য শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরির তিনগুণ হারে পারিশ্রমিক দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু ব্যাংকারদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই ব্যাংকারদের ঈদ, নির্বাচন, আয়কর জমাগ্রহণকালীন সময়ে ছুটি কামাই দিয়ে অফিস করতে নির্দেশনা জারি করে। আর ব্যাংকগুলোকে ছুটি বিসর্জনকারী ব্যাংকারদের যোগ্য পারিশ্রমিক প্রদানেরও নির্দেশ দিয়ে থাকে। কিন্তু এই যোগ্য পারিশ্রমিকের হার বা মানদণ্ড কী হবে তা নির্দেশিত না থাকায় ছুটির দিনে কাজ করার জন্য কর্মকর্তাদের দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা প্রদান করে কোনো কোনো ব্যাংক। বহুল কাঙ্ক্ষিত ঈদের ছুটি কামাই দেওয়ার ক্ষতিপূরণ যদি ২০০ টাকা হয়, তা ব্যাংকারের মনের বিষাদগ্রস্ততা বাড়ায় বৈকি কমায় না। একইভাবে যেসব শাখার ব্যাংকাররা ৪ টার পর আরও ২ ঘন্টার সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিং করেন, তারা স্বভাবতই অন্য ব্যাংকারদের চেয়ে দেড়-দুই ঘন্টা পরে অফিস শেষ করেন। কিন্তু তাদের এই অতিরিক্ত ২ ঘন্টার শ্রমের জন্য বাড়তি পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত নয় কি?

বায়োমেট্রিক এ্যাটেনডেন্স মেশিন বসিয়ে কর্মীদের লেইট এ্যাটেন্ডেন্সের কারণে লেইট মার্ক করা হচ্ছে, বেতন কেটে নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু সেই কর্মকর্তাই দিনের পর দিন দৈনিক ২-৩ ঘন্টা ওভারটাইম করে যাচ্ছেন, কিন্তু তার কোনো আর্থিক মূল্য পাচ্ছেন না। ওভারটাইমের কোনো মূল্য বা স্বীকৃতি না দিয়ে লেইট এ্যাটেন্ডেন্সের জন্য পেনালাইজ করা কতটাই-বা নৈতিক।

সরকারি কর্মকর্তাদের মত ব্যাংকারদেরও শুদ্ধাচার পুরস্কার দিতে ২০১৮ সালে একটি নীতিমালা করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও সততার নিদর্শনসহ ২০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক ব্যাংককে প্রতি বছর এই পুরস্কার দিতে বলা হয়। এবং ২০১৮ সাল থেকেই এ পুরস্কার চালু করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ২০১৮ গেল, ২০১৯ গেল; ২০২০ ও যায় যায়– এখনো এই পুরস্কার ব্যাংকারদের অধরাই রয়ে গেল।

একজন ব্যাংকারের বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী ব্যাংকই প্রদান করে থাকে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘ব্যাংকারদের ব্যাংকার’ এবং ‘ব্যাংকারদের শেষ আশ্রয়স্থল’ও বলা হয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকারদের শাসকের ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি ব্যাংকারদের অভিভাবকের দায়িত্বটাও পালন করুক। ব্যাংকারদের দায়-দায়িত্ব আরোপের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন দাবি পূরণ ও দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অসন্তোষগুলো লাঘব করে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ব্যাংকারদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধাগুলো আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পিতৃ-মাতৃসুলভ ভূমিকাই কাম্য।

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, ব্যাংকার

৪ মন্তব্য

  1. ধন্যবাদ। সময়োপযোগী একটি লেখা। বর্তমানে ব্যাংকিং পেশাটা সবচেয়ে চ্যলেন্জিং এবং অনিশ্চিয়তার। কর্তা ব্যাংকের নির্দেশনা দেয়া ছাড়া আর কি কিছুই করার নেই এই অসহায় ব্যাংকারদের জন্য?

  2. এখানেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা লাগবে। কারণ সবাই সিদ্ধান্ত দেয় কাগজ দেখ‌ে। আর মাননীয় নেত্রী সিদ্ধান্ত দেন বিবেক দিয়ে।

  3. কাউকে শিক্ষা দিতে আমার লেখা নয়৷ অব্যবস্থাপনা, অসাম্য, দূর্ণীতি ইত্যাদি- অফিস আদালত থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আমার নেই আর সে উদ্দেশ্যেও আমি লিখছি না৷ অসংলগ্ন কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করতঃ সৃষ্ট দগ্ধীভূত অন্তর্জ্বালা নিবারণের জন্যই মাঝে মধ্যে তা প্রকাশ করার এ ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র!

    অফিসের কাজে আন্তরিক ও দায়িত্বপরায়ণ কর্মকর্তা কর্মচারীকে দিয়ে অধিক কাজ করানোর পাশাপাশি একটু মূল্যায়ন করা তো দূরের কথা আমরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি অবজ্ঞাভরে ভর্ৎসণা প্রদর্শন ক’রে থাকি – দুঃখজনক, যা মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী!

    যারা কাজ করে তাদের উপর পর্যায়ক্রমে আরও কাজ চাপিয়ে দেই আর যারা কাজ করেনা বরং লিয়াজো (তোষামোদী) করে চলে- তারাই কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের কাছে প্রিয় এবং সমস্ত সুযোগ সুবিধা তারাই বেশী পায়- এটাই বাস্তবতা৷

    কখনো কখনো লিয়াজো নিম্নগামীও হয়ে থাকে- সে ক্ষেত্রে বুঝতে হবে কিছু একটা ভুল বা অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে৷

    প্লেটো বলেছেন, ”ন্যায় বিচারের রূপ একটি, অত্যাচারের শত রূপ। এই কারনেই ন্যায় বিচার করা অপেক্ষা অত্যাচার করা সহজ”৷

    সাম্প্রতিক দেখা যায়, বিভিন্ন কার্যালয়ে, কাজের প্রতি আন্তরিক ও দায়িত্বশীল বিনয়ী কর্মকর্তা কর্মচারীগণ- কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিভিন্নভাবে নীরবে অত্যাচারিত হয়ে যাচ্ছে- যা ভাষায় বর্ণনা করা তাদের পক্ষে খুবই কঠিন৷ এহেন পরিস্থিতি আমাদের মোটেও কাম্য নয়!

    পাশাপাশি, আমি মনে করি, সময় মত অফিসে যাওয়া সহ অফিস চলাকালীন সময়ে সাধ্যমত কাজের মধ্যে যুক্ত থাকার চেষ্টা করা– অফিস প্রধানের মনোরঞ্জনের জন্যে বা তাঁর ভয়ে নয় বরং তা একেবারে বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা সহ দায়িত্ববোধের থেকেই হওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button