ফিনটেক

আধুনিক ব্যাংকিং ও ভবিষ্যৎ চাহিদা

ফুয়াদ হাসানঃ ব্যাংক বলতে সাধারণত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়, যা জনতার কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই মূলধন বা পুঁজি উদ্যোক্তা বা ব্যক্তিদের ঋণ দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে। বাংলাদেশের ১৯৯১ সালের ব্যাংকিং আইনের ৫(৩) ধারা অনুযায়ী, ‘ব্যাংক ব্যবসা হলো জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা, ঋণদান ও বিনিয়োগ করা এবং চাহিবামাত্র আমানতকারীকে চেক, ড্রাফট বা অন্য কোনোভাবে অর্থ পরিশোধ করা।’ মধ্যযুগে ইতালিয়ান ব্যবসায়ীরা লম্বা টুলে বসে অর্থের ব্যবসা করত। তারা ধনীদের অর্থ জমা রাখতো এবং অন্যদের সেই অর্থ ধার দিত। তাদের ব্যবসায়িক এরূপ লেনদেন থেকেই আজকের ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয়েছে।

কালের আবর্তে সব কিছুর পরিবর্তন ও বিবর্তন হয়েছে, ঠিক তেমনি ব্যাংকিং ব্যবস্থারও বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের মোবাইল বা অনলাইন ব্যাংকিং যুগে পৌঁছিয়েছে। বিশাল অবেদন পত্র, দীর্ঘ লাইন, সময়ের বিড়ম্বনা, কাগজি ফাইলের অফুরন্ত ঝামেলার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে আধুনিক, সহজ ও গ্রাহকবান্ধব মোবাইল বা অনলাইন ব্যাংকিং। যার মাধ্যমে খুব সহজে গ্রাহকের চাহিদা মতো সেবা দেয়া সম্ভব। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা সপ্তাহের প্রতিদিন ২৪ ঘন্টার যে কোনো সময়ে সেবা প্রদান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। সারাদেশে কার্যত তাদের শাখার সংখ্যা ১০ হাজারেরও অধিক। তবে আমাদের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশের জন্য এই সংখ্যা সন্তোষজনক নয়। তাই ব্যাপক চাহিদাপূরণ ও অর্থিকসেবা সহজ করার লক্ষ্যে ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, গাইডলাইনস অন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ফর ব্যাংকিং চালু করে, যা ডিজিটাল আর্থিক সেবার একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

ওই গাইডলাইনসের ভিত্তিতে ট্রাস্ট ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) চালু করে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং-এর বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এমএফএফ সেবায় বিকাশ সবার শীর্ষে রয়েছে। ৮০ শতাংশের বিশাল বাজারের অংশ বিকাশের। বেশ খানিকটা ব্যবধানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে যথাক্রমে রকেট ও নগদ।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্যমতে, ৯৫ শতাংশ শাখাগুলো অনলাইনসেবা চালু করেছে। ই-ব্যাংকিংসেবায় গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গ্রাহক ছিল ২০ লাখ ৪০ হাজার। ওই এক মাসে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ১ কোটি ৫৪ লাখ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে ডিসেম্বরে লেনদেন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এ দিকে দেশের ১০ হাজার ১০৯ শাখার মধ্যে ৮ হাজার ৮৯৯ ব্যাংক শাখাই অনলাইনের আওতায়। এর মধ্যে বিদেশি ব্যাংকগুলোর শতভাগ শাখা অনলাইনে। সরকারি ব্যাংকগুলো ৯৯ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৯৭ শতাংশ ও বিশেষায়িত সরকারি ব্যাংকগুলোর ২৫ শতাংশ শাখা অনলাইনের আওতায়।

অনলাইল ব্যাংকিং সেবাকে আরো আধুনিক করতে বর্তমান সময়ে অ্যাপসের ব্যবহার বহুল পরিলক্ষিত। জানা গেছে, আগে ২০ শতাংশ বিকাশ গ্রাহক অ্যাপস ব্যবহার করতেন। এখন ৪০ শতাংশ গ্রাহক অ্যাপসনির্ভর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে এটিএম বুথ ছিল ১১ হাজার ২টি। জুন মাসে এটিএম বুথ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৪৭টি, আর জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ১০৬টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ৮৭ শতাংশ কার্ড দিয়ে টাকা তুলতে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে পয়েন্ট অব সেলসে (পিওএস) ছিল ৬৪ হাজার ৩৩৯। এপ্রিলে পিওএস বেড়ে হয় ৬৫ হাজার ৪৯৯, মে মাসে ৬৫ হাজার ৬১৯ ও জুন মাসে ৬৫ হাজার ৯৪৬। গত জুলাইয়ে দেশে ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) ছিল ১ হাজার ৪২৩টি। এদিকে গত মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ড ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ।

আর গত জুলাইয়ে ডেবিট কার্ড বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৯৯ লাখে। যা জুনে ছিল ১ কোটি ৯৭ লাখ। এদিকে সময় উপযোগী হওয়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। গত জুলাইয়ে মোট লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের মাস জুনে মোট লেনদেন ছিল ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে মোবাইলে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সহজ, গ্রাহকবান্ধব ও আধুনিক হওয়ায় প্রতিনিয়ত মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের পরিধি বিস্তার হচ্ছে।

চলতি বছরের জুলাই শেষে এ খাতে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭৩ হাজার, যা জুনে ছিল ৮ কোটি ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে অনলাইন বা ই-ব্যাংকিং এখনো আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মধ্যবয়সি বা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিপুল জনগণ এখনো আধুনিক ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত নয়। বাংলাদেশের ১৬ কোটির বেশি মোবাইল সংযোগ থাকা জনগোষ্ঠীর বিপরীতে মাত্র ২২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর এমএফএস হিসাব রয়েছে যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আবার নিষ্ক্রিয়।

২০১৮ সালের হিসাব বলছে, বাংলাদেশের ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী এমএফএসের আওতায় রয়েছে- বিপরীতে মাত্র ১৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর রেজিস্ট্রেশনকৃত হিসাব রয়েছে। নিরাপদ মোবাইল বা অনলাইন ব্যাংকিং ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও আমরা এখনো পিছিয়ে। মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতি, এটিএম বুথ জালিয়াতি বা প্রতারণা আমাদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নিত্যদিনের ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কেনিয়ার প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৭৩ শতাংশরই একটি করে এমএফএস হিসাব রয়েছে।

এদিকে উগান্ডা ও জিম্বাবুয়েতে প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কদের এমএফএস হিসাব রয়েছে। শুধু তাই নয়, সাব-সাহারান আফ্রিকার ১০টি অর্থনীতিও এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। আধুনিক মোবাইল ব্যাংকিং প্রসারে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও প্রতারণা রোধে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য আরো ব্যাংকিং খাতকে এ খাতে নিয়োজিত হতে উৎসাহ দিতে হবে।

এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। যদিও আধুনিক ব্যাংকিং খাতের প্রসার ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দিকনির্দেশনার দ্বারা মোবাইল বা ই-ব্যাংকিং সেবাকে ত্বরান্বিত করছে। তবে এ খাতে অগ্রগতি ও বৈশ্বিক মানের করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো সচেতন হতে হবে। ই-ব্যাংকিং বা মোবাইল ব্যাংকিং আমাদের এ যুগের দাবি।

আমাদের ধাবমান অর্থনীতির গতিকে ত্বরান্বিত করতে আধুনিক ব্যাংকিং বা ই-ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং এ খাতকে আরও নিরাপদ, সহজ ও গ্রাহকবান্ধব করতে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি ভবিষ্যতে মোবাইল বা আধুনিক ব্যাংকিং হয়ে উঠুক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও অর্থনীতির সহায়ক।

লেখকঃ ফুয়াদ হাসান, কলাম লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button