ব্যাংক গ্রাহকব্যাংক হিসাব

ব্যাংক হিসাব বিষয়ে গ্রাহকের যেসব তথ্য জানা জরুরি

মোশারফ হোসেন: যে কোনো সেবার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতার অবিচ্ছেদ্যতা, অর্থাৎ সেবা গ্রহণের সময় সেবা প্রক্রিয়ায় সেবাদাতা ও গ্রহীতা উভয়েরই অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাই সেবা প্রক্রিয়ায় সেবাদাতার পাশাপাশি সেবাগ্রহীতার কার্যকর অংশগ্রহণ একটি সেবার সফল বিপণন নিশ্চিত করতে পারে। ব্যাংকিং সেবায়ও গ্রাহকদের ব্যাংকিং জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেবা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে সেবার কার্যকারিতা ও গুণগত মান বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়েরই সেবার সময় ও খরচ দুটোই কমে আসবে।

কিন্তু আমাদের দেশে আমরা সাধারণ অনেক ব্যাংকাররাই যেখানে জানি না একটা লিমিটেড কোম্পানি কিংবা একটা এমএফআই’র হিসাব খুলতে কী কী কাগজপত্র লাগে, সেক্ষেত্রে সাধারণ একটা সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে কী কী কাগজপত্র লাগে এবং কী নিয়মকানুন এ সবকিছু একজন সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ ভাবী গ্রাহকের না জানাটা অস্বাভাবিক নয়। ব্যাংকের প্রত্যেক সেবাদাতা কর্মকর্তা তার ব্যাংকের সব পণ্য এবং সেবা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখবেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও গ্রাহক উভয়ই এটা প্রত্যাশা করেন। পাশাপাশি গ্রাহক যদি ব্যাংকিং জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন হন, তাহলে তা হয় সোনায় সোহাগা। শিক্ষিত গ্রাহক নিজেই তার জমা স্লিপ কিংবা চেকটি লিখতে পারেন এবং সঠিকভাবে লিখতে পারেন, বুঝতে পারেন কোন কাউন্টারে টাকা জমা দেবেন, আর কোন কাউন্টার থেকে উত্তোলন করবেন।

সচেতন ও শিক্ষিত গ্রাহকরাই ব্যাংকিং সেবার বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, যেমন এটিএম বুথ কোনো ব্যাংকারের সাহায্য ব্যতিরেকেই ব্যবহার করতে পারছেন। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, পিওএস ব্যাংকিং গ্রাহকদের শিক্ষা ও সচেতনতারই ফসল। এর পরও বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক গ্রাহক ব্যাংকিং-জ্ঞান সচেতন নন। বিআইবিএমের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ আমানতকারী ব্যাংকিং বিষয়ে কোনো খবর পড়েন না, ৯৮ শতাংশ আমানতকারী জানেন না আমানত বিমা সম্পর্কে। অর্থাৎ গ্রাহকদের একটা বড় অংশই ব্যাংকিং নিয়ম এবং বিধিবিধান সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন না, সাধারণ মানুষই তো বটেই। ব্যাংকগুলোও তাদের গ্রাহকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কিংবা ব্যাংকিং নিয়মাচার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারায়, হিসাব খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অনেককেই প্রয়োজনীয় নিয়মাচার সম্পর্কে দ্বিধান্বিত হতে বা অজ্ঞতায় থাকতে দেখা যায়। তাই ব্যাংক হিসাব ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়ার প্রয়াসেই আমার এ নিবন্ধ।

কে হিসাব খুলতে পারবেন: চুক্তি করতে সমর্থ যে কেউই ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন। চুক্তি করতে অসমর্থ ব্যক্তিরা হচ্ছেন মানসিক বিকারগ্রস্ত, দেউলিয়া ও নাবালক। তবে আইনগত অভিভাবক কর্তৃক হিসাব পরিচালনার শর্তে নাবালকদের নামেও ব্যাংক হিসাব খোলা যায়। শারীরিক অক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতা হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধক নয়। তাই পর্দানশিন নারী, নিরক্ষর, পঙ্গু, এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন। ব্যক্তি ছাড়াও একক/যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে কোনো বৈধ সত্তার নামেও ব্যাংক হিসাব খোলা যায়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: ব্যাংকে হিসাব খুলতে গেলে কিছু নিয়মনীতি মেনে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েই হিসাব খুলতে হয়। এসব নিয়মকানুন অনেকেরই জানা নেই। সাধারণত ব্যাংক হিসাব খুলতে গেলে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের (হিসাব পরিচালনাকারী গ্রাহক) দুই কপি সাম্প্রতিক সময়ে তোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি (পরিচয়দানকারী কর্তৃক সত্যায়িত), নমিনির সাম্প্রতিক সময়ে তোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন এক কপি ছবি (অ্যাকাউন্ট হোল্ডার কর্তৃক সত্যায়িত), অ্যাকাউন্ট হোল্ডার ও নমিনি প্রত্যেকের ছবিযুক্ত পরিচয় পত্রের (জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/ড্রাইভিং লাইসেন্স) অনুলিপি লাগবে। হিসাবধারীর পরিচয়পত্রে উল্লেখিত ঠিকানার সঙ্গে বর্তমান/স্থায়ী ঠিকানার অমিল থাকলে পরিচয়পত্রের ঠিকানার সপক্ষে সাম্প্রতিক ইউটিলিটি বিলের (বিদ্যুৎ/গ্যাস/ওয়াসা/টেলিফোন বিল) অনুলিপি জমা দিতে হবে। জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে হিসাব খুলতে হলে জন্মনিবন্ধন সনদের অতিরিক্ত গ্রাহক/হিসাব পরিচালনাকারীর আলোকচিত্রসংবলিত (ছবিযুক্ত) অন্য যেকোনো গ্রহণযোগ্য পরিচিতিপত্র প্রদান করতে হবে। তাছাড়া একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক চলতি হিসাব খুলতে হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স ও প্রতিষ্ঠানের সিলও লাগে। ব্যবসার ধরন ও প্রকৃতি অনুসারে কাগজপত্রের চাহিদা বাড়তে পারে।

পরিচয়দানকারী: ব্যাংকের কাছে অপরিচিত এমন কারও হিসাব ব্যাংক খুলতে পারে না। আবার হিসাব খুলতে আসা সব গ্রাহককেই ব্যাংক আগে থেকেই চিনবে, জানবে এমনটা ভাবাও অমূলক। তাই হিসাব খুলতে আসা গ্রাহককে ব্যাংকের কাছে পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য এমন কাউকে দিয়ে তার নিজের পরিচিতি নিশ্চিত করিয়ে নিতে হয়। উল্লেখ্য, সব ব্যাংক হিসাবেই পরিচিতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো সাধারণত প্রতিনিয়ত লেনদেন হওয়া হিসাব (সঞ্চয়ী, চলতি, এসএনডি), যাদের বিপরীতে চেকবই ইস্যু করা হয়, এসব হিসাবের জন্যই পরিচয়দানকারীর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এফডিআর ও স্কিম হিসাবগুলো পরিচিতি ছাড়াও ব্যাংক খুলে থাকে। মূলত আইনগতভাবে বৈধ কোনো চুক্তি করতে অক্ষম ব্যক্তি কিংবা ফিক্টিশাস (কাল্পনিক বা অস্তিত্ববিহীন) কোনো ব্যক্তি যাতে হিসাব খুলতে না পারে, এজন্যই পরিচিতি গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি ভবিষ্যতে হিসাবধারী কর্তৃক কোনো প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রভৃতি প্রতিরোধ ও প্রতিহতকরণের উদ্দেশ্যেই ব্যাংক হিসাব খুলতে পরিচিতি গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া দ্য নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট-১৮৮১-এর ১৩১ ধারা অনুসারে ব্যাংক কোনো আইনি সুরক্ষা পাবে না, যদি সেটি অপরিচিত কারও হিসাবে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট (চেক, ড্রাফ্ট ইত্যাদি) কালেক্শন করে। ব্যাংক সাধারণত ব্যাংকের কোনো গ্রাহককেই পরিচয়দানকারী হিসাবে গ্রহণ করে।

তবে ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য ও গণ্যমান্য কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের গ্রাহক না হওয়া সত্ত্বেও পরিচয়দানকারী হতে পারেন। সব গ্রাহকই আবার পরিচয়দানকারী হতে পারে না। সাধারণত সঞ্চয়ী, চলতি হিসাবধারীদেরই পরিচয়দানকারী হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ইনঅপারেটিভ বা ডরমেন্ট হিসাবধারী গ্রাহকরা পরিচয়দানকারী হতে পারবে না। তাই কমপক্ষে ছয় মাস ধরে নিয়মিত ও উল্লেখযোগ্য লেনদেনের মাধ্যমে হিসাব পরিচালনা করছেন, এমন গ্রাহকরাই পরিচয়দানকারী হতে পারবেন। কিছু ব্যাংক আবার চলতি হিসাবের পরিচয়দানকারী হিসাবে সঞ্চয়ী হিসাবধারীদের গ্রহণ করে না। সুপরিচিত, নিয়মিত ও উল্লেখযোগ্য লেনদেনকারী সঞ্চয়ী হিসাবধারীকে অবশ্যই চলতি হিসাবের পরিচয়দানকারী হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা পারতপক্ষে পরিচয়দানকারী হন না, আর স্টাফদের পরিচয়দানকারী হতে অনেক সময় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিষেধাজ্ঞা থাকে। প্রস্তাবিত গ্রাহকের ছবি পরিচয়দানকারী সত্যায়িত করবেন এবং হিসাব খোলার ফরমেও তার স্বাক্ষর, হিসাব নম্বর, শাখার নাম, মোবাইল নম্বর, প্রভৃতি তথ্য প্রদান করবেন। বিশেষ প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য একজন ব্যক্তিকেও মনোনীত করতে হয়।

নমিনি: ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৩ ধারায় বর্ণিত নির্দেশনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে আমানতকারী/আমানতকারীদের মৃত্যুর পর তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রক্ষিত আমানতের অর্থ তার/তাদের মনোনীত নমিনি/নমিনিরাই পাবেন। তাই হিসাব খোলার সময় গ্রাহককে এক বা একাধিক নমিনি মনোনীত করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে শুধু ব্যক্তিক হিসাবেই (একক ও যৌথ উভয় হিসাবে) নমিনি লাগে, অ-ব্যক্তিক (প্রাতিষ্ঠানিক) হিসাব খুলতে নমিনি লাগে না। নমিনির এক কপি ছবি (হিসাবধারী কর্তৃক সত্যায়িত) ও পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিতে হবে। হিসাব খোলার ফরমে নমিনিরও স্বাক্ষর প্রদান করার বিধান আছে, কিন্তু তা ঐচ্ছিক। নাবালক কাউকে নমিনি দিতে চাইলে নাবালক নমিনির পক্ষে একজন আইনগত অভিভাবকও মনোনীত করতে হবে এবং সেই অভিভাবকেরও পরিচিতিসংক্রান্ত কাগজপত্র, যেমন ছবি ও পরিচয়পত্রের ফটোকপি সরবরাহ করতে হবে।

আরও দেখুন:
ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির আমানত কে পাবে?
ব্যাংক গ্রাহকের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ও নমিনী কর্তৃক টাকা উত্তোলনের নিয়ম
মৃত ব্যক্তির হিসাবে গচ্ছিত টাকা কে পাবে নমিনী নাকি ওয়ারিশ?

প্রাথমিক জমা: ‘স্যার, অ্যাকাউন্ট করতে কত টাকা লাগে?’ অনেক ভাবী গ্রাহকেরই প্রশ্ন। কথাটা শুনলে মনে হয় যে, নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে প্রাথমিক যে টাকাটা জমা রাখা হয়, তা ব্যাংকের কমিশন। তাই বিষয়টা স্পষ্ট করা দরকার। আসলে অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যাংককে কোনো কমিশন দিতে হয় না। আপনি টাকা রাখার বা জমানোর উদ্দেশ্যেই অ্যাকাউন্ট খুলছেন। তাই আপনার অ্যাকাউন্টে ইচ্ছামতো আপনার পেশা ও আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিংবা বৈধ উৎসের যত খুশি টাকা রাখতে পারেন। তবে ব্যাংকে প্রাথমিক একটা অঙ্ক জমা দিয়েই হিসাব খুলতে হয়; কিন্তু তা ব্যাংক নির্দেশিত সর্বনিম্ন অঙ্কের কম হলে ব্যাংক হিসাব খুলতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। আর সঞ্চয়ী হিসাবে প্রাথমিক সে জমাটা সাধারণত পাঁচশ বা হাজার টাকার বেশি নয়। তবে কৃষক, মুক্তিযোদ্ধা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সব শারীরিক প্রতিবন্ধী, পথশিশু ও কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের হিসাব কেবল ১০ টাকা, স্কুল ব্যাংকিং হিসাব মাত্র ১০০ টাকা এবং অনিবাসী প্রবাসী বাংলাদেশিদের হিসাব কোনো প্রাথমিক জমা ছাড়াই খোলা যায়।

নাবালকের হিসাব: আইনি জটিলতার কারণে ব্যাংক সাধারণত নাবালকের ব্যাংক হিসাব খুলতে চায় না। তবে নিতান্তই যদি কেউ নাবালকের হিসাব খুলতে চান, তবে নাবালকের সাবালক হওয়ার আগ পর্যন্ত হিসাবটি নাবালকের আইনগত কোনো অভিভাবক দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। এক্ষেত্রে নাবালক ও আইনগত অভিভাবক উভয়কেই পরিচিতি-সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দিতে হবে। নাবালক অ্যাকাউন্টের গ্রাহকের বয়ঃপ্রাপ্তির (প্রাপ্তবয়স্ক) সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের অ্যাকাউন্ট পরিচালনার অধিকার স্থগিত হবে এবং অ্যাকাউন্ট স্থিতির অর্থের একমাত্র বৈধ অধিকারী হবে সেই নাবালক গ্রাহক যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। বর্তমানে স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের জন্য ব্যাংক ‘স্কুল ব্যাংকিং’ হিসাব খুলছে। নাবালকের হিসাবের নিয়মগুলো মেনে ১৮ বছরের কম বয়স্ক শিক্ষার্থীরা স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় হিসাব খুলতে পারে। এক্ষেত্রে পরিচিতিসংক্রান্ত কাগজপত্রের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র/সর্বশেষ মাসের বেতন রশিদের সত্যায়িত অনুলিপিও দিতে হবে। হিসাবধারী সাবালকত্ব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে হিসাবধারীর ইচ্ছা অনুসারে এই হিসাবটি স্বাভাবিক সঞ্চয়ী হিসাব হিসাবে চলমান রাখা যাবে।

টিপি: ব্যাংক তার গ্রাহকের হিসাবে লেনদেনের অনুমিত মাত্রা (Transaction Profile•TP) সম্পর্কে গ্রাহকের ঘোষণা নির্ধারিত ফরমে সংগ্রহ করে থাকে। টিপির ক্ষেত্রে গ্রাহককে মনে রাখতে হবে, টিপিতে মাসিক লেনদেনের আনুমানিক ঘোষণা নেওয়া হয়। এটি স্থায়ী বা অপরিবর্তনশীল কোনো ব্যবস্থা নয়। গ্রাহকের আয় ও লেনদেনের পরিবর্তনের সঙ্গে টিপিও পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে। তবে ঘোষিত টিপির অতিরিক্ত লেনদেন কম্পিউটার অ্যালাউ করবে না, যেমন টিপিতে যদি বলা থাকে যে, মাসে পাঁচবার নগদ জমা হবে, তাহলে ষষ্ঠবার নগদ জমা দিতে গেলেই কম্পিউটার জমাটি অ্যালাউ করবে না। ঠিক একইভাবে যদি বলা থাকে যে, সর্বোচ্চ একক জমা পাঁচ লাখ টাকা হবে, তাহলে পাঁচ লাখ এক টাকা জমা দিতে গেলেই কম্পিটার তা আটকে দেবে। তাই হিসাব খোলার সময় নিজের আয় ও পেশার সঙ্গে সংগতি রেখে মাসিক সম্ভাব্য জমা এবং উত্তোলনের ঘোষণা দেওয়া উচিত।

ফ্যাটকা (FATCA): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর দেন এমন কোনো ব্যক্তির (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক/গ্রিন কার্ডধারী/বৈধ নিবাসী) বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সত্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশে কার্যরত কোনো ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকলে তার তথ্য মার্কিন কর্তৃপক্ষকে (ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস আইআরএস) জানাতে হয়। দেশটির ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্টের (FATCA) আওতায় এ তথ্য সরবরাহ করতে হয়। তাই গ্রাহকদের নির্ধারিত ফ্যাটকা ফরমে এই সংক্রান্ত ঘোষণা দিতে হয়।

হিসাব নম্বর ও ইউনিক কাস্টমার আইডি: হিসাব খোলার পর প্রত্যেক গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট হিসাব নম্বরের পাশাপাশি একটি ইউনিক আইডি নম্বরও প্রদান করা হয়। পরে কোনো হিসাব খুলতে চাইলে আগের হিসাব নম্বর ও ইউনিক আইডি নম্বর ব্যাংককে সরবরাহ করতে হয়। ডিপিএস বা অন্য কোনো স্কিম হিসাব খুলতে ব্যাংক আরেকটি আলাদা লিংক অ্যাকাউ› খোলে, যে হিসাব থেকে ডিপিএসের কিস্তি বা স্কিম হিসাবের প্রয়োজনীয় জমার টাকা স্থানান্তর (ডেবিট) করা হয়। সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টকে লিংক অ্যাকাউন্ট হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট না থাকলে, ডামি লিংক অ্যাকাউন্ট খুলে নিতে হয়।

গ্রাহক সম্মতিপত্র: সব করপোরেট/প্রোপ্রাইটরশিপ প্রতিষ্ঠানের এক লাখ ও তদূর্ধ্ব মূল্যমানের এবং ব্যক্তি হিসাবের পাঁচ লাখ ও তদূর্ধ্ব মূল্যমানের চেক পরিশোধের ক্ষেত্রে চেকদাতাকে তার ব্যাংকের কাছে অগ্রিম ‘গ্রাহক সম্মতিপত্র’ (Positive Pay Instruction) আবশ্যিকভাবে জমা দিতে হয়। চেকদাতার ব্যাংক (অর্থ পরিশোধকারী ব্যাংক) চেকদাতা গ্রাহকের কাছ থেকে ‘গ্রাহক সম্মতিপত্র’বিহীন চেক ‘advice not received’ কারণ দেখিয়ে ফেরত (return) দিতে পারবে। ‘গ্রাহক সম্মতিপত্র’ গ্রাহক কয়েকভাবেই দিতে পারেন, যেমন ব্যাংকের নির্ধারিত ফরমে লিখিত আকারে, গ্রাহকের নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যাংকিং আইডির মাধ্যমে নির্দিষ্ট অপশন ব্যবহার করে, ব্যাংকে প্রদত্ত/সংরক্ষিত গ্রাহকের মোবাইল নম্বর থেকে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় বা কল সেন্টারে ফোন করে।

চেক: গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি ভুল করে থাকেন চেক লিখতে গিয়ে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার মিশ্রণ একটা সাধারণ সমস্যা। তারিখ লিখতে গিয়ে  দিনের ঘরে মাস, কিংবা মাসের ঘরে বছর লিখে ফেলা অহরহ হয়ে থাকে। কথায় ও অঙ্কে লেখা টাকায় অমিল, স্বাক্ষর গড়মিল, কাটাকাটি বা ঘষামাজা, কথার ঘরে অঙ্কে লেখা, বাসি চেক (stale cheque)/মেয়াদোত্তীর্ণ চেক(out-of-date cheque), অগ্রিম/ভবিষ্যৎ তারিখযুক্ত চেক (post-dated cheque) ও পূর্ববর্তী তারিখযুক্ত চেক (ante-dated cheque) উপস্থাপন করার মতো ভুল তো আছেই। Ante-dated cheque হচ্ছে এমন চেক যা লেখা হয়েছে যে তারিখে বা ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তারিখে, তার আগের কোনো তারিখযুক্ত চেক। তবে ante-dated cheque অবৈধ নয়, যতদিন পর্যন্ত না তা বাসি (stale) হয়। একটি চেক তার তারিখ থেকে ছয় মাস অথবা চেকের গায়ে উল্লিখিত মেয়াদ দুটির মধ্যে যেটি কম সেই মেয়াদ পর্যন্ত বৈধ থাকে, এর পর তা বাসি হয়ে যায়। সরকারি অনেক চেকের মেয়াদ তিন মাস উল্লেখ করা থাকে, যার অর্থ হচ্ছে চেকের তারিখ থেকে তিন মাস পর্যন্ত চেকটি বৈধ। ১২ তারিখে উপস্থাপিত চেকের তারিখ ১২ বা তার আগের হওয়া সম্ভব (বাসি না হওয়া পর্যন্ত); কিন্তু অগ্রিম তারিখ, যেমন ১৩ তারিখ হওয়া সম্ভব নয়।

অনেকে চেক অনেক অযত্নে রাখেন। ব্যাংকে অনেক সময় বটে-ফেলা, স্যাঁতসেঁতে ব্যবহার-অযোগ্য চেক উপস্থাপন করা হয়। অনেকেই রঙিন কালি দিয়ে চেক লেখেন। আইনে যদিও কোনো বাধা নেই এবং ওভার-দ্য-কাউন্টার পেমেন্ট দিতে কোনো সমস্যা নেই, তবুও ব্যাংকাররা এই চেকের পেমেন্ট দিতে অস্বীকৃতি জানায়; কারণ এটাই ব্যাংকিং প্র্যাক্টিস। তাছাড়া আন্তঃব্যাংক কালেকশনের সময় ব্যাচ স্ক্যানার এই রঙিন কালি স্পষ্টভাবে স্ক্যান করতে পারে না। বর্তমানে গ্রাহকের এমআইসিআর চেকে ডানপাশে হিসাবধারীর স্বাক্ষরের জন্য নির্ধারিত স্থানে অনুভূমিক রেখার ঠিক নিচেই লেখা  থাকে ‘please sign above this line’। টাকা উত্তোলনের জন্য হিসাবধারী গ্রাহক (চেকদাতা) লাইনটির ওপরের অংশে স্বাক্ষর করবে। অন্যথায় ব্যাংকার চেকটির পেমেন্ট দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। একটি চেকের তিনটি অংশ থাকে প্রথম অংশ (counterfoil) গ্রাহকের চেকবইয়ের সঙ্গে স্থায়ীভাবে থাকবে, দ্বিতীয় অংশটি (token) নগদ গ্রহণের সময় ক্যাশ বিভাগের কর্মকর্তা চেকের বাহকের কাছে চাইবে মূল চেকের (তৃতীয় অংশ) সঙ্গে ক্রস-চেকের (cross-check) জন্য। কোনো ‘বাহক-চেক’ দিয়ে নগদ উত্তোলন না করে যদি প্রাপকের হিসাবে জমা করাতে চান, তাহলে চেকদাতার উচিত চেকটি ‘ক্রসড্’ করে দেওয়া। এতে করে চেকটির নিরাপত্তা জোরদার হয়।

সঞ্চয়ী ও চলতি হিসাবের সুদ: সাধারণত ব্যাংক চলতি হিসাবে কোনো সুদ প্রদান করে না। সঞ্চয়ী হিসাবে তিন-চার শতাংশ হারে বছরে দুবার (জুন ও ডিসেম্বরে) সুদ প্রদান করে থাকে, তবে তা শর্তসাপেক্ষে। যেমন এক. সুদপ্রাপ্তির জন্য জমাগুলো মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে হতে হবে; দুই. কোনো মাসের সুদ হিসাবায়ন করতে ওই মাসের ৬ তারিখ থেকে সর্বশেষ তারিখ পর্যন্ত সর্বনি¤œ স্থিতি বিবেচনা করা হয়; তিন. দৈনিক স্থিতি পাঁচ হাজার টাকার কম থাকলে সংশ্লিষ্ট মাসের জন্য কোনো সুদ প্রযোজ্য হবে না; চার. কোনো মাসে চারবার বা ততোধিক অথবা স্থিতির ২৫ শতাংশ বা ততোধিক টাকা উত্তোলন করলে সংশ্লিষ্ট মাসের জন্য কোনো সুদ গ্রাহক পাবে না; পাঁচ. নোটিস ব্যতিরেকে ৫০ হাজার টাকার অধিক উত্তোলন করলে সংশ্লিষ্ট মাসের জন্য কোনো সুদ প্রযোজ্য হবে না; ছয়. কোনো মাসের প্রাপ্য সুদ ১০০ টাকার নিচে হলেও গ্রাহক ওই মাসের জন্য কোনো সুদ পাবে না।

ডেবিট কার্ড: ডেবিট কার্ড হচ্ছে চেকের বিকল্প। এই কার্ড ব্যবহার করে আপনি এটিএম/সিআরএম বুথ থেকে আপনার হিসাবের নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। তাছাড়া কেনাকাটা, বিল পরিশোধেও এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। সিবিএস ব্যবহার করা সব ব্যাংকই তাদের গ্রাহকদের চেকের পাশাপাশি ডেবিট কার্ডও ইস্যু করে থাকে। তাই হিসাব খোলার পর চেকবইয়ের সঙ্গে আপনার ডেবিট কার্ড ও কার্ডের পিন (PIN) গ্রহণ করতে ভুলবেন না।

চেক রিকুইজিশন: চেক রিকুইজিশন হচ্ছে চেকবইয়ের জন্য গ্রাহকের আবেদন। হিসাব খোলার সময় হিসাব ফরমের সঙ্গেই প্রথম চেক রিকুইজিশন নেওয়া হয়। পরে চেকবইয়ের সঙ্গেই বইয়ের শেষের দিকে রিকুইজিশন পাতাটি সংযুক্ত থাকে। চেকবই নিঃশেষ হওয়ার আগেই ব্যাংকের কাছে রিকুইজিশনটি জমা দিতে হয়, কারণ প্রধান কার্যালয় থেকে মুদ্রিত চেক বই আসতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লেগে যায়। তাই যথাসময়ে আবেদন জমা দিয়ে চেকবই গ্রহণ না করলে টাকা উত্তোলন করতে সমস্যায় পড়তে পারেন। আগে ইস্যু করা চেকবইয়ের অধিকাংশ পাতা অব্যবহৃত থাকলে ব্যাংক গ্রাহককে নতুন চেকবই ইস্যু না করার অধিকার সংরক্ষণ করে। আবেদনের দিন দশেকের মধ্যেই চেকবই গ্রহণ করা উচিত এবং গ্রহণ করার সময় চেক বইয়ের পাতা গুনে নেওয়া উচিত। অন্যদিকে দীর্ঘদিন (যেমন ৬০ দিন বা ততোধিক সময়) কোনো চেকবই অবিলিকৃত (undelivered) থাকলে ব্যাংক তা ধ্বংস করে ফেলে এবং এজন্য গ্রাহকের হিসাব থেকে চার্জ আদায় করা হতে পারে।

চেক হারানো: চেক হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে থানায় জিডি করা হয় না, ব্যাংককে জানানো হয় না। এর ফলে গ্রাহকের হিসাবে জালিয়াতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং দুষ্ট লোকের হাতে পড়লে এই চেক দিয়ে হিসাবধারীর (চেকদাতা) বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারে। তাই চেকবই বা চেকের কোনো পাতা হারিয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংককে লিখিতভাবে অবগত করতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করে জিডির কপি ব্যাংকে জমা প্রদান করতে হবে। পরে নতুন চেকবই ইস্যুর আগে ব্যাংক আপনার কাছ থেকে ইনডেমনিটি বন্ডও নিতে পারে।

মিনিমাম ব্যালেন্স: আপনার হিসাবের সব অর্থই আপনার এবং আপনার ইচ্ছামতোই আপনি তা উত্তোলন করতে পারবেন। তবে চেক ড্র করার সময় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম স্থিতি (মিনিমাম ব্যালেন্স) রেখে তারপর চেক ড্র করবেন। সঞ্চয়ী হিসাবে সাধারণত পাঁচশ/এক হাজার, আর চলতি হিসাবে এক/দুই হাজার টাকা মিনিমাম ব্যালেন্স রাখতে হয়। মিনিমাম ব্যালেন্স বজায় না থাকলে ব্যাংক চেকের পেমেন্ট দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে এবং যেকোনো সময় নোটিস প্রদান ব্যতিরেকে হিসাব বন্ধ করে দিতে পারে।

ইনঅপারেটিভ/ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট: সাধারণত ছয় মাস কোনো একটি হিসাবে লেনদেন না হলে হিসাবটি ইনঅপারেটিভ (inoperative) আর এক বছর লেনদেন না হলে হিসাবটি সুপ্ত (dormant) হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে কোনো কোনো ব্যাংক কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এক বছর আর সেভিংস অ্যাকাউন্টে দুই বছর লেনদেন না হলে তা সুপ্ত  হিসাব বলে গণ্য করে। ব্যাংকভেদে এই সময়কাল ভিন্ন হতে পারে। ইনঅপারেটিভ/ডরমেন্ট অ্যাকাউন্টে কোনো উত্তোলন করা যায় না। তবে গ্রাহকের আবেদন সাপেক্ষে ইনঅপারেটিভ ও ডরমেন্ট হিসাবকে অপারেটিভ করা যায়। এজন্য আপনাকে চার্জ প্রদান করতে হতে পারে। তাই খেয়াল রাখবেন আপনার হিসাবে যেন দীর্ঘদিন লেনদেন বন্ধ না থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনামতে, ২০০২ সালের ৩০ এপ্রিলের আগে খোলা যেসব হিসাবের কেওয়াইসি সম্পন্ন হয়নি, সেসব হিসাবকেও ডরমেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। তবে ১০ টাকায় খোলা কৃষকের হিসাবকে কখনই ইনঅপারেটিভ বা ডরমেন্ট করা যাবে না।

কালেকশন: আপনার হিসাবে কোনো চেক/পে-অর্ডার/ড্রাফট/যেকোনো ইন্সট্রুমেন্ট সংগ্রহের (কালেকশন) জন্য জমা করতে চাইলে অবশ্যই ইন্সট্রুমেন্টের প্রাপকের নামের সঙ্গে আপনার হিসাবের নামের মিল থাকতে হবে। অন্যথায় ব্যাংক এসব ডিপজিট ইন্সট্রুমেন্ট কালেকশনের জন্য গ্রহণ করবে না।

হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ: ব্যাংক বছরে দুবার হিসাবের বিপরীতে হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ (account maintenance fee) আদায় করে। সব হিসাবেই এই চার্জ আদায় করা হয় না। যেসব সঞ্চয়ী হিসাবের গড় ব্যালান্স পাঁচ হাজার টাকার নিচে তাদের হিসাব থেকে কোনো চার্জ আদায় করা হয় না। অন্যদের ক্ষেত্রে এই চার্জ ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। চলতি হিসাব থেকেও বছরে দুবার এই চার্জ আদায় করা হয়। স্কিম ও এফডিআর হিসাব থেকে এ ধরনের কোনো চার্জ আদায় করা হয় না। এছাড়া কৃষকের ১০ টাকার হিসাব, স্কুল ব্যাংকিং হিসাব, মুক্তিযোদ্ধাদের হিসাব, প্রতিবন্ধীদের হিসাব প্রভৃতি হিসাব থেকে এই চার্জ নেওয়া হয় না।

এসএমএস অ্যালার্ট: আপনি যদি এসএমএস (sms) ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করেন, তাহলে আপনার হিসাবে টাকা জমা বা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তা জেনে নিতে পারবেন। আপনার হিসাবে টাকা জমা হলো কি হলো না- এই টেনশন থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং: ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঘরে-বাইরে যেকোনো জায়গায় থেকে যেকোনো সময়ে আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজস্ব আইডি ব্যবহার করে আপনার হিসাবের ব্যালেন্স চেক, মিনি স্ট্যাটমেন্ট জেনারেট, অন্য কারও হিসাবে টাকা ট্রান্সফার করতে পারবেন।

ডিপোজিট স্লিপ: অনেক অসচেতন কিংবা অল্প শিক্ষিত গ্রাহক ডিপজিট স্লিপ আর চেকের মধ্যে গোল পাকিয়ে ফেলেন- কোনটা দিয়ে টাকা তুলতে হয়, আর কোনটা দিয়ে টাকা জমা দিতে হয়, তা বোঝেন না। Deposit Slip ব্যবহার করা হয় হিসাবে টাকা জমা দিতে, আর Cheque ব্যবহার করা হয় টাকা উত্তোলন করতে।

আন্তঃব্যাংক লেনদেন: একই ব্যাংকের আন্তঃশাখা অনলাইন লেনদেনের পাশাপাশি বর্তমানে আরটিজিএস (RTGS) এবং বিইএফটিএনের (BEFTN) মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবেই আন্তঃব্যাংক লেনদেন সম্ভব হচ্ছে। আরটিজিএসের মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্য ব্যাংকে এক লাখ বা ততোধিক অঙ্কের টাকা পাঠানো যাচ্ছে। অন্যদিকে বিইএফটিএনের মাধ্যমে দুই কার্যদিবসের মধ্যেই অন্য ব্যাংকে যেকোনো অঙ্কের টাকা টাকা পাঠাতে পারবেন।

হিসাবের বিবরণী: বছরে দুইবার জুন ও ডিসেম্বর মাসে গ্রাহক বিনা খরচে তার হিসাবের বিবরণী নিতে পারবেন। অন্যসময় নিজের চাহিদামতো নিতে চাইলে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে। তবে বিবরণী গ্রহণ করার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (যেমন ১৪ দিন/৩০ দিন) লিখিত কোনো অভিযোগ না পেলে হিসাবের স্থিতি সঠিক আছে বলে ধরে নেওয়া হবে।

নিরক্ষর ব্যক্তির হিসাব: ব্যাংকে হিসাব খোলার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, গ্রাহককে নিজের নাম স্বাক্ষর করতে জানতে হবে। তবে সুবিধাবঞ্চিত নিরক্ষর গ্রাহকরা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে হিসাব খোলা ও চেক সম্পাদন করতে পারবেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে আলাদা নির্দেশনা প্রদান করেছে।

মৃত ব্যক্তির হিসাব: মৃত ব্যক্তির হিসাবের সমুদয় অর্থ হিসাবধারীর মনোনীত নমিনিই পাবেন। তবে নমিনি মনোনীত করা না থাকলে ওয়ারিশরা যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন সাপেক্ষে হিসাবের অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। তবে মৃত ব্যক্তির হিসাবেও হিসাব বন্ধের আগ পর্যন্ত বা হিসাবের মেয়াদ পর্যন্ত নির্ধারিত হারে সুদ প্রাপ্য হবে। হিসাবধারী মৃত্যুবরণ করলে নমিনির দায়িত্ব হচ্ছে যথাযথ প্রামাণিক কাগজপত্রসহ (মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশসনদ প্রভৃতি) ব্যাংককে লিখিতভাবে অবগত করা এবং অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

চেক ডিজঅনারকরণ: যদি কোনো চেকদাতার বিরুদ্ধে তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আপনি কোনো চেক ডিজঅনার করাতে চান, তাহলে স্বাভাবিক নিয়মে চেকটিকে জমাস্লিপসহ আপনার ব্যাংকে জমা করুন, অথবা চেকদাতার ব্যাংকে নগদ গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করুন। ডিজঅনার করানোর পর, ডিজঅনার মেমো গ্রহণ করবেন এবং মামলা-মোকদ্দমা করলে সাক্ষ্য প্রদানের দিন ধার্য হলে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, যাতে করে আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের সময়ে ব্যাংক কর্মকর্তা (চেক ডিজঅনারকারী) হাজির থাকতে পারেন।

এফডিআর: এফডিআর করার সময় আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনার এফডিআর’টির মেয়াদান্তে স্বয়ংক্রিয় নবায়নের নির্দেশনাও আপনাকে দিয়ে রাখতে হবে, অন্যথায় আপনি বঞ্চিত হতে পারেন। এও মনে রাখতে হবে যে, আপনার এফডিআর’টি যখন নবায়ন হবে, নবায়নকালে ব্যাংকের কার্যকর সুদহার (prevailing interest rate) পাবেন, যা বর্তমান সুদহারের সমান, কম বা বেশিও হতে পারে। মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়ন (উত্তোলন) করলে আপনি কী হারে সুদ/মুনাফা পাবেন, তাও জেনে নেবেন।

মেয়াদি স্কিম: মেয়াদি স্কিম যেমন- ডাবল বেনিফিট হিসাব, মাসিক মুনাফাভিত্তিক হিসাব, এমনকি ডিপিএস হিসাবের মেয়াদ পূর্তির পর অতিরিক্ত সময়ের জন্য আপনি আর সুদ নাও পেতে পারেন। তাই মেয়াদান্তে এসব স্কিম হিসাব চালু না রেখে বন্ধ করে দিয়ে প্রয়োজন মনে করলে নতুন স্কিম হিসাব খুলে নেবেন।

আয়কর ও আবগারি শুল্ক: ব্যাংকে জমাকৃত টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ পাবেন, এটি সব আমানতকারীরই প্রত্যাশা। কিন্তু লভ্যাংশের বিপরীতে আয়কর ও হিসাবের স্থিতির বিপরীতে আবগারি শুল্ক পরিশোধে কেউই যেন প্রস্তুত নন। তাই আমানতকারীরা অহরহ তর্কে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকারদের সঙ্গে। আমানতের বিপরীতে প্রাপ্ত লভ্যাংশের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান করতে হয়। টিআইএনধারী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে আয়করের হার ১০ শতাংশ। মনে রাখতে হবে, পাঁচ শতাংশ আয়কর রেয়াত পেতে গ্রাহককে অবশ্যই ব্যাংকে তার আয়কর সনদ জমা দিতে হবে। অন্যদিকে হিসাবের সর্বোচ্চ স্থিতি বিবেচনায় বছরে একবার আবগারি শুল্ক কর্তন করা হয়। আয়কর ও আবগারি শুল্ক ব্যাংকের কোনো আয় নয়; এটি সরকারি রাজস্ব যা ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করে।

অদাবিকৃত আমানত: ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ৩৫ ধারাবলে ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব মেয়াদ পর্যন্ত কোনো হিসাবে লেনদেন না হলে (মেয়াদি/স্কিম হিসাবগুলোর ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের পর ১০ বছর) হিসাবটি অদাবীকৃত বলে গণ্য করে ওই হিসাবের স্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।

হিসাব বন্ধকরণ: ব্যাংক অথবা গ্রাহক কর্তৃক কোনো কারণে হিসাব বন্ধ করা হলে গ্রাহক অবশ্যই অব্যবহৃত চেক বই, এটিএম কার্ড (যদি থাকে) ব্যাংকের কাছে ফেরত দেবে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত তালিকা অনুসারে নির্ধারিত হিসাব বন্ধকরণ ফি প্রযোজ্য হবে। ব্যাংক তার নিজের বিবেচনায় সন্তোষজনক নয়, এমন অ্যাকাউন্ট যে কোনো সময়ে একক সিদ্ধান্তে বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।

হিসাবধারী গ্রাহক ছাড়া অন্যান্য গ্রাহক: ব্যাংক শুধু তার হিসাবধারী গ্রাহককেই সেবা দেয়, এমনটা নয়। হিসাবধারী গ্রাহক ছাড়া গ্রাহকরাও (walk-in customers) ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন, তবে নিজের পরিচিতি এবং লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে। হিসাবধারী গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও অনুরোধে টিটি, এমটি ও অনলাইনের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে অর্থ প্রেরণকারী এবং প্রাপকের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তথ্য (জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/ড্রাইভিং লাইসেন্স/গ্রহণযোগ্য পরিচিতিমূলক ছবিযুক্ত আইডি কার্ড, ফোন/মোবাইল নম্বর প্রভৃতি), অর্থ প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং অর্থের উৎসের তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়। ডিডি বা পে-অর্ডার ইস্যুর ক্ষেত্রেও আবেদনকারী ও বেনিফিশিয়ারির পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তথ্য, অর্থ প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং অর্থের উৎসের তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়। অনলাইন চেকের বাহক যদি হিসাবধারী না হন, তবে তার কাছ থেকেও জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/ড্রাইভিং লাইসেন্স/গ্রহণযোগ্য পরিচিতিমূলক ছবিযুক্ত আইডি কার্ড, ফোন/মোবাইল নম্বর প্রভৃতি সংগ্রহ করতে হয়।

হিসাব খোলার আগে হিসাব ফরমের শর্তাদি অবশ্যই ভালোভাবে পড়বেন এবং আপনার ব্যাংকারের কাছ থেকে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে তারপর হিসাব খুলবেন। এছাড়া যেকোনো সেবার বিষয়ে ব্যাংকারের পরামর্শের পাশাপাশি ব্যাংকের গ্রাহক নির্দেশিকা, সার্কুলার পড়ে দেখতে পারেন এবং প্রয়োজনে ব্যাংকের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন, যেখানে ব্যাংকের সব পণ্য ও সেবার বিষয়ে বিশদ ধারণা দেওয়া থাকে। (সূত্রঃ দৈনিক শেয়ার বিজ)

লেখকঃ ব্যাংকার

একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button