অর্থনীতিক্ষুদ্রঋণ

ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতা ও সুদ প্রসঙ্গে

ক্ষুদ্র ঋণের কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। এই বিতর্ক শুধু এই ঋণের ওপর আরোপিত সুদকে কেন্দ্র করেই নয় বরং দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানে এর ভূমিকা নিয়েও আবর্তিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা বাংলাদেশে একটি অনন্য উদ্ভাবন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে এবং এই উদ্ভাবনের ‘জনক’ হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন।

বাংলাদেশে মোট ৭২৯টি এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বৃহৎ এনজিও বিশেষ করে আশা, প্রশিকা ও ব্রাক এই খাতের মোট ঋণের তিন চতুর্থাংশ লেনদেনের সাথে জড়িত। আবার বিশেষায়িত ও আনুষ্ঠানিক খাতে গ্রামীণ ব্যাংক ও পিকেএসএফ ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম বহৎ যোগানদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারি বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর-দফতরসমূহ ও দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানমূলক কাজকর্মের অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং এ যাবত সারাদেশে তাদের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ও ৩ কোটি বিত্তহীনপরিবার। এই অবস্থায় ক্ষুদ্র ঋণের কার্যকারিতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তা সঠিক বিবেচনার দাবিদার।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

আমরা আগেই বলেছি যে, ক্ষুদ্র ঋণের অবদান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই বলেছেন যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের কোনও ভূমিকা নেই এবং প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্যকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। এই ঋণের সুদের হার নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে। তবে এর ফলে আসল সমস্যার কোনও সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না। এর কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য একটি নিরপেক্ষ সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন বলে আমাদের ধারণা। দরিদ্ররা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারে না অথবা জামানত ছাড়া ঋণ দিলে সে ঋণ ফেরত আসে না বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ প্রচলিত এই ধারণাগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। দেখা গেছে যে সুদ ও সার্ভিস চার্জের হার মাত্রাতিরিক্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর আদায়ের হার শতকরা ৯৫ ভাগ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঋণের সুদের হার বেশি হওয়া সত্ত্বেও আদায়ের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।

তবে এর অর্থ এই নয় যে ক্ষুদ্র ঋণ অত্যন্ত লাভজনক। এই ঋণ নিয়ে কেউ ধান ভানে, কেউ চিড়া মুড়ি তৈরি করে বিক্রি করে। কেউ গরু ছাগল পোষে। আবার কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসার ন্যায় আত্মকর্মসংস্থান মূলক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে দু’চার পয়সা রোজগারের চেষ্টা করে, পুঁজি না হলে যা করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হতো না। এ প্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানে ক্ষুদ্র ঋণের কোনও ভূমিকা নেই এ কথা বলা সঠিক নয়। তবে এই ঋণ যখন শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয় তখনি আমরা একে আপত্তিকর বলে মনে করি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এই ঋণের সুদের হার ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, এই ঋণ থেকে উপকার পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহিতাকে তা বিনিয়োগ করে অন্তত তার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ মুনাফা অর্জন করতে হবে। এটা করতে পারলেই সে নিজের শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক বাবদ কিছু অর্থ উপার্জন করে সংসার চালাতে পারলেই এই ঋণ ফলপ্রসূ হতে পারে। তা না পারলে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে হয় অথবা এক এজেন্সির ঋণ শোধ করার জন্য অন্য এজেন্সি থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।

ঋণ আদায়ে এনজিওসমূহের অমানবিক আচরণ এই প্রবণতাকে আরো বেগবান করছে। আমরা মনে করি শুধু চড়া সুদই ক্ষুদ্র ঋণের প্রধান সমস্যা নয়। সুদ কষার পদ্ধতিও এখানে একটি বড় সমস্যা। প্রচলিত মহাজনী ব্যবস্থায় face value পদ্ধতিতে যে সুদ কষা হয় তাতে সুদের নির্ধারিত হারের তুলনায় আদায়কৃত তথা কার্যকরী হার প্রায় দ্বিগুণ। কেননা এতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে সুদ কষার সময় আসল থেকে পরিশোধিত কিস্তি বাদ দেয়া হয় না।

আবার দৈব দুর্বিপাকে কোনও একটি কিস্তি পরিশোধে যদি কেউ ব্যর্থ হন তাহলে তার ওপর দন্ডসুদ আরোপ করা হয়। এতে অনেক সময় দেখা যায় যে, অভিহিত সুদের হার ১৫ শতাংশ হলেও বছর শেষে আদায়কৃত সুদের হার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০% থেকে ৪০% পর্যন্ত উন্নীত হচ্ছে। আবার দেখা গেছে যে, অনেক ঋণ গ্রহিতা হয়তো গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ কিংবা মৎস্য চাষ প্রভৃতি কাজে ঋণ নিয়েছেন যা বিনিয়োগ করে তাৎক্ষণিক মুনাফা অর্জিত হচ্ছে না কিন্তু তাদেরকে প্রতি সপ্তাহে সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণের এই দিকটি বিত্তহীনদের স্বার্থের অনুকূল নয়। এর পরিশোধ ব্যবস্থা আয়ের সাথে সংগতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়।

তেমনিভাবে এর সুদ বা সার্ভিস চার্জের হারও বাস্তব অবস্থার সাথে সংগতিশীল হওয়া প্রয়োজন। একথা অনস্বীকার্য যে, ঋণ দানকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল নিয়ে তা বিনিয়োগ করে এবং তাদের এই তহবিল প্রাপ্তি বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাদের এই ব্যয়, সম্ভাব্য মুনাফা এবং প্রশাসনিক ও তদারকী ব্যয়কে সামনে রেখে যদি একটি সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হয় এবং তার ভিত্তিতে উপকারভোগীদের মধ্যে এই ঋণ বিতরণ করা হয় তাহলে সুদের শোষণমূলক প্রভাব থেকে দরিদ্র পরিবারগুলো বাঁচতে পারে বলে আমাদের ধারণা। এছাড়াও বীমা ও সংহতি তহবিল এবং বাধ্যতামূলক সঞ্চয় বাবদ যে অর্থ এনজিওগুলো তাদের ঋণ গ্রহিতাদের কাছ থেকে কেটে রাখে তাও বন্ধ করা দরকার বলে আমরা মনে করি। কেননা এই অর্থ প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনও কাজে আসে না বরং ঋণ থেকে কেটে রাখার ফলে এতে তাদের ক্ষতিই হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button