ব্যাংকিং প্রফেশনাল এক্সাম

পদোন্নতিতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মাহফুজুর রহমানঃ গত ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (আইবিবি) আয়োজিত ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা পাস করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের প্রতিটি (অফিসার ও সমমানের পদ থেকে প্রধান নির্বাহীর অব্যবহিত নিচের এক স্তর ছাড়া অন্য সব কর্মকর্তার বেলায় প্রযোজ্য) পদে পদোন্নতির নীতিমালায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার বিপরীতে নম্বর বরাদ্দ রাখার পরামর্শ প্রদান করেছিল।

সার্কুলারে আরও পরামর্শ প্রদান করা হয় যে, এই নম্বর নির্ধারিত করে দেওয়ার বিষয়টি নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনসাপেক্ষ হতে হবে। কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারেই উল্লেখ করেছিল যে, দুই পর্বের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা আয়োজন করার মূল উদ্দেশ্য হলো, ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট মৌলিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ব্যাংকারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তা ছাড়া ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা ব্যাংকিং সংক্রান্ত জ্ঞান লাভের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদের পেশাগত উৎকর্ষ অর্জনেও সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারে উল্লেখ করে। আর এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই ব্যাংকিং খাতে অধিকতর দক্ষ ও প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা তৈরির লক্ষ্যে পদোন্নতি নীতিমালা সংশোধন করে ডিপ্লোমা পাশের বিপরীতে নম্বর যুক্ত করার জন্য পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক চায় না ব্যাংকার্স ওয়েলফেয়ার

চলতি মাসের ৮ তারিখে ইস্যুকৃত সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে, ব্যাংকিং আইন ও নিয়মাচার অনুশীলন সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার একটি মানদণ্ড হলো আইবিবি পরিচালিত দুপর্বের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন। তাদের মতে, ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার পাঠ্যক্রম ব্যাংকিংবিষয়ক যাবতীয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অন্তর্ভুক্তকরণপূর্বক প্রণীত হয় এবং প্রথম পর্ব পরীক্ষায় ব্যাংকিং সম্পর্কিত প্রাথমিক ও মৌলিক জ্ঞান এবং দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষায় উচ্চতর ব্যাংকিং জ্ঞান ও দক্ষতা যাচাই করা হয়। এ বিবেচনাতেই ব্যাংকিং ডিপ্লোমার উভয় পর্ব পাস করে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনকে পদোন্নতির জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশে কর্মরত সব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দক্ষ ও যোগ্য পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় আইবিবি। প্রতিষ্ঠানটি একটি মনোনীত কাউন্সিল বা পরিষদের দ্বারা পরিচালিত হয়; কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব হিসেবে সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কোনো ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কাজ করে থাকেন। বর্তমানে প্রতিবছর জুন ও ডিসেম্বর মাসে ডিপ্লোমা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বের পরীক্ষায় রয়েছে ৬টি বাধ্যতামূলক বিষয়। এগুলো হচ্ছে : আর্থিক পরিষেবার হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসায় যোগাযোগ, ব্যাংকিং আইন ও প্রয়োগ, আর্থিক পরিষেবা বিপণন, সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতির মূলনীতি ও বাংলাদেশের অর্থনীতি। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষায় রয়েছে ৫টি বাধ্যতামূলক ও ৬টি ঐচ্ছিক বিষয়। এই ৬টি ঐচ্ছিক বিষয়ের ভেতর থেকে যে কোনো একটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে : আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ কার্যক্রম এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিময়, আর্থিক সেবায় তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ও মূলনীতি, কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণ, এসএমই ও ভোক্তা ব্যাংকিং, ইসলামি ব্যাংকিং, বিনিয়োগ ব্যাংকিং ও লিজ অর্থায়ন এবং কোষাগার ব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশ ব্যাংক আকস্মিকভাবেই ডিপ্লোমা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াকে পদোন্নতির জন্য বাধ্যতামূলক করায় ব্যাংকারদের অনেকেই হতাশ হয়েছেন। ব্যাংকারদের কারও কারও মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো বিশেষ কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাদের মতে, ডিপ্লোমা পরীক্ষার ফলাফলকে ব্যাংকিং বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড বিবেচনা করায় সবার সামনে দুটি প্রশ্ন চলে আসে। এগুলো হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের সর্বোচ্চ ব্যক্তি (গভর্নর) কখনই ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারী ছিলেন না এবং থাকা সম্ভবও নয়। আবার অনেকগুলো ব্যাংকের সফল ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারী নন। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড বিবেচনায় তারা কি অযোগ্য? নিশ্চয়ই নন।

একটি দৈনিক পত্রিকা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, আইবিবির আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আইবিবির কাউন্সিল সদস্যরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করেন। এই নির্দেশনার ফলে ব্যাংকে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেছেন এবিবির একজন সাবেক চেয়ারম্যান।

ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কোনো অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আমি মনে করি না। তবে ব্যাংকারদের সার্বিক অবস্থার বিবেচনায় কোনোরকম সহযোগিতা বা আয়োজন ছাড়া এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ যথাযথ হয়েছে বলে মনে হয় না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তাই মফস্বলে, গ্রামে, চরে, দ্বীপে অবস্থান করে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছেন। গ্রামের বাসিন্দা এসব ব্যাংক কর্মকর্তারা দিনের অধিকাংশ সময় আমানত সংগ্রহসহ নানাবিধ টার্গেট অর্জনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। বর্তমানে ব্যাংকিং হচ্ছে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক একটি পেশা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বা ব্যাংকের মালিক পক্ষের নির্দেশনা পালনে বা টার্গেট অর্জনের সব দায়িত্ব পালন করে নিশ্চিন্ত মনে পড়াশোনা করার সুযোগ তাদের খুব কম। তা ছাড়া ব্যাংকারদের কাছে প্রয়োজনীয় বইপুস্তক সরবরাহ করা হয় না। যারা গ্রামগঞ্জে থাকেন তাদের পক্ষে পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় বইপুস্তক পাওয়াও কঠিন।

এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাস করার বাধ্যবাধকতা ব্যাংক কর্মকর্তাদের হতাশ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় ডিপ্লোমা পাসের জন্য প্রয়োজনীয় বইপুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সবগুলো ব্যাংককে নির্দেশনা প্রদান করত তা হলে সেটা অনেকটা সাহায্য করত পরীক্ষার্থীদের। অন্যদিকে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো পড়াশোনা করলেই পাস করা খুব সহজ নয়। যেমন হিসাববিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিময়। বাণিজ্য বিভাগ থেকে পাস করা ছাত্র ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করে ব্যাংকে যোগদান করে থাকেন। এদের পক্ষে কারও সাহায্য ছাড়া হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া প্রায় অসম্ভব। আইবিবির আয়োজনে ঢাকায় এই দুটি বিষয়ে পরীক্ষার আগে কিছুদিন ক্লাস হয়। কিন্তু ঢাকার বাইরে যাদের অবস্থান তাদের পক্ষে এসব ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

দক্ষতা অর্জনের আর একটি উপায় হচ্ছে প্রশিক্ষণ। ব্যাংকিং খাতের প্রায় সবগুলো ব্যাংকই প্রশিক্ষণের বিষয়ে উদাসীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে দেশের প্রতিটি ব্যাংকই নিজস্ব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করেছে। কিন্তু এসব ইনস্টিটিউটের অনেকগুলোতেই প্রশিক্ষণের চাহিদা অনুসারে প্রশিক্ষণ প্রদানের সামর্থ্য বা যোগ্যতা নেই। জনবল মেধাগতভাবে উন্নীত করার জন্য এসব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। এ ছাড়া দেশে প্রাইভেট সেক্টরে যাতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সে লক্ষ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ভূমিতে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো অজ্ঞাত কারণে এই উদ্যোগ স্তিমিত হতে হতে সম্ভবত নিভে গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য হতে পারত একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ।

এরূপ অবস্থায়, বাস্তবতার আলোকে সবগুলো দিক খেয়াল রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখকঃ মাহফুজুর রহমান: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button