বিবিধ

ঈদ মুবারক (ঈদ-উল-আযহা ও কুরবানির ইতিহাস)

আসছে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা৷ একটি পশু কুরবানির সাথে সাথে মনের পশুকেও কুরবানি দিতে হবে৷ একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের এই পবিত্র ও মহান আত্মত্যাগের মর্ম বুঝতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী-

قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
আপনি বলুনঃ নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।
“Verily, my Salat (prayer), my sacrifice, my living, and my dying are for Allah, the Lord of the ‘Alamin (mankind, jinns and all that exists). (Sura Al-An’am, Ayah 162)

সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের মন সম্পর্কে ভালো জানেন। আল্লাহ আমাদের কুরবানি কবুল করুন৷ আমিন৷ সবাইকে ঈদ মুবারক

কুরবানির সঠিক নিয়ম কানুন ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমরা অনেকেই অনেক কিছু জানি না৷ কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে কুরবানির সঠিক নিয়ম কানুন ও ঈদ-উল-আযহা এর কুরবানি করার যে নিয়ম চালু হয়ে আসছে তার ইতিহাস জানা অতীব জরুরী৷ তো চলুন জেনে নেই ঈদ-উল-আযহা ও কুরবানির ইতিহাস সম্পর্কে৷

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ঈদ-উল-আযহা এর অর্থ
ঈদ-উল-আযহা বা ঈদ-উল-আজহা বা ঈদ-উল-আধহা। ঈদুল আযহা মূলত আরবী عيد الأضحى থেকে এসেছে। আরবী عيد শব্দটির অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব, উদযাপন। ًأضحى শব্দটি اضحية থেকে এসেছে৷ এর অর্থ হলো ত্যাগ, কুরবানি। ঈদ-উল-আযহা এর অর্থ ‘ত্যাগের উৎসব’। ইংরেজীতে একে Festival of Sacrifice বলা হয়। ইসলামের সবচেয়ে বড় দু’টো ধর্মীয় উৎসবের দ্বিতীয় হলো ঈদ-উল-আযহা। এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। এই ঈদকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়।

এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত ঈদুল আযহা’র নামাজ ৬ তাকবীরের সাথে আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী উট, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ আল্লাহর নামে কুরবানি করে। ইসলামী চান্দ্র পঞ্জিকায়, ঈদুল আযহা জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে পড়ে। আন্তর্জাতিক (গ্রেগরীয়) পঞ্জিকায় তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়, সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।

ঈদ-উল-আযহার অন্যান্য নাম
আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় নামগুলো যেমন- বাংলায় কুরবানী ঈদ, জার্মান ভাষায় Opferfest, ওলন্দাজ ভাষায় Offerfeest, রোমানীয় ভাষায় Sărbătoarea Sacrificiului, ও হাঙ্গেরীয় ভাষায় Áldozati ünnep। স্পেনীয় ভাষায় এটি Fiesta del Cordero বা Fiesta del Borrego (দুটিরই অর্থ “মেষশাবকের উৎসব”) নামে পরিচিত। এছাড়া মিশর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে এটি عید البقرة নামে, ইরানে عید قربان (ঈদে কোরবান) নামে, তুরস্কে Kurban Bayramı (“ত্যাগের দিন”) নামে, ত্রিনিদাদে Bakara Eid (বাকারা ঈদ) নামে, মাগরেবে عید الكبير (ঈদুল আকবর) নামে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন Iduladha, Hari Raya Aiduladha, Hari Raya Haji বা কুরবান নামে, ভারত ও পাকিস্তানে عید بکرا (ঈদে বকরা) বা عید بڑی (ঈদে বরি) নামে পরিচিত।

কুরবানির ইতিহাস
কালের পরিক্রমায় হিজরী বর্ষপুঞ্জির পরিসমাপ্তির পর বছরান্তে আমাদের দ্বারপ্রান্তে আগমন করে কুরবানির দিনগুলো। যা সমগ্র মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। যেমন- মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰہِ عَلٰی مَا رَزَقَہُمۡ مِّنۡۢ بَہِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ
অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। যাতে তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” (সূরা হজ্জ ৩৪) মানব জাতির সেই কুরবানির বিধানটি অতীব প্রাচীন।

বস্তুত মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানি হযরত আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল এর দেয়া কুরবানি থেকেই কুরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়। যেমন- পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
وَ اتۡلُ عَلَیۡہِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِہِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ
“হে রাসূল আপনি আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিল। তাদের একজনের কুরবানি কবুল হলো। অন্যজনের কুরবানি কবুল হলো না।” (সুরা মায়েদা ২৭) অবশ্য আমাদের উপর যে কুরবানির বিধান প্রচলিত হয়ে আসছে তা হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর রাহে যে কুরবানি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা দৃষ্টান্তহীন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের কথা। স্বপ্নাদৃষ্ট হলেন আল্লাহর প্রিয় খলিল হযরত ইবরাহীম (আঃ) কুরবানি করতে। তিনি পশু কুরবানি করলেন একটির পর একটি। কিন্তু সে কুরবানি তার প্রতিপালকের নিকট গৃহীত হলো না।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) নির্দেশ পেলেন এমন বস্তু কুরবানি করতে যা তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। কী সেই প্রিয় জিনিস? হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তো স্বীয় পুত্র ইসমাঈল। তবে কি তার মহান প্রভু ইবরাহীম ও হাজেরার পরম আদরের সন্তান ইসমাইল এর কুরবানি চান? আল্লাহর আদেশ ছিল অতি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।

সন্দেহেরও কোন অবকাশ ছিল না তাতে। হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্তম্ভিত না হয়ে আল্লাহর আদেশের কথা পুত্র ইসমাইলকে জানালেন। জবাবে পুত্র ইসমাইল বললেন-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَہُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ
অর্থাৎ “হে আমার প্রিয় পিতা, আপনি যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছেন তা সন্তুষ্টির জন্য আপনি তা পালন করুন। ইনশাল্লাহ্ আপনি আমাকে সবুরকারীদের মধ্যে পাবেন।” (সুরা সাফ্ফাত ১০২) হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) উভয়েই আল্লাহর হুকুম পালনে অবিচল সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। মা হাজেরাও স্বেচ্ছায় আদরের সন্তানকে সাজিয়ে দিলেন।

পিতামাতা পুত্রের আল্লাহর পথের কুরবানির এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই প্রথম। বালক ইসমাইলকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) নিয়ে গেলেন মিনায় (বর্তমান হাজীদের কুরবানির স্থান)। যখন প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করতে উদ্যত হলেন সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রিয় নবীদ্বয়ের আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কুরবানি কবুল করলেন। আনুগত্য ও কর্তব্য পরায়ণতার পুরস্কার স্বরূপ একটি মোটা তাজা পশু (দুম্বা) পাঠিয়ে পুত্রের পরিবর্তে জবাই করার হুকুম প্রদান করলেন।

বস্তুতঃ ইবরাহীম (আঃ) এর পুত্র কুরবানি দেয়ার এ অবিস্মরণীয় ঘটনাকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্যই উম্মতে মোহাম্মদীর উপর তা ওয়াজিব করা হয়। সেই থেকে সারা বিশ্বে ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ঈদুল আযহা তথা কুরবানি এক ঐতিহ্যময় স্থান দখল করে আছে।

ঈদের নামাজ
মুসলিমগণ ঈদুল আযহার নামাজ মসজিদে বা খোলা মাঠে আদায় করে থাকেন। ঈদের নামাজ জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে, সূর্য উদয়ের পর থেকে যোহর নামাজের সময় হবার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে যে কোন সময় আদায় করা হয়ে থাকে। কোন কারণ বশত (উদা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ) নামাজ আদায় করা না গেলে ঈদুল আজহার নামাজ ১২ই যিলহজ্ব পর্যন্ত ঐ সময়ের মধ্যে আদায় করা যাবে। ঈদের নামাজ দুই রাকাত। এটি ওয়াজিব নামাজ। তা জামায়াতের সঙ্গে ছয় অতিরিক্ত তাকবিরের সঙ্গে পড়তে হয়। ঈদের নামাজ শেষে ইমামের জন্য খুৎবা পড়া সুন্নত ও মুছুল্লিদের জন্য খুৎবা শোনা ওয়াজিব।

কুরবানির পশু কুরবানি
ইসলাম মতে ঈদুল আযহার দিনে যার যাকাত দেয়ার সামর্থ্য আছে অর্থাৎ যার কাছে ঈদের দিন প্রত্যূষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ সম্পদ (যেমন জমানো টাকা) আছে তাঁর ওপর ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশু কুরবানি করা ওয়াজীব। ঈদুল আযহার দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী দুইদিন পশু কুরবানির জন্য নির্ধারিত। মুসাফির বা ভ্রমণকারির ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়| ঈদুল আযহার নামাজ শেষে কুরবানী করতে হবে। ঈদুল আযহার নামাজের আগে কুরবানি করা সঠিক নয়।

বাংলাদেশের মুসলিমরা সাধারণত গরু বা খাসী কুরবানি দিয়ে থাকেন। এক ব্যক্তি একটি গরু, মহিষ বা খাসি কুরবানি করতে পারেন। তবে গরুর বা মহিষ এর ক্ষেত্রে সর্বোচচ্চ ৭ ভাগে কুরবানি করা যায় অর্থাৎ ২, ৩, ৫ বা ৭ ব্যক্তি একটি গরু কুরবানিতে শরিক হতে পারেন। কুরবানির খাসীর বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। নিজ হাতে কুরবানি করা ভাল। কুরবানি প্রাণির দক্ষিণ দিকে রেখে কিবলামুখী করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হয়।

সাধারণত আমাদের দেশে কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে ১ ভাগ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এবং ১ ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়। তবে মাংস বিতরণের কোন সুস্পষ্ট হুকুম নেই কারন কুরবানির হুকুম পশু জবেহ্‌ হওয়ার দ্বারা পালন হয়ে যায়। কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ দান করে দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।

ঈদ-উল-আযহা উদযাপন
ঈদের দিন শুরু হয় ঈদের নামাজের জন্য গোছল করে এবং নতুন কাপড় পরিধান করে। সকল মুসলিম ছেলেদের জন্য এই ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা ওয়াজিব এবং মহিলাদের জন্য এই নামাজ সুন্নৎ। মুসলমানরা নামাজের পরে পুরো পরিবার একত্রে সকাল বেলা মিষ্টিজাতীয় খাদ্য দিয়ে নাস্তা করে। সকালের এই নাস্তাতে থাকে নানান ধরনের মিষ্টান্ন। নাস্তা খাবার শেষে মুসলমান পুরুষেরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে কুরবানির প্রস্তুতি নিতে থাকে। কুরবানী শেষে কুরবানীর প্রথানুযায়ী কুরবানীর গোশত গরীব, আত্নীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এ দিনে প্রত্যেক মুসলমান অন্যদের বাড়িতে বেড়াতে যায় আনন্দ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। মুসলিম সমাজে এ উৎসবটি কেবল মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, অন্যান্য ধর্মাবম্বলীরাও অংশগ্রহণ করে উদযাপনে।

হাদীসের আলোকে কুরবানির ফজিলত
কুরবানি করার মধ্যে অনেক ফজীলত রয়েছে। প্রিয় নবী রাসূলে (সা.) হাদীসে ঘোষণা করেছেন- কুরবানির দিন আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কুরবানি করা। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কুরবানি দাতার জীবনের গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ঘোষণা করেছেন যে, কুরবানির পশুর যত পশম থাকে প্রত্যেক পশম বা লোমের পরিবর্তে এক একটি নেকী বা সওয়াব লেখা হয়। (মুসনাদে আহমদ)

যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ
যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ তা হলো- ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু। গরু, মহিষ এবং উট এক হতে সাতজন পর্যন্ত কুরবানি দাতা শরীক হয়ে কুরবানি করতে পারবেন।

কুরবানির পশুর বয়স
যে সকল পশুর দ্বারা কুরবানি করা হবে সেগুলোর বয়সের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে হুকুম হলো ছাগলের বয়স কমপে এক বছর হতে হবে। গরু ও মহিষ এর বয়স কমপে দুই বৎসর হতে হবে। উটের বয়স কমপে পাঁচ বৎসর হতে হবে। দুম্বা ও ভেড়া কমপে এক বছর হতে হবে।

কোন দিন কুরবানি করবেন
জিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ পর্যন্ত তিনদিন কুরবানি করা জায়েজ। এ তিন দিনের যেকোনো একদিন কুরবানি করা জায়েজ হবে। তবে উত্তম হলো প্রথম দিন এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন।

শরীক হয়ে কুরবানি করা
একাধিক ব্যক্তি মিলে এক সাথে গরু, মহিষ, উট দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ হবে। উল্লিখিত পশুতে সর্বোচ্চ সাতজন ব্যক্তি শরীক হতে পারবে। তবে গোস্ত বণ্টনের ক্ষেত্রে অনুমান করে বণ্টন করা যাবেনা। অবশ্যই ওজন করে গোস্ত বণ্টন করতে হবে।

কুরবানির গুরুত্ব
কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগ ও উৎসর্গের দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাই কুরবানি দাতার মূল উদ্দেশ্য হওয়া চাই। কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত বড়- মহান আল্লাহ সেটা দেখবেন না। এজন্য আল্লাহ কুরআনে বলেন-‘কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোস্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া’ (সূরা আল-হাজ্ব)। তাই সকল কুরবানিদাতার এই নিয়্যত হওয়া উচিত, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাকওয়ার সাথে কুরবানি করা।

কুরবানির দোআ ও নিয়ম
انّى وَجهت وجهي للذي فطر السموات و الأرض حنيفا وَمَا أَنَا من المشركينَ إِنْ صلَّتى وَ تُسكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتي لله رب الْعَالَمِينَ لاشريك له وبذالك أمرت وأنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ اللَّهُمْ مَنكَ وَلَكَ
(ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজ হিয়া লিল্লাজি ফাতারাস্ ছামা ওয়াতি ওয়াল আর দ্বা হানিফাও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না ছলাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ ইয়া ইয়া ওমামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। লা-শারীকা লাহু ওয়া বি জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা৷)
তারপর بسم الله الله أكبر (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলে যবেহ করবে৷ এরপর জবেহ করে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবে- اللَّهُمْ تقبله مني كَمَا تَقَبّلت من حبيبك مُحَمَّد وَ خليلك اِبْرَاهيم عليهما الصلوة و السلام
(আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও অখলিলিকা ইব্রাহিমা আলাইহিমাস সালাতু ওয়া আসসালামু)৷
যদি নিজের কুরবানী হয় তবে مني বলবে৷ আর যদি অন্যের বা অন্যদের কুরবানী হয় তবে من শব্দের পরে দাতার বা দাতাদের নাম উল্লেখ করবে৷

যবেহ করার সময় চারটি রগ কাটা জরুরী-
১) কন্ঠনালী
২) খাদ্যনালী
৩) ওয়াজদান অর্থাৎ দুই পাশে দুটি মোটা রগ৷ এগুলোর যেকোন তিনটি যদি কাটা হয় তবুও কুরবানী শুদ্ধ হবে৷ কিন্তু যদি দুটি কাটা হয় তবে কুরবানী শুদ্ধ হবে না৷ যবেহ করার পূর্বে ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়া মুস্তাহাব৷

কুরবানি ও আকীকা
অনেকেই কুরবানির পশুর সাথে নিজের বা সন্তানের আকীকা করে থাকেন। এক্ষেত্রে ছেলের আকীকা হলে দুই নাম এবং মেয়ের আকীকা হলে এক নাম।

কুরবানির পশুর চামড়া
কুরবানির পশুর চামড়া কুরবানি দাতা জায়নামাজ অথবা পানির মশক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া উক্ত চামড়া বিক্রি করে গরিব, মিসকিন, এতিমদের মধ্যে বণ্টন করে দিবেন।

কুরবানির শিক্ষা
কুরবানির মূল শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ। পাশাপাশি বনের পশুর সাথে মনের পশুকে কুরবানি করাই হচ্ছে কুরবানির শিক্ষা। আমাদের মনে পশুত্ব সুলভ যে স্বভাবগুলো রয়েছে কুরবানির সাথে সাথে যদি সেগুলোকে কুরবানি করতে পারি তা হলেই আমাদের কুরবানি সার্থক হবে।

কুরবানি সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসআলা
নিম্নে কুরবানি সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসআলা সমূহ তুলে ধরা হলো-

মাসআলা-০১
ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটা-তাজা হয় যে, এক বছরের অনেকগুলো দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা না যায়, তবে সেরূপ দুম্বার বাচ্চা দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ কিন্তু ছাগলের বাচ্চা এরূপ মোটা তাজা হলেও এক বছর পূর্ণ না হলে কুরবানি জায়েজ হবে না।

মাসআলা-০২
কুরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। যদি সামান্য ত্রুটি থাকে, যেমন কান ছিড়া বা কানে ছিদ্র থাকা ঐ পশু দিয়ে কুরবানি করলে তা মাকরূহ হবে। আর বেশি ত্রুটি থাকলে কুরবানি হবে না। (দুররুল মুখতার ৯ম খণ্ড)

মাসআলা-০৩
পশুর জন্ম থেকে শিং না থাকলে ঐ পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে। তবে জন্মগতভাবে না থাকলে বা এক কান না থাকলে এর দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ হবে না। (আলমগীরী)

মাসআলা-০৪
গাভী কুরবানির পর যদি পেট থেকে জীবিত বাচ্চা পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবেহ করে দিবে এবং সেটা খাওয়া যাবে। আর মৃত বাচ্চা হলে তা ফেলে দিবে।

মাসআলা-০৫
জবেহ করার সময় ৪টি রগ কাটতে হবে বা কমপে তিনটি রগ কাটতে হবে। এর চেয়ে বেশি কাটবে না।

মাসআলা-০৬
কুরবানি যদি নিজের প থেকে হয় তাহলে জবেহ করার পর এই দুআ পড়বে ‘আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন খালিলিকা ইব্রাহীম আলাইহি সালাম ওয়া হাবিবিকা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর যদি অন্য কারো পক্ষ থেকে কুরবানির পশু জবেহ করা হয় তাহলে জবেহকারী ‘মিন্নির স্থলে মিন’ বলে যার কুরবানি করছে তার নাম উচ্চারণ করবে।

মাসআলা-০৭
নিজের কুরবানির পশু নিজে জবেহ করা উত্তম। নিজে না পারলে জবেহ করার নিয়ম জানেন এমন ব্যক্তি দ্বারা পশু জবেহ করাবেন।

মাসআলা-০৮
কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা মসজিদ, মাদরাসা, খানকায় দেয়া যাবে না।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকারের কুরবানি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button