অর্থনীতি

যেভাবে মুদ্রার মান নির্ধারিত হয়

তানজিম হাসান পাটোয়ারীঃ সৌদি আরব প্রবাসী মোঃ ইয়াসিন প্রতি মাসেই তার পরিবারের কাছে টাকা পাঠান। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সৌদি আরবের ১ রিয়াল বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২২.৫৪ টাকার সমান। অন্যদিকে আনোয়ার হোসাইন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন আমেরিকাতে। তবে দেশে মা-বাবা, ভাই-বোন থাকায় তিনিও প্রতি মাসে কিছু অর্থ দেশে পাঠান। তার ক্ষেত্রেও জিনিসটি ব্যতিক্রম নয়। কারণ আমেরিকান ১ ডলারে বাংলাদেশী প্রায় ৮৪ টাকা পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এক দেশের মুদ্রার সাথে আরেক দেশের মুদ্রার এই পার্থক্য দেখা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশী অনেক নাগরিক প্রবাসে কর্মরত থাকায় প্রায় প্রতিমাসেই প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, কিংবা বিদেশে ঘুরতে যাওয়াসহ অনেক কাজেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করি। আর তাই মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

কোনো একটি দেশের মুদ্রা অন্য দেশে গিয়ে কত হবে, তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বে বলা হয়, কোনো একটি দেশের মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের উপর ভিত্তি করে সে মুদ্রার মান নির্ধারিত হবে। যেমন একটি দেশ যখন অন্য দেশ থেকে কোনো জিনিস আমদানি করে, তখন ঐ জিনিসের মূল্য রপ্তনিকারক দেশের মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।

ধরুন, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০০ ডলার মূল্যের গুঁড়া দুধ আমদানি করল। এখন মূল্য পরিশোধের সময় বাংলাদেশকে আমেরিকার মুদ্রায় ১০০০ ডলার পরিশোধ করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই ডলার বাংলাদেশ কোথা থেকে পাবে? আমেরিকান কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশকে প্রথমে ঐ ১,০০০ ডলার ক্রয় করতে হবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

এক্ষেত্রে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ যদি বলে, বাংলাদেশী ৮৪,০০০ টাকা পেলে তারা আমেরিকান ১,০০০ ডলার বিক্রি করবে, তাহলে বাংলাদেশকে প্রথমে ৮৪,০০০ টাকা দিয়ে ১,০০০ ডলার কিনতে হবে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ঐ ১,০০০ ডলার দিয়ে গুঁড়া দুধ আমদানি করবে আমেরিকা থেকে। এখানে প্রত্যেক মার্কিন ডলারের মূল্য দাঁড়াবে ৮৪ বাংলাদেশী টাকায়।

যখন কোনো একটি দেশ অন্য দেশের উপর প্রচুর মাত্রায় আমদানি নির্ভর হয়ে যায়, তখন আমদানিকারক দেশের মুদ্রার মান ক্রমশ কমতে থাকে। আবার যদি উল্টোটি হয়; অর্থাৎ, কোনো দেশ প্রচুর পরিমাণ জিনিস বিদেশে রপ্তানি করে, তাহলে রপ্তানিকারক দেশের মুদ্রার মান ক্রমশ বাড়তে থাকবে। আর এভাবে মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের উপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়।

তবে রপ্তানি ছাড়াও আরো কিছু কারণে কোনো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে পারে। এর মধ্যে ফরেন রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, আমদানি হ্রাস ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবার যদি কোনো দেশে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে, তাহলেও ঐ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়, যা মুদ্রার মান নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

অন্যদিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত রিজার্ভের কারণে ঐ মুদ্রার বিক্রয়মূল্য কমে যেতে পারে। কারণ আমরা জানি, চাহিদা অপেক্ষা যোগানের পরিমাণ বেশি হলে জিনিসের দাম কমে যায়।

ক্রয় ক্ষমতার সমতা তত্ত্ব বা ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি)’ তত্ত্ব নামে ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট’ তত্ত্বের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় রয়েছে, যা মুদ্রার মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এটি দু’টি দেশের দ্রব্যমূল্যের সাথে জড়িত। যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশে একটি বার্গারের দাম ১৬৮ টাকা হলে আমেরিকায় সেটি ২ ডলার।

এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশী ১৬৮ টাকা = আমেরিকান ২ ডলার। প্রতি ডলারের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৮৪ টাকা করে। সাধারণত ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট’ তত্ত্বের মাধ্যমে মুদ্রার মান নির্ধারণ করার পর ক্রয়ক্ষমতার সমতা তত্ত্বের মাধ্যমে সেটির বিশুদ্ধতা যাচাই করা হয়।

উপরিউক্ত জনপ্রিয় দুই পদ্ধতি ছাড়াও আরো দু’টি পদ্ধতি আছে, যেগুলো আগে একসময় মুদ্রার মান নির্ধারণে ব্যবহৃত হত। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বের আলোকে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা রেখে তার বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা ছাপাত। যেমন, বাংলাদেশ ১ ভরি স্বর্ণ জমা রেখে তার বিপরীতে ৮৪,০০০ টাকা ছাপায়।

আবার, আমেরিকায় ১ ভরি স্বর্ণ জমা রেখে ১,০০০ ডলার ছাপানো হয়। তাহলে বাংলাদেশী ৮৪,০০০ টাকার মান হবে আমেরিকান ১,০০০ ডলারের সমান। আর প্রতি ডলারের মান হবে ৮৪ বাংলাদেশী টাকা। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এ পদ্ধতিটি মুদ্রার মান নির্ধারণে ব্যবহৃত হতো।

আর সর্বশেষ তত্ত্বটি হল ‘পার ভ্যালু’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বেরও বর্তমানে আর কোনো প্রয়োগ নেই। এটি অনুযায়ী, আইএমএফ ডলারের সাহায্যে মুদ্রার মান নির্ধারণ করত। এক্ষত্রে প্রথমে আইএমএফ প্রত্যেক দেশকে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য তাদের দেশী টাকায় কত দেবে, তা জানাতে বলত এবং সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো। তবে এই পদ্ধতিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার মান ক্রমশ ওঠানামা করে। বর্তমানে বাংলাদেশী ৮৪ টাকায় ১ মার্কিন ডলার, ১১৯ টাকায় ১ পাউন্ড, ২২.৫৪ টাকায় ১ সৌদি রিয়াল, ২৮১ টাকায় ১ কুয়েতি দিনার, ১.২৯ জাপানি ইয়েনে ১ বাংলাদেশী টাকা, এবং ১৩ দক্ষিণ কোরিয়ান ওনে ১ বাংলাদেশী টাকা পাওয়া যায়।

বর্তমানে কুয়েতি দিনারের মান বাংলাদেশী টাকায় সবচেয়ে বেশি। আর এর পেছনেও রয়েছে একটি কারণ। সারা বিশ্বের পরিশোধিত তেল ডলারের সাহায্যে ক্রয়-বিক্রয় করা হলেও কুয়েতি তেলের দাম কুয়েতি দিনারেই পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত পেট্রোলিয়াম জাতীয় তেলের চাহিদা পৃথিবীব্যাপী অনেক বেশি। আর যোগান অপেক্ষা চাহিদার পরিমাণ বেশি থাকায় কুয়েতি দিনারের বিনিময় মূল্যও বেশি।

চাহিদা ও যোগানের তারতম্য এবং দ্রব্যমূল্যের পার্থক্যের কারণে জাপানি ইয়েন এবং দক্ষিণ কোরিয়ান ওনের চেয়ে বাংলাদেশী টাকার মূল্য বেশি। তবে এক্ষত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, দুই দেশের মধ্যে একটি দেশের মুদ্রার মান কম হবার অর্থ এই নয় যে, সেই দেশটির অর্থনীতি অপর দেশ হতে খারাপ। কারণ অর্থনীতির কাঠামোর উপর নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার চাহিদা ও যোগান এবং দেশের দ্রব্যমূল্যের উপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়।

লেখকঃ তানজিম হাসান পাটোয়ারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

আরও পড়ুন:
◾ ঋণ শ্রেণিকরণের নতুন সার্কুলার
◾ সিডিউল অফ চার্জ সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার
◾ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স নবায়নের শর্ত শিথিল
◾ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন প্রণোদনা সুবিধা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button