অর্থনীতি

বাজেট আমাদের কি কাজে আসে?

বাজেট আসছে। বাজেট যতই কাছে আসছে, অর্থমন্ত্রীর ব্যস্ততা বাড়ছে। তার প্রধান লক্ষ্য দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথ দেখানো। কোন পথ, তা নিয়ে আমাদের যত কথা। গত কয়েক দিন অর্থমন্ত্রীর নানা বক্তব্য পত্রপত্রিকায় এসেছে। তার ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। আমাদের আশা থাকবে চাপের মুখে তিনি বেফাঁস কিছু যেন না বলেন। কারণ বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কথা আদায় করা গেলে কোটি কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। বাজেটে কী থাকবে তার সম্পর্কে আগাম কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা অবান্তর। কারণ তার কোনো বাস্তব মূল্য নেই। ভবিষ্যদ্বাণীতে কারো কিছু যায় আসবে না। আসল খবর জানা দরকার। তাই বাজেটে কী আশা করা যায়, তার কোনো ফিরিস্তি দেয়া সমীচীন মনে করি না। বরং বাজেট কী করে, কী দেয়, সে সম্পর্কে ধারণা তৈরির জন্য এ লেখা।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ছিলাম। উবার ট্যাক্সি দিয়ে যাচ্ছিলাম। সুন্দর ট্যাক্সি, অর্থাত্ একেবারে ঝকঝকে নতুন গাড়ি। সন্দেহ হলো, ঠিক ট্যাক্সি কি? ২৫-৩০ বছরের এক সুদর্শন যুবক গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সুন্দর ইংরেজি বলে। তাই কথা বলতে শুরু করলাম। জানলাম যে একজন সদ্যপাস করা ডাক্তার। পাস করে বসে আছে, মাস ছয় বা আরো কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে নিয়োগপত্রের জন্য। এই ফাঁকে উবার ট্যাক্সি চালাচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে যখন জানল যে, আমি বাংলাদেশী এবং একজন অর্থনীতির অধ্যাপক, তাতে সে বেশ উত্সাহী হলো। বলল, তোমরা কী করো? মানে? মানে অর্থনীতিতে পাস করে তোমাদের কাজ কী? আমরা ডাক্তার, আমাদের কাজ রোগী দেখা, তাদের সারিয়ে তোলা। তোমাদের কাজ কী? তার প্রশ্নে অবাক হলাম। তবে আনন্দ হলো এজন্য যে, এ প্রশ্ন আমাদের দেশে কেউ কখনো করেনি। আমাদের দেশে সবাই কি তাহলে জানে যে অর্থনীতিবিদরা কী করেন? বললাম, তোমাকে বোঝানো কঠিন। তবে সহজ ভাষায় বলি, আমাদের কাজ দেশের অর্থনীতির নাড়ি ধরে বলা— দেশ কোথায় যাচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো, তোমরা একজন রোগী দেখে তাকে সারানোর জন্য ওষুধ দাও। আর আমাদের রোগীকে দেখা যায় না। কার নাড়ি ধরব, তা বলা মুশকিল।

কথাটা এ প্রসঙ্গে বললাম এজন্য যে, বাজেট আসছে শুনলেই অনেকেই অর্থমন্ত্রীর নাড়ি ধরতে চান। জানতে চান তার ধমনিতে কী প্রবাহিত হচ্ছে। তারা আশা করে থাকেন যদি তিনি কোনো কথা ফাঁস করে দেন, তবেই আমাদের লাভ। লক্ষ করবেন, কারা এ সময় ঘন ঘন অর্থমন্ত্রীকে সভা-সমাবেশে দাওয়াত করেন? তাদের কী এমন তাগিদ তার কথা শোনার? আপনি কি বলতে পারেন ট্রাম্পের অর্থমন্ত্রী কে? কিংবা কে টেরিসা মে’র অর্থমন্ত্রী? তাদের কোথাও দেখা যায় না। কারণ সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র অর্থমন্ত্রীই হলেন সেই লোক, যার লক্ষ্য টাকা আদায় করা; আর বাকি মন্ত্রীদের কাজ হলো টাকা খরচ করা। তাই এ উপমহাদেশ ছাড়া সর্বত্রই অর্থমন্ত্রীরা মিতভাষী। কথা কম বলেন। লোকে তাদের কম চেনে। থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর আমাদের?

বলতে পারেন কেন অর্থমন্ত্রীরা থাকেন নিভৃতে! কারণ তারা কথা বললেই ব্যবসায়ীরা টাকা গুনবেন। আমাদের মতো দেশে যেখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে উত্পাদন নয়, ফটকাবাজারি হলো ব্যবসা, সেখানে বাজেট তাদের একটি মোক্ষম লক্ষ্যবস্তু। বাজেটের আগে যদি জানা যায়, সরকার কোথায় কর বসাচ্ছে, কোথায় কর রেয়াত দিচ্ছে, তাহলেই ব্যবসায়ীদের লাভ। তাই বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর কদর বাড়ে। তার কথা শুনতে এদের সবাই উদগ্রীব। কিন্তু বাজেটের মূল লক্ষ্য কি ব্যবসায়ীরা? নিশ্চয়ই নয়। বাজেটের মূল লক্ষ্য অর্থনীতি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

অনেকে বাজেটকে সরকারের আয়-ব্যয়ের খতিয়ান হিসেবে দেখতে চান। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। সরকারের আইনি কাঠামো অনুসারে দেশের সংসদ সব ক্ষমতার উত্স। সংসদকে পাস কাটিয়ে সরকার কোনো খরচ করতে পারে না, তেমনি পারে না কোনো কর আরোপ করতে। এজন্যই অর্থমন্ত্রীকে প্রতি বছর আইনের প্রতি ‘শ্রদ্ধা’ প্রদর্শন করে সংসদে বাজেট পেশ করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, গত বছরের বাজেটের কোনো হেরফের হয়ে থাকলে তাও সংসদে ‘পাস’ করিয়ে নিতে হয়। এই হলো আইনগত দিক। সার্বভৌম সংসদ একেই বলে। কিন্তু বাজেট কি কেবল আয়-ব্যয়ের হিসাব? না তা নয়। উন্নয়নশীল দেশে বাজেট অর্থনীতির চাবিকাঠি।

বাজেটের দিকনির্দেশনা দেখেই দেশে বিনিয়োগ হয়। দেশে বিনিয়োগ আসে। দেশজ উত্পাদন বাড়ে। দেশে কর্মসংস্থান হয়। এ দিকনির্দেশনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু আয়-ব্যয় নয়। তার জন্যই দেখবেন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মহোদয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উত্সাহিত করতে নানা ধরনের প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে থাকেন। আর এ ঘোষণা বাজেটের আগে আসুক, তা কখনই কাম্য নয়। তাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অস্বস্তি দেখা দেয়। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী কোনো কোনো কর্মকাণ্ড নিরুত্সাহিতও করে থাকেন। তাও তিনি করেন নীরবে। কারণ আগে থেকে জানলে তাতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তার অতি উত্সাহ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনীতির জন্য বেদনাদায়ক হয়। এ বোধগম্যতার কারণেই দেখা যায় যে, অর্থমন্ত্রীরা সর্বদাই লুকিয়ে থাকেন। কথা কম বলেন।

উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি, কয়েক দিন আগে জানা গেল সরকার আগামী বাজেটে কোনো ফি ছাড়াই রেমিট্যান্স দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। সংবাদটি নিশ্চয়ই সুসংবাদ। অনেকেই খুশি হবেন, মন্ত্রীর দেশচিন্তার জন্য ধন্যবাদ দেবেন। কিন্তু আপনি যদি বিদেশে থাকেন, তবে কী করবেন? আপনি আগামী একটি মাস কার্যত রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে থাকতে চাইবেন। কারণ ১ জুলাই থেকে কোনো ফি লাগবে না। রেমিট্যান্স আসা আপাতত কমে যাবে। মন্ত্রী মহোদয় কি প্রবাসীদের তা বলতে চাইলেন? নিশ্চয় না। কিন্তু তা-ই ঘটবে। মে ও জুনে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাবে। ভাগ্যিস জুনে ঈদ আছে, তাই কিছুটা স্বস্তি হবে। কারণ ঈদে অনেকেই বাড়িতে টাকা পাঠাতে বাধ্য হবেন। আবার ধরুন মন্ত্রী জানালেন যে, প্রতি ১ শতাংশ ভ্যাট কমলে সরকারের রাজস্ব ৪ হাজার কোটি টাকা কমে যাবে। কথাটা সত্য। কিন্তু অনেকেই মনে করবেন এই মন্ত্রী মহোদয়ই কিন্তু একদিন বলেছিলেন, ৪ হাজার কোটি টাকা কিছুই না! বিব্রত করার জন্য এত বাক্য ব্যয় করিনি। আমাদের বুঝতে হবে বাজেটের সার্বভৌম ক্ষমতা সংসদের। সেখানেই সর্বাগ্রে তা প্রকাশ করা উচিত। সংসদে বাজেট পেশের আগে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন সংসদকে হেয় করা হয়, তেমনি কিছুু মহলকে আগাম তথ্য দিয়ে আর্থিক সুবিধা ভোগ করার সুযোগ করে দেয়া হয়।

এবার আসুন বাজেট আর কী করতে পারে? বাজেট বছরে সব দিন পেশ করা হয় না। বাজেট পেশ করা হয় বছরে একবার। কারণ এই একবারেই অর্থমন্ত্রী জানাবেন আগামী এক বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মোড় কোথায় যাবে। আগামী কয়েক মাসের নয়। দেশে ৫০ লক্ষাধিক বেকার যুবকের জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তার দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকতে হবে। তার সঙ্গে যোগ হবে প্রতি বছর আরো ১২-১৫ লাখ। তাদের কর্মসংস্থান কী করে হবে তা হতে হবে অর্থমন্ত্রীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

দেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। কোনো নতুন খবর নয়। কিন্তু কেন হচ্ছে, তা কি আমরা জানি? নাকি নিজেদের মনের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়মনীতি তৈরি করতে আমরা সচেষ্ট হচ্ছি? অর্থনীতির পরিভাষা অনুসারে অর্থ একটি তরল সম্পদ। অন্যান্য তরল পদার্থ যেমন সর্বদাই নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, তেমনি অর্থও প্রবাহিত হয় স্বস্তি ও বিশ্বাসের দিকে। যেখানে অবিশ্বাস, সেখান থেকে অর্থ পাচার হয়। যেখানে অস্বস্তি, সেখানে অর্থ ভরসা পায় না। চলে যায় অন্যত্র। এ ধারণাকে যদি বুঝতে পারেন, তবেই বলতে পারবেন অর্থ কেন পাচার হচ্ছে। টোটকাবিদ্যা বা ঝাড়ফুঁক দিয়ে অর্থনীতির মতো বিশাল হস্তীকে নাড়ানো সম্ভব নয়।

কথা বলছিলাম সেই (ডাক্তার) উবারচালকের সঙ্গে। জানতে চাইল কী করে আমরা (অর্থনীতিবিদরা) অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করি? বললাম, তোমাদের চেয়ে আমাদের অসুবিধা বেশি। তোমরা কোনো রোগী দেখার সময় কী করো? রোগীর সঙ্গে কথা বলো, তার নানা উপাত্ত সংগ্রহ করো। তারপর ব্যবস্থাপত্র দাও, আমাদের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। তবে তোমরা রোগীকে দেখতে পাও, আমরা দেখতে পাই না। আমাদের রোগী ঠিক সামনে থাকে না। আমরা তাদের দেখতে পাই না। আমরা তাকে সরাসরি কোনো পরীক্ষাও করতে পারি না। আমাদের অবস্থা বেশ জটিল। তাই আমাদের মূল কাজ মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করা আর তার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপত্র দেয়া। আর এ আচরণ বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি হলো সঠিক উপাত্ত। সঠিক উপাত্ত ছাড়া আমাদের কাজ করা দুষ্কর। অসুবিধা হলো, সঠিক উপাত্ত প্রকাশ করতে সরকারের অনেক আপত্তি। সর্বোপরি আমাদের কাজ অনেকেই চোখে দেখতে পান না। তাই সবাই নিজেকে অর্থনীতিবিদ মনে করেন আর নিজেদের মনমতো উপদেশ দিয়ে যান। ফলে লাভ হয় ব্যবসায়ীদের আর ক্ষতি হয় জনগণের। কারণ তারাই হয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ।

লেখকঃ ড. এ কে এনামুল হক, অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button