ব্যাংকার

বেসরকারী ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলের ব্যাংকারদের বেতন

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ বেসরকারী ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলের ব্যাংকারদের বেতন- বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার কি ক্ষমতা বহির্ভুত নাকি অয়ৌক্তিক? গত দু’দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ বাংলাদেশ ব্যাংককে সাধুবাদ দিচ্ছেন আবার কেউ একে ব্যাংকিং অঙ্গনে বিশৃংখলার আভাসও দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এমনটিই স্বাভাবিক। যদি সর্বমহলের কোন কিছু প্রসংশনীয় হয় সেটা যেমন বেশিদিন টিকে না আবার সবাই একযোগ নিন্দা জানালেও দেখা যায় শেষে সেটাই টিকে থাকে অনেকদিন।

কিছুদিন আগে আমি এ প্রসঙ্গে লিখেছি তবে সেখানে এন্ট্রি লেভেলে বেতন ভাতা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করিনি। ব্যাংক খাতে মেধাবীদের আকর্ষণ করতে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দিয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকের নিচের পদগুলোতে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা হবে ২৮ হাজার টাকা। শিক্ষানবিশকাল শেষ হলে প্রারম্ভিক মূল বেতনসহ ন্যূনতম মোট বেতন-ভাতা হবে ৩৯ হাজার টাকা।

আরও দেখুন:
ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন বেঁধে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই সার্কুলারটি আগামী মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতিমালা পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে সংখ্যাটা শ’ খানেক। দেশে প্রতিবছর যে লাখো তরুণ উচ্চশিক্ষার পথ পাড়ি দিয়ে চাকরির বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের বড় জায়গা এসব প্রতিষ্ঠান। তরুণদের বড় অংশের পছন্দের শীর্ষেও ব্যাংকিং ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং পেশা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়; চমকপ্রদ। যেকোনো বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের ব্যাংকগুলোতে দ্রুত নিয়োগ, মানসম্মত বেতন ও আর্থিক সুবিধা, স্বল্প সুদে গৃহ ও গাড়ি লোন এবং শীর্ষ পদে যাওয়ার সুযোগসহ দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ তরুণদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। এ ছাড়া ব্যাংকারদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, সুশৃঙ্খল পরিবারটি জীবনাচরণও অনেকের কাছে আকর্ষণীয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা জানা যায়। কিছু কিছু ব্যাংক প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন দিয়ে গোপনে নিয়োগ দেয়, সেই বিষয়টিও প্রকাশ পায়। তাছাড়া এদের একেবারে কম বেতন নির্ধারণ করা হত। একই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেতনের হেরফেরও হত। এতে ব্যাংকের নতুন কর্মীদের মনোবল নষ্ট হত। যা ব্যাংকিং খাত বিকাশের অন্তরায় ছিল। এসব সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের নিচের স্তরে কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দিল। কোনো ব্যাংক এর কম দিতে পারবে না। তবে বেশি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা থাকবে না।

সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকের এন্ট্রি পর্যায়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশ অফিসার অথবা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, শুরুতে এসব কর্মকর্তার শিক্ষানবিশকালে ন্যূনতম বেতন-ভাতাদি হবে ২৮ হাজার টাকা। শিক্ষানবিশকাল শেষে কর্মকর্তাদের প্রারম্ভিক মূল বেতনসহ ন্যূনতম সর্বমোট বেতন-ভাতাদি হবে ৩৯ হাজার টাকা। এতে বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে অন্ততঃ এন্ট্রি লেভেলে অভিন্ন বেতনের যে দীর্ঘকালের দাবী তা পূরণ হবে।

নতুন নির্ধারিত বেতন-ভাতাদি কার্যকর করার পর একই পদে আগে থেকে কর্মরত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের বেতন ভাতাদি কম হবে না। প্র্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্ন পদে কর্মরত কর্মকর্তার বেতন-ভাতাদির সঙ্গে ব্যাংকে সর্বনিম্ন পদে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির পার্থক্য যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে। অনুরূপভাবে অন্য সব স্তরের কর্মকর্তাদের জন্যও আনুপাতিক হারে বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ করতে হবে। কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন-ভাতাদি কোনো অবস্থাতেই বর্তমান বেতন-ভাতাদির চেয়ে কম হবে না। তবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইনক্রিমেন্ট দিয়ে বেতন-ভাতাদি সমন্বয় করতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, কর্মকর্তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ বা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনের শর্ত আরোপ করা যাবে না। শুধু নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না। একই সঙ্গে এই ধরনের অজুহাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতনও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে আলোচ্য সার্কুলারে। এতে বলা হয়, ব্যাংকের মেসেঞ্জার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, অফিস সহায়ক অথবা সমজাতীয় পদ বা সর্বনিম্ন যে কোনো পদের কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রারম্ভিক বেতন-ভাতাদি হবে ২৪ হাজার টাকা।

চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক ভিত্তিতে বা আউটসোর্সিং বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কর্মচারীদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়, সেক্ষেত্রে স্থায়ীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ করতে হবে। এখানেও ইচ্ছামাফিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা যাবে না।

এই সার্কুলারে “ব্যাংক কর্মীদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না” বলে উল্লেখ করা হয় যা বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। গত ২০২০ সন থেকে করোনাকালীন সময়ে প্রায় চার হাজার ব্যাংক কর্মীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর ফলে বেসরকারী ব্যাংক খাতে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ফলে গত বছরের সেপ্টম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারী করে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ব্যতীত ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁদের বিধি মোতাবেক চাকরিতে বহালের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি করোনাকালীন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণে চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে, সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।

এমন পরিস্থিতিতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনায় এবং এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা অটুট রাখার স্বার্থে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকঃ
১. সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত না করা।
২. করোনাকালীন শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণ প্রদর্শন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য না করা।
৩. পয়লা এপ্রিল ২০২০ তারিখ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধিমোতাবেক চাকরিতে বহাল করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ২০১৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, পদবি, পদত্যাগের কারণ, ওই কর্মকর্তার বর্তমান অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এর মাধ্যমে পরিষ্কার হবে, ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হওয়া কী পরিমাণ কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়েছেন।

বেসরকারি ব্যাংকে কর্মী নিয়োগে সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার দিয়েছে তা অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ব্যাংকারদের বক্তব্য হল, নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের আগে ব্যাংকের আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য বিভিন্ন সেবার মাসুল (সার্ভিস চার্জ), সরকারি সেবার বিপরীতে প্রদত্ত কমিশন, ঋণের সুদহার বাড়াতে হবে। বেসরকারি ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সরকারি বেতন কাঠামোর সঙ্গে ব্যাপকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যা বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যাংকগুলো নতুন শাখা খোলা দূরের কথা, বিদ্যমান অনেক শাখা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। তারা বলছেন, এতে সরকারের গ্রামকে শহরায়ন, গ্রামে বসেই চাকরি, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগবান্ধব ঋণের সুদহার আবার বাড়িয়ে দেবে এ অবাস্তব বেতন কাঠামো।

নির্দেশনাটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন ব্যাংকস অ‌্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)। বিএবি ও এবিবির মতে, এটি সরকারি বেতন কাঠামোর সঙ্গে ব্যাপকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ণ করতে গেলে ব্যাংকগুলো নতুন শাখা খোলা দূরের কথা বিদ্যমান অনেক শাখা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। এতে সরকারের গ্রামকে শহরায়ন, গ্রামে বসেই চাকরি, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগবান্ধব ঋণের সুদহার আবার বাড়িয়ে দেবে এই অবাস্তব বেতন কাঠামো।

পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেছে- ব্যাংকগুলো এখন ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে নতুন নতুন শাখা খুলছে। কম খরচে গ্রামের মানুষকে সেবা দিতে উপশাখা খুলছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি ও অন্যান্য বেসরকারি খাতের কর্মীদের বেতনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন অনেক বেশি। উপজেলা পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি সংস্থার পিয়ন, পুলিশ কনস্টেবল, বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা না করে অযৌক্তিকভাবে ব্যাংকের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামের ব্যাংকিং ব্যবসার পরিধি অনেক কম। তাই সেখানে এত বেশি বেতন দিয়ে কর্মী নিয়োগ করে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত পরিপালন করতে হলে অবশ্যই গ্রামের শাখা বন্ধ করতে হবে। এতে গ্রামীণ উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সূত্র জানায়, করোনাকালে গত দুই বছর সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সবখাতেই নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ।

বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দারিদ্র্য ও বেকারমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে সরকার গ্রামে শহরায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলো নিজেরা গ্রামে গিয়ে শাখা খুলে কর্মী নিয়োগ করছে। আবার নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগে বাধ্য হলে গ্রামে শাখা খোলার উদ্যোগই বন্ধ করতে হবে। গ্রামের মানুষের কর্মের সুযোগ এবং অর্থায়নের উৎস বন্ধ হবে। আগে গ্রামের মানুষ এনজিও থেকে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতো। এখন উপশাখার কারণে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারছেন। এটিও বন্ধ হবে। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে কর্মীদের দক্ষতা বিচারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো দক্ষতা বিচারে প্রতিবছর সেরা কর্মীদের পুরস্কৃত করে এবং অদক্ষতাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষ এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এই মূল্যায়ণ পদ্ধতিও কার্যত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কোন কোন ব্যাংকার বলেছেন, নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের আগে ব্যাংকের আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য বিভিন্ন সেবার মাসুল (সার্ভিস চার্জ), সরকারি সেবার বিপরীতে প্রদত্ত কমিশন, ঋণের সুদহার বাড়াতে হবে। অন্যদিকে প্রভিশন ও করপোরেট কর কমাতে হবে। আনুপাতিক হারে সরকারি সংস্থার স্থায়ী আমানত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হারে বেসরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। যেহেতু বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিচ্ছে, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয় বাড়িয়ে কীভাবে টিকে থাকবে সে সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হবে। বর্ধিত ব্যয় কোন খাত থেকে আয় করে মেটাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি নির্ধারণ করে দিক।

ভিন্নমত থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার কেউ মানবেন না, এটা প্রত্যাশিত নয়। এটাও একটা জব ইন্ডাস্ট্রি। কি পরিমাণ ঝুঁকি এবং স্ট্রেচ নিয়ে দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এ জবে আসে, যুদ্ধ করে এবং টিকে থাকে। দীর্ঘ চাকুরীজীবনে ডায়বেটিক, উচ্চ রক্তচাপ ও কার্ডিয়াক হয়নি এমন ব্যাংকার বিরল। তবুও কি বলবেন, ব্যাংক পেশা ওম শান্তির! ধরুন একজন সর্বোচ্চ পদের এমডি মহোদয়ের বেতনের সাথে একজন অফিসারের বেতন অনুপাত সম্ভবতঃ এই ইন্ডাস্ট্রিতেই সবচেয়ে বড় গ্যাপ। এখন উচ্চপদেও বেতন ভাতা সমন্বয়ের কথা উঠলে নিশ্চয়ই কেউ খুশি হবেন না। যত সুবিধা কর্তন ঐ নীচের লেভেলে অথচ ব্যাংকে নীরবে নিভৃতে, এমনকি গেল দু’বছর মহামারী করোনায় জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেও সার্ভিসকে সচল এরাই রেখেছিলো। একটি ব্যাংকের কথা জানি যারা এত বিরুপতার মধ্যেও কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়েছে পঞ্চাশ শতাংশ। কৈ তারা তো বাড়তি আয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গাইডলাইন চায়নি।

বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সরকারী ব্যাংকগুলোতে পদসোপান ও বেতন কাঠামো নিয়ে কোন গোলমাল নেই কেননা তা শুরু থেকেই জাতীয় বেতন কাঠামোর সাথে সামন্জস্যপূর্ণ। কিন্ত বেসরকারী ব্যাংকগুলোর পদসোপান বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন রকম, একইভাবে একই পদে বেতনও ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে ভিন্ন ভিন্ন। দেখা যায়, এক ব্যাংকে কেউ প্রমোশন পেলো না তো অন্য ব্যাংকে শিফট করলে এক স্কেল উপরের বেতনে টেনে নেয়া হয়। এধরনের মাইগ্রেশন কারো কারো পাঁচ বছরে পাঁচটা। এগুলো একটা সুস্থ প্রফেশানের জন্য বিপজ্জনক। সেকারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেছে এবং এটা আমার কাছে যথার্থ বলে প্রতীয়মান। ভিন্নমত থাকতেই পারে। অভিন্ন পদসোপানের জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা দ্রুত প্রত্যাশা করি।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button