মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ ও ইসলামি ব্যাংকিং
ড. মো. গোলাম মোস্তফাঃ ‘অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন’(সুরা বাকারা-২৭৫)। শুধু সুদের উচ্ছেদ ও বিলোপ সাধন ইসলামি ব্যাংকের কাজ নয়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের নৈতিক, চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশ সাধন এবং হালাল-হারাম মান্য করে বৈধ সীমার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ ইসলামি ব্যাংকের মূলনীতি ও কর্মকৌশল। ইসলামি ব্যাংক ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি প্রায়োগিক ক্ষেত্র। সুতরাং ইসলামি অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে মাকাসিদ আশ্-শারিয়াহ্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থসামাজিক কল্যাণ ও ভারসাম্যপূর্ণ আর্থিক কাঠামো গঠনে সহায়তা করা।
মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর দেয়া কিতাব, রাসূল (সা.)-এর হাদিস ও ফকিহ্দের শরিয়াসম্মত বিধিবিধান অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ ইসলামি আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ‘মাকাসিদ’ শব্দটি ‘মাকসাদ’ বা ‘মাকসিদ’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হলো, ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, গন্তব্য, তাৎপর্য, মর্ম, বক্তব্য প্রভৃতি। এসবের মধ্যে প্রধানতম অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য। আর শরিয়াহ শব্দটি ‘শার’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ হলো চলার পথ। মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ ওহির যুগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ক্রমাগত একটি ইসলামি আইন দর্শন, যা মানব কল্যাণে নিবেদিত। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পর সাহাবিদের সংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজারের ঊর্ধ্বে।
আরও দেখুন:
◾ ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস
◾ ইসলামী ব্যাংকিং কি এবং কেন?
তাঁদের মধ্যে মাত্র ১২০ বা ১৩০ জন মুজতাহিদ (শরিয়াহবিষয়ক গবেষক) ছিলেন। সমস্যার উদ্ভব হলে তাঁরা কোরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদ দ্বারা মতামত প্রদান করতেন। এভাবেই সাহাবিদের সময়ে অথবা তার পরবর্তী সময়ে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর চর্চা হতো মাসয়ালা চর্চার মাধ্যমে। মাসয়ালা শব্দের অর্থ হলো প্রশ্ন করা। ধারাবাহিকভাবে, মাকাসিদ শব্দটি ব্যবহার করেন তাবেয়ি যুগের ইসলামি পণ্ডিত ইমাম তিরমিজি (রহ.) (২০৯-২৭৯ হি.), ইমামুল হারামাইন আল-জুয়াইনি (রহ.) (৪১৯-৪৭৮ হি.), বারো শতকের ইমাম গাজ্জালি (র.) (১০৫৮-১১১১ খ্রি.), চৌদ্দ শতকের ইসলামি চিন্তাবিদ আল-শাতিবি (রহ.), ইবনে আশুর, রশিদ রিদা, ড. ইউসুফ আল কারজাভি ও ড. এম উমর চাপরা প্রমুখ।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ইমাম গাজ্জালি রহ. (১০৫৫-১১১১ খ্রি.) বলেন, শরিয়াহর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস, জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি, সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। তাঁর মতে, যা কিছু এই পাঁচটি বিষয়ের সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে, তা-ই জনস্বার্থ বলে গণ্য এবং সেটাই কাম্য।
মাকাসিদের জনক ইমাম আবু ইসহাক আল-শাতিবি (রহ.) (১৩২০-১৩৮৮ খ্রি.) ‘আল-মুওয়াফাক্বাত ফি উসুল আল-শারিয়াহ’ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার অনুযায়ী তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। এক. জরুরিয়াত (বিশ্বাস, জীবন, বংশধর, সম্পত্তি ও বুদ্ধিমত্তা), দুই. হাজিয়াত (প্রয়োজনীয়) এবং তিন. তাহসিনিয়াত (উৎকর্ষমূলক)। মাকাসিদে শরিয়াহর আলোকে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়নে শাতিবির স্তরবিন্যাস ‘মাসলাহা পিরামিড’ নামে পরিচিত। ইসলামি ব্যাংকের নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাহিদার এই অগ্রাধিকার স্তরভিত্তিক বিবেচনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
সব যুগে সব শরিয়তের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল, মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধনে দিকনির্দেশনা প্রদান। ইসলামি শরিয়াহ পণ্ডিতরা ইসলামের মৌলিক বিধান পাঁচটি শিরোনামে তুলে ধরেছেন- যথা আকিদা, ইবাদত, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত ও আখলাক। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মুয়ামালাত বা লেনদেনের ক্ষেত্রে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর যে গুরুত্ব তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মুয়ামালাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব দিক আলোচিত হয়। ১১ শতকে ইমাম বুরহান উদ্দিন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর (রহ.) আল-হিদায়া ফিকাহ্ গ্রন্থ রচনা করেন। আল-হিদায়ার তৃতীয় খণ্ডে ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়ে মুদারাবা, বাই মুরাবাহা, বাই সালাম, ইজারা, কাফালাহ, ওয়াকালাহ ও আমানত বিষয়ে লেনদেনের শরিয়াহ পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে।
শয়িয়তে মুয়ামালাতের উসুল (নীতিমালা):
মুয়ামালাত আরবি শব্দ। এর অর্থ বিনিময়, বদল, বৈধ, বন্ধন ও চুক্তি ইসলামি পরিভাষায় মুয়ামালাত হলো সেইসব বিধান, যার দ্বারা পারস্পরিক লেনদেন ও আদান-প্রদান বুঝায় যা কেবল দাতাগ্রহীতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আধুনিক ইসলামি অর্থনীতির জনকদের অন্যতম মুসলিম পণ্ডিত ইবনে খালদুনের (১৩৩২-১৪০৬) মতে, ‘মুয়ামালাত হলো হিসাব বিজ্ঞানের একটি অংশ আর তা হিসাব বিজ্ঞানের একটি ইতিবাচক দিক, যা ঐতিহ্যগত বা জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞান হিসেবে পৃথক করে।’ ইমাম আত-তাবারানি (৮৭৪-৯৭১ খ্রি.) রচিত একটি বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ আল মুজামুল আওসাতে বলা হয়েছে, ‘আহকামে শরিয়ায় মুয়ামালাত হলো পার্থিব কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়।’ ইসলামি ফিকহের ভাষায়, ‘দুই ধরনের লেনদেন আছে, জায়েজ ও নিষিদ্ধ, মুয়ামালাত হলো অনুমোদিত চুক্তি’। ইসলামি বিশ্বকোষ গ্রন্থে মুআমালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মুআমালাত হলো বিনিময়, আদান-প্রদান, ক্রয়-বিক্রয়, ঋণদান এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি’। মু‘আমালাহ, আদত-অভ্যাস, পার্থিব বা জাগতিক লেনদেন, আচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো তা বৈধ যতক্ষণ না অবৈধ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুআমালাহ-সংক্রান্ত মূলনীতির নির্দেশনা পাওয়া যায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বক্তব্য থেকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যিনি তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন তা বিশদভাবেই তোমাদের বলে দিয়েছেন’। (সুরা আন’আম: ১১৯) ‘সেই মহান আল্লাহই ভূমণ্ডলের সবকিছুই তোমাদের (ভোগ-ব্যবহারের) জন্যে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আল-বাকারা: ২৯)
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (র.) বলেন, লেনদেন ও চুক্তির ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে ‘আল-ইজনু’ বা অনুমোদন এবং ‘আল-ইবাহাহ্’ বা বৈধতা। অবশ্য যদি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ও সুনির্দিষ্ট অর্থবোধক কোনো দলিল পাওয়া যায়, যা দিয়ে এর অবৈধতা সাব্যস্ত হয়; তখন সেখানে এসে ক্ষান্ত হতে হবে। মুআমালাত একটি ইবাদত, যা শরিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আধুনিক ব্যাংকিং কার্যক্রম সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মুআমালাতের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক। সুতরাং, ইমান-আকিদা ও ইবাদতের সঙ্গে মুআমালাতের যোগসূত্র অতি গভীর ও সুদৃঢ়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি পূর্ণাঙ্গ মুআমালাতের উসুল বা নীতিমাল তৈরি হয় ১৪ শতকে।
মাকাসিদের আলোকে ইসলামি ব্যাংকিং:
ইমান ও আমলের ক্ষেত্রে যেমনিভাবে আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক, অনুরূপভাবে অর্থ উপার্জন, ব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক। অর্থনৈতিক জীবনে যাতে ভারসাম্য রক্ষা হয় এর জন্য হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার হলো ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আর্থিক ক্ষেত্রে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর উদ্দেশ্য হলো ইসলামি বিধিবিধান অনুসরণ করে সব ধরনের আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করা। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) মতে, ইসলামি ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার উদ্দেশ্য, মূলনীতি এবং কর্মপদ্ধতির সকল পর্যায়ে ইসলামি শরিয়াহর সব নীতিমালা মেনে চলে এবং তার সকল কার্যক্রমে সুদের লেনদেন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে। ইসলামিক ব্যাংকের ওই সংজ্ঞাই প্রমাণ করে যে, মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর আলোকে ব্যাংকিং সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা নৈতিক দায়িত্ব।
ইসলামি ব্যাংকগুলো দেশের সাধারণ জনগণের কাছ থেকে মুদারাবা (লাভ-লোকসান অংশীদারি) ও আল ওয়াদিয়া সাধারণত এ দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে আমানত গ্রহণ করে। ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে জমাকৃত অর্থ শরিয়াহ সম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার অনুমতি নেয় এবং অর্জিত মুনাফার একটি অংশ চুক্তি অনুযায়ী আমানতকারীদের মধ্যে বণ্টন করে। সব সময় লাভ হবে এমন নয়, লোকসানও হতে পারে, সেক্ষেত্রে আমানতকারীকে লোকসান বহন করতে হবে। মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ ব্যাংকিং চ্যানেলে আর্থিক লেনদেনের সবক্ষেত্রে সুদ পরিহার করে ইমান সংরক্ষণের পাশাপাশি জীবন-জীবিকার বৈধ ও ন্যায়ানুগ পথ সুগম করে। ইসলামি ব্যাংকগুলো ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে। তার অন্যতম হলো ‘ক্যাশ ওয়াকফ’ হিসাবের মাধ্যমে সমাজের উচ্চ শ্রেণি ধার্মিক লোকদের কাছ থেকে জমা গ্রহণ করে। ওই জমাকৃত অর্থ ওয়াকিফের নির্দেশনা মোতাবেক সমাজের অভাবী মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করে। এছাড়া হজ, মোহর, বিবাহ প্রভৃতি বিশেষ কল্যাণকর হিসাবের মাধ্যমে সেবা দিয়ে থাকে। সিএসআর ও জাকাত ফান্ডের মাধ্যমে শিক্ষ, স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সমাজের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে।
ইসলামিক ব্যাংকের বিনিয়োগের মূল বিবেচ্য বিষয় হলো, কল্যাণকর ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে বিনিয়োগ পুঞ্জীভূত না করে আকৃতি, প্রকৃতি ও সমাজে কল্যাণ বয়ে আনে এমন খাতে বিনিয়োগ করে বণ্টনমূলক সুবিচার নিশ্চিত করা মাকাসিদে শরিয়াহর ‘সম্পদ সংরক্ষণ’ (হিফজুল মাল)-এর লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। জাতীয় আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ভারসাম্য রেখে সামাজিক, আর্থিক ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠায় মাকাসিদের জরুরিয়াতের পাঁচটি শর্ত (বিশ্বাস, জীবন, বংশধর, সম্পত্তি ও বুদ্ধিমত্তা সংরক্ষণ) পূরণে কাজ করা ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অন্যতম লক্ষ্য।
ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক বিভিন্ন বিনিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে। বিভিন্ন ইসলামি ব্যাংক দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও বিনিয়োগের ধরন অনুযায়ী শরিয়তের সীমার মধ্যে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করে। সাধারণত এই পদ্ধতিগুলোকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হলো অংশীদারি পদ্ধতি যা আধুনিক ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগের জন্য ১৯৬৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নেজাতুল্লাহ সিদিকী মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দ্বিস্তর বিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন। পরে তিনি মুশারাকা নীতি অন্তর্ভুক্ত করে ফান্ড ব্যবস্থাপনার দ্বি স্তরবিশিষ্ট মডেল অধিকতর সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন। এই নীতি অনুসরণ করে অংশীদারি পদ্ধতিতে ইসলামি ব্যাংকগুলো মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে। বাই (ক্রয়-বিক্রয়) পদ্ধতির মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক গড়ে তুলে। এই পদ্ধতিগুলো হলো বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-সালাম ও ইসতিসনা। ইজারা পদ্ধতির মাধ্যমে কারখানার মূলধনি যন্ত্রপাতি, যানবাহন, বাড়ি ইত্যাদি ভাড়া দাতা ও ভাড়া গ্রহীতা রূপে সম্পর্ক সৃষ্টি করে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইজারা হলো- কোনো সম্পদ ব্যবহারের বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান, লাভ, মজুরি বা সেবার ভাড়া।
আল-হামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশে ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো, ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম, সেন্টাল শরিয়াহ্ বোর্ড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোসহ প্রায় সব ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে ইসলামী ব্যাংকের ওপর ইজতিহাদী (গবেষণা) মূলক কার্যক্রম বিদ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ইসলামি ব্যাংকিং আইন ও ‘আন্তর্জাতিক মানসম্মত ইসলামিক ব্যাংকিং রিসার্চ সেন্টার’ গঠন করা উচিত। সমন্বিত ইজতিহাদি চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামি অর্থনীতি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। যেসব প্রচলিত ব্যাংক ইসলামি পদ্ধতিতে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করার জন্য ইসলামি শাখা বা উইন্ডো খোলার অনুমতি চায় তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করা। মাকাসিদ আশ-শারিয়াহর আলোকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামি ব্যাংকিং বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ, ব্যাংক কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা, বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সময়ের দাবি। পরিশেষে আল কোরআন, হাদিস ও ইজতিহাদির মাধ্যমে ইসলামি আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়াই আমাদের কাম্য।
তথ্যসূত্র:
# মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ‘ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা’ সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ।
# আবু তালিব মোহাম্মদ মনওয়ার ‘শরিয়াহ মাকাসিদের তাত্ত্বিক বিকাশ: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, Islami Ain Bichar Vol. 13, Issue 51& 52 July-Sept. & Oct.-Dec ২০১৭
# ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী ‘ইসলামি শরিয়াহর এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য: বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব’ ২০১২-১৪৩৪, ইসলাম হাউস।
# মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ‘মাকাসিদ শরিয়াহর আলোকে ব্যাংকিং ও করণীয়’। দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১১ জুলাই ২০১৫
# ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. ‘ইসলামি ব্যাংকিং’ জনসংযোগ বিভাগ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত, ২০১৫
# ড. মো. হাবিবুর রহমান ‘মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ’ বাংলাদেশ ইসলামি ল’রিসার্চ অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার-২০১৮
# ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া ‘দারিদ্র্যবিমোচন ও মানবকল্যাণে জাকাত’ সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট
# ইমাম বুরহান উদ্দিন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর (রহ.) ‘আল-হিদায়া’ তৃতীয় খণ্ড।
# www.google.com
লেখকঃ ড. মো. গোলাম মোস্তফা: অফিসার, ইসলামি ব্যাংকিং ডিভিশন, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড।