ইসলামী ব্যাংকিং

মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ৮ম পর্ব

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ইতোমধ্যে সাত পর্ব পোস্ট হয়েছে, পাঠকগণও নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। পাঠকগণের আগ্রহে প্রতিটি পর্বে গ্রন্থ সমালোচনার চেয়ে ইসলামী ব্যাংকিং এর স্পিরিট ও কর্মপদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে লিখার পরিসর বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করেছি। আল্লাহ তৌফিক দিন।

সুদের জন্য কুরআন মাজীদে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘রিবা’। আরবী ‘রিবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। কিন্তু সকল প্রকার বৃদ্ধিকে রিবা বলা হয়নি এবং হারামও করা হয়নি। বস্তুতঃ কুরআন মাজীদে এক বিশেষ অর্থে ‘রিবা’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। রিবার অর্থ ও সমন্বিত সংজ্ঞা আভিধানিক অর্থ নির্ভরযোগ্য অভিধানসহ আল-কুরআনের তাফসীরকার, হাদীসবিশারদ, ফিকাহবিদ, স্কলার ও অর্থনীতিবিদ সকলেই একমত যে, রিবা শব্দের অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, উদ্বৃত্ত (Surplus), বেশি, সম্প্রসারণ, প্রবৃদ্ধি, উঁচু হওয়া, ফুলে উঠা, লাভ (Gain), বহুগুণ হওয়া, ছাড়িয়ে যাওয়া, পাওনার চেয়ে বেশি নেওয়া, একদিকে বৃদ্ধি অন্যদিকে বৃদ্ধি ছাড়াই ইত্যাদি।

আল্লামা মওদূদী রহঃ বলেছেন যে, “রিবা শব্দের মূলে আছে আরবী ভাষার (‘রা-বা-ওয়াও’) এই তিনটি হরফ। কুরআন মাজীদে এই মূল থেকে নির্গত শব্দাবলী যত জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে সেই সকল স্থানেই এ থেকে বৃদ্ধি, উচ্চতা, বিকাশ ইত্যাদি অর্থ পাওয়া যায়।”

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ আপীলেট বেঞ্চের ঐতিহাসিক এক রায়ে বলা হয়েছে, “In the Quran, the word signifies to rise’, ‘at a height’, ‘to increase’, ‘to prosper’, ‘to swell’, ‘to nurture’, to raise’, ‘to grow’, and ‘augmentation’ or ‘increase in power”.

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আল-কুরআনে ব্যবহৃত শব্দাবলী থেকে তিন ধরনের বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়:
১. নিজ পরিমাণে বৃদ্ধি,
২. তুলনামূলক বৃদ্ধি এবং
৩. মানগত বৃদ্ধি।

সামি হামুদ বলেছেন, “এই বৃদ্ধি খাঁটি ভাষাগত অর্থে কোন বস্তুর নিজ পরিমাণ বেড়ে যাওয়া হতে পারে, অথবা দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনামূলকভাবে একটির পরিমাণ অপেক্ষা অপরটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীসেও রিবা শব্দের এরূপ বিভিন্ন দিক থেকে বৃদ্ধি অর্থ পাওয়া যায়।

এক হাদীসে কতিপয় সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে, “একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁদের খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। তাঁরা যখন খাচ্ছিলেন তখন দেখলেন, খাদ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে একজন সাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, পাত্র থেকে যে পরিমাণ খাবার তুলে নেওয়া হচ্ছিল, নিচ থেকে খাবার বৃদ্ধি পেয়ে তত পরিমাণ আবার পূরণ হচ্ছিল।” উক্ত সাহাবী এখানে ‘রাবা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং এর দ্বারা খাদ্যের নিজস্ব পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে বুঝিয়েছেন।

আরও দেখুন:
✓ মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ৭ম পর্ব

দেখা যাচ্ছে, রিবা শব্দের মধ্যে উপরোক্ত তিন ধরনের বৃদ্ধিই সন্নিহিত আছে। অর্থাৎ রিবা অর্থ বৃদ্ধি; এই বৃদ্ধি পরিমাণগত হতে পারে, মানগতও হতে পারে; আবার অপর বস্তুর তুলনায় পরিমাণ ও গুণগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়াও এর অর্থ হতে পারে। রিবার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Interest ও Usury. Interest মধ্য যুগীয় ল্যাটিন শব্দ Interesse থেকে নির্গত হয়েছে। আর ল্যাটিন শব্দ Usura থেকে এসেছে Usury Interesse অর্থ হচ্ছে আসলের ওপর বৃদ্ধি। Usura মানে হচ্ছে প্রদত্ত ঋণ থেকে অর্জিত উপভোগ (Enjoyment); ক্যানন ল’তে এর মানে হচ্ছে অর্থ ধার দিয়ে তার বিনিময়ে আসল পাওনার ওপর অতিরিক্ত গ্রহণ করা।

ফক্বীহ ও বিশেষজ্ঞগণ রিবার যেসব সংজ্ঞা দিয়েছেন তন্মধ্যে ইমাম সারাখসী প্রদত্ত সংজ্ঞাকেই সর্বব্যাপী, উত্তম ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা বলা যায়। তাঁরা রিবার অর্থ করেছেন অতিরিক্ত, বৃদ্ধি, Excess (ফদল), বিনিময়হীন বৃদ্ধি, Excess without counter value ইত্যাদি। তাদের মতে, “ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতিমূল্য (Counter Value) নেই এমন প্রতিটি বৃদ্ধিই হচ্ছে রিবা।

ইমাম সারাখসী সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “শরীয়তে রিবা হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ে দু’টি প্রতিমূল্যের কোন একটির ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত (ফদল) যার কোন বিনিময় নেই। (সারাখসী, আল-মাবসুত, ভলি – ১২, পৃ: ১০৯)

মালিকী মাযহাবের প্রখ্যাত ফক্বীহ ইবনে আরাবী বলেছেন, “বদলা বা সমান প্রতিমূল্য দেওয়া হয় না এমন প্রত্যেক বৃদ্ধিই রিবা। তিনি আরও লিখেছেন, “রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, আর কুরআনের আয়াতে রিবা দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৃদ্ধি ‘যিয়াদা’-কে বুঝানো হয়েছে যার সমমূল্যের কোন কাউন্টার ভ্যালু বা বিনিময় ‘ইওয়ায়’ নেই। (আল-নিহায়া ফী শরহি হিদায়া, ভলি-২, পৃ: ৫২৪)

বিনিময় যা সমতুল্য কাউন্টার ভ্যালু বা রিটার্ন ‘ইওয়াদ’ ছাড়া।) এ ব্যাপারে সানআনী লিখেছেন, “ভাষাগত অর্থে রিবা হচ্ছে ফদল বা অতিরিক্ত যা মুয়াবাদা বাটার বা পণ্য-সামগ্রী ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির শর্ত অনুসারে অপরপক্ষের জন্য কোন বদলা (ইওয়ায়) বা সমমূল্যের প্রতিদান বয়ে আনে না। এম, নূরের মতে, এই সংজ্ঞানুসারে মূল্যের ওপর যে কোন বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে রিবার আওতাভুক্ত।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রিবা উদ্ভূত হওয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে ক্রয় বিক্রয়। দু’টি একজাতের মুদ্রা, পণ্য বা সেবা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করলে স্থগিতকৃত কাউন্টার ভ্যালু হয় ঋণ, ঋণের ওপর সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত বিনিময়হীন অতিরিক্তকে বলা হয়েছে রিবা। অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতের অর্থ, পণ্য বা সেবা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হলে স্থগিতকৃত কাউন্টার ভ্যালু হয় দেনা/পাওনা। এই দেনা/পাওনার ওপর সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত অতিরিক্তকে বলা হয় রিবা।

রিবার শ্রেণীবিন্যাস ফিকাহশাস্ত্রে রিবাকে প্রধানত রিবা নাসীয়াহ্ ও রিবা ফদল এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকার রিবার সংজ্ঞা পৃথক পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে তো শুধু ‘রিবা’ ও ‘আল রিবা’ আছে। আর হাদীসে বলা হয়েছে রিবা হচ্ছে ‘ফদল’ বা বৃদ্ধি; আবার বলা হয়েছে, ‘নাসীয়াহ ব্যতীত রিবা হয় না’, ‘যা নাসীয়াহ তাই রিবা’। বুঝা যাচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) রিবা শব্দের অর্থ করেছেন ফদল (বৃদ্ধি)। আর রিবা হওয়ার কারণকে বলেছেন নাসীয়াহ্, যার অর্থ হচ্ছে বিনিময়হীনতা। এ থেকে রিবার দু’টি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে: একটি হচ্ছে ফদল বা বৃদ্ধি, অপরটি হচ্ছে নাসীয়াহ বা বিনিময়হীনতা৷

নাসা – To put off, Postpone, Delay, Defer, Procrastinate নিভিয়ে দেওয়া, বাতিল করা, স্থগিত করা, বিলম্বিত করা, মুলতবি করা, গড়িমসি করা। আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধানে ‘নাসীয়াহর’ অর্থ লিখা হয়েছে, পরিশোধে বিলম্ব, পরিশোধের জন্য প্রদত্ত সময়, বাকি, ধার।

ড. চাপরা লিখেছেন, নাসায়া শব্দের অর্থ হচ্ছে সময়, মেয়াদ বা অবকাশ। ঋণ বা দেনা পরিশোধ করার জন্য ধার্যকৃত প্রদত্ত মেয়াদকে বলা হয় নাসায়া। ইংরেজীতে একে বলা হয় Waiting আর বাংলায় বলা হয় প্রতীক্ষা। ঋণ ও বাকি প্রদান করে তার কাউন্টার ভ্যালু ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, এজন্য দেনা ও ঋণকে বলা হয় Waiting বা প্রতীক্ষা। সুদী ঋণে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, ঋণ বা দেনা পরিশোধের জন্য নির্ধারিত মেয়াদ এবং পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী বর্ধিত মেয়াদের ওপর এত হারে সুদ ধার্য করা হবে। এভাবে সময় বা মেয়াদের বিনিময় হিসেবে এ রিবা ধার্য করা হয় বলে একে বলা হয় রিবা নাসীয়াহ বা মেয়াদী সুদ।

ইংরেজীতে একে বলা হয় Reward for waiting or time value of money প্রতীক্ষার প্রতিদান বা অর্থের সময়ের মূল্য।সুতরাং ঋণ বা দেনার ওপর মেয়াদ বা সময়ের ভিত্তিতে ধার্যকৃত রিবা হচ্ছে রিবা নাসীয়াহ্। জাহিলী যুগে এই ধরনের রিবা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং সকলেই একে রিবা বলে জানত। সেই জন্য কেউ কেউ একে বলেছেন রিবা আল-জাহিলিয়্যাত।

কুরআন নাযিলের সময় আরবে নিম্নোক্ত তিন ধরনের সুদী লেনদেনের প্রচলন ছিল:
১. এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির নিকট কোন জিনিস বিক্রি করতো এবং দাম পরিশোধের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতো। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর যদি দাম পরিশোধ না হতো, তাহলে তাকে আবার অতিরিক্ত সময় দিতো এবং প্রাপ্য দামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতো।
২. একজন অন্যজনকে ঋণ দিতো। ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে চুক্তি হতো যে, অমুক সময়ের মধ্যে আসল থেকে এত পরিমাণ অর্থ বেশি ফেরত দিতে হবে; এবং
৩. ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটি বিশেষ সময়সীমার জন্য একটি বিশেষ হার স্থিরীকৃত হয়ে যেতো। সেই সময়সীমার মধ্যে বর্ধিত অর্থসহ আসল অর্থ পরিশোধ না হলে পূর্বের চেয়ে বর্ধিত হারে পরিশোধের শর্তে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হতো।

মওদূদী রহঃ তার “সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং” এ লিখেছেন যে, সুদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ৩টি:
১. ঋণের আসল পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া;
২. সময়ের অনুপাতে আসল বৃদ্ধির সীমা, পরিমাণ বা হার নির্ধারিত হওয়া এবং
৩. উপরের দুটিকে শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা।

তিনি বলেছেন, “ঋণ সংক্রান্ত যে কোন লেনদেনের ক্ষেত্রে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলে তা নিঃসন্দেহে সুদী লেনদেনে পরিণত হবে। এতে ঋণের উদ্দেশ্য এবং ঋণগ্রহীতা ধনী বা দরিদ্র যাই হোক তাতে কারবারের আসল চরিত্রে কোন পার্থক্য হবে না।”

ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী আল-বাদাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “রিবা হচ্ছে ঋণ প্রদান গ্রহণ কালে কৃত চুক্তি অনুসারে আসলের ওপর ধার্যকৃত সুদ (Interest); এ ছাড়া দেনাদার যদি ঋণ বা দেনার চুক্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ/দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রতি বর্ধিত মেয়াদের জন্য ঋণ/দেনার আসলের ওপর আরোপিত সকল অতিরিক্তই রিবার মধ্যে শামিল।”

আর ড. উমর চাপরা লিখেছেন, “শরয়ী পরিভাষায়, রিবা সেই অতিরিক্তকে (Premium) বুঝায় যা ঋণের শর্ত হিসেবে অথবা ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির দরুন ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে তার প্রদত্ত ঋণের আসলসহ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।”

আধুনিক বিশ্বের প্রখ্যাত উলামায়ে কিরাম, বিশেষজ্ঞ ও স্কলারদের বিভিন্ন সম্মেলন ও বৈঠক হতেও সর্বসম্মতিক্রমে রিবার অনুরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC) ও রাবেতা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে কায়রোতে এবং ১৯৮৬ সালে মক্কায়। এ সম্মেলনসহ অনুষ্ঠিত সকল সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতভাবে রিবা সম্পর্কে উক্তরূপ রায় দেওয়া হয়েছে। সুতরাং রিবাকে ভিন্নতর অর্থে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই।

পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শরীয়াহ আপীলেট বেঞ্চ-এর রায়ে বলা হয়েছে: “বিচারপতি খলিলুর রহমান খান, বিচারপতি ওয়াজীহুদ্দীন আহমদ ও বিচারপতি মাওলানা মুহাম্মদ তাকী উসমানী কর্তৃক লিখিত পৃথক পৃথক তিনটি রায়ে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ কারণসমূহের প্রেক্ষিতে এ মর্মে ঘোষণা করা যাচ্ছে যে, ভোগ বা উৎপাদন যে উদ্দেশ্যেই হোক, নির্বিশেষে সকল ঋণ বা দেনার চুক্তিতে আসলের ওপর ধার্যকৃত, কম হোক বেশি হোক, যে কোন অতিরিক্তই হচ্ছে আল-কুরআনে হারাম ঘোষিত রিবা।

সুতরাং রিবা কেবল একটি সংকেত %-ই নির্দেশ করেনা অথবা তা বাজার প্রচলিত সুদের হারের সাথে সংগতিপূর্ণ হলেই সুদ নির্দেশ করেনা। সুদের বৈশিষ্ট্যগুলো অব্যাহত রেখে আপনি যদি “শুন্য হার” এ ও ৠণ দেন, টাকাকেই পণ্য বিবেচনা করেন এবং সে ৠণ পরিশোধের শর্তে শুন্যহারও প্রয়োগ করেন তবে তাও সুদের সমপর্যায়ের লেনদেন হতে বাধ্য। ইউরোপ আমেরিকা ও জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরনে এমন শুন্যহার সুদের ৠণকে তবে কি হালাল বলা যাবে যেহেতু সেখানে আসলের উপর কোন বাড়তি নেয়া হয়না?

মোহাইমিন বলেছেন- অনেকে মনে করে কোনো চুক্তিতে সুদের হার নির্দিষ্ট না থাকলে তা সুদ হবে না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এমন চিন্তার ইসলামি বা জাগতিক কোনো ব্যাখা নেই। আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় সুদের কারবার যেমন লাইবর রেট, ফেড ফান্ড রেট ইত্যাদি দেখেন; খেয়াল করে দেখবেন, তাদের সবগুলোই সময়ের সাথে তারতম্য করছে। অর্থাৎ, রেট তারতম্য করলে যদি কোনো বস্তু সুদ না হতো পৃথিবীতে সুদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেতে কষ্ট হয়ে যেত। অর্থাৎ, সুদ ফিড বা তারতম্যশীল উভয়ই হতে পারে।

আমরাও বলি যে সুদের হারের তারতম্য হলেই তা হালাল হবেনা আবার মুনাফার হারও কমবেশী করলে তাও হালাল হবে না। বিষয়টি অবশ্যই হার বা % নিয়ে নয়। যে কোন ব্যবসা হালাল হতে হলে-পণ্যের উপস্থিতি, ক্রেতা বিক্রেতার ইযাব কবুল, পণ্য হস্তান্তর, সুনির্দিস্ট চুক্তি বাঞ্চনীয়। আপনি পণ্য বেচাকেনা না করে শুধু ৠণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং মেয়াদ শেষে আসলের সাথে লাভ যোগ করে দিলেন- বাহ্যতঃ এটি ব্যবসা হলেও ইসলামে এটা হারাম। আর এ জাতীয় কারবারই কুরআনে সুদের লেনদেন হিসাবে বারণ করা হয়েছে।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button