ইসলামী ব্যাংকিং

ওয়েটেজ ভিত্তিক বনাম আইএসআর ভিত্তিক মুনাফা বন্টন

প্রয়োজন ইসলামী ব্যাংকিং এর জন্য স্বতন্ত্র আইন

তাইফুর রহমানঃ বর্তমানে সারা বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং এ আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ধরণের নীতি ব্যাপকভাবে অনুসৃত হচ্ছে। একটি হচ্ছে মুদারাবা পদ্ধতি আর অন্যটি হচ্ছে আল অদী‘য়াহ্ পদ্ধতি। মুদারাবা পদ্ধতিতে যে আমানত সংগ্রহ করা হয় সেই আমানতের উপর লভ্যাংশ বিতরণ করার জন্য বাংলাদেশে দুইটি মডিউল অনুসরণ করা হয়। একটিকে বলা হয় ওয়েটেজ ভিত্তিক এবং অন্যটিকে বলা হয় ইনকাম শেয়ারিং রেশিও (আইএসআর) ভিত্তিক। ১৯৮৩ সালে যখন প্রথমবারের মত বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর যাত্রা আরম্ভ হয় তখন ওয়েটেজ পদ্ধতির মাধ্যমে মুনাফা বন্টন করা হয় এবং আজ অবধি সেই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে দুইটি স্তরে হিসাব সম্পন্ন করা হয়। প্রথম ধাপে অস্থায়ী রেটে মুনাফা বন্টন করা হয় এবং বছর শেষে চূড়ান্ত মুনাফা সমন্বয় করা হয়। এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আমানত প্রডাক্টের ধরণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রডাক্টের উপর ভিন্ন ভিন্ন ওয়েটেজ (অগ্রাধিকার) প্রদান করা হয় যাতে অধিকতর কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়।

সময়ের পরিক্রমায় ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিকশিত হতে থাকে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আমানতকারীদের মধ্যে মুনাফা বন্টনের জন্য ওয়েটেজ পদ্ধতির পাশাপাশি ইনকাম শেয়ারিং রেশিও পদ্ধতি আলোচনায় আসে। এক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন এম আজিজুল হক (১৯৩৫-২০২০) যিনি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর পথিকৃৎ হিসেবে সমধিক পরিচিত। অবশ্য এদেশে যখন ওয়েটেজ পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং চর্চা শুরু হয় তখন তিনিই এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই পদ্ধতিতে দুইটি স্তরের পরিবর্তে একটি স্তরেই হিসাব সম্পন্ন করতে হয় এবং প্রতি মাসের শেষে প্রাপ্য মুনাফার নির্ধারিত অংশ (গ্রাহকের সাথে চুক্তি অনুযায়ী) গ্রাহককে প্রদান করা হয়। যার ফলে অস্থায়ী রেট প্রদান করা ও হিসাব সমন্বয় করার প্রয়োজন হয় না। গ্রাহক একবারেই চূড়ান্ত মুনাফা পেয়ে যায়।

আরও দেখুন:
◾ ইসলামি ব্যাংক কী ঘুরিয়ে খায়?

মু. আযীযুল হক তার লিখিত বই “ইসলামী ব্যাংকিং-এ মুনাফা বন্টন” এর মধ্যে ওয়েটেজ পদ্ধতির বাস্তব সম্মত কিছু সমস্যা তুলে ধরেছেন। তিনি দুই পদ্ধতির মধ্যে তুলনামূলক একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে কোন কোন ব্যাংক ওয়েটেজ পদ্ধতিতে অস্থায়ী মুনাফা প্রদান করার পর পরবর্তীতে মুনাফা সমন্বয় না করেই চূড়ান্ত হিসাব সম্পন্ন করেছে। পক্ষান্তরে আইএসআর পদ্ধতিতে একবারেই মুনাফা প্রদান করা হয় বিধায় মুনাফা সমন্বয় করার প্রয়োজন নাই। সুতরাং এক্ষেত্রে শরী‘আহ্ লংঘনের সম্ভাবনা থাকে না। ওয়েটেজ পদ্ধতির আর একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে গ্রাহকগণ সহজে ওয়েটেজের ব্যবহারিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন না যদিও ব্যাংকারগণ এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ওয়াকিবহাল থাকেন। আইএসআর পদ্ধতিতে গ্রাহক মুনাফা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা পেয়ে থাকেন কারন মাস শেষে চূড়ান্ত মুনাফা পেয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ কোন গ্রাহক ১০০(একশত) টাকা ব্যাংকে মুদারাবা পদ্ধতিতে আমানত রাখল। মাস শেষে ব্যাংক এই ১০০(একশত) টাকা বিনিয়োগ করে ১০(দশ) টাকা মুনাফা অর্জন করল। চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক এই অর্জিত মুনাফার ৮০% অর্থাৎ ৮(আট) টাকা গ্রাহককে চূড়ান্ত ভাবে প্রদান করবে এবং বাকী ২০% অর্থাৎ ২(দুই) টাকা দ্বারা ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা খরচ মিটাবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ইসলামী ব্যাংকগুলোকে তত্ত্বাবধান করার নিমিত্তে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মত একটি গাইডলাইন প্রদান করে। আইএসআর মডিউল এর ধারনা ব্যাপকভাবে আলোচিত না হওয়ার কারনে তখন গাইডলাইনের মধ্যে এটি যুক্ত করা হয় নাই। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ আই এস আর পদ্ধতিকে গাইডলাইন এর অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে। উল্লেখ্য, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সেন্ট্রাল শরী‘আহ্ বোর্ড এবং ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম ও আইএসআর-এর ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি নিয়ে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে এটির বাস্তবায়ন দৃষ্টিগোচর হবে। ফলশ্রুতিতে কিছু ব্যাংক তাদের ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম আইএসআর পদ্ধতিতে পরিচালনা করছে এবং আরও কিছু ব্যাংক এই পদ্ধতিতে মুনাফা বন্টনের কাজ সম্পন্ন করার জন্য চিন্তা ভাবনা করছে। এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ওয়েটেজ পদ্ধতির পাশাপাশি আইএসআর পদ্ধতিকে অন্তর্ভূক্ত করে গাইডলাইন প্রকাশ করে তাহলে ব্যাংকগুলো তাদের সুবিধা অনুযায়ী যে কোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।

ওয়েটেজ ভিত্তিক মডিউলের ক্ষেত্রে আমানতকারীদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ওয়েটেজ দেয়া হয় কিন্তু সবার ক্ষেত্রে ব্যাংকের অংশ একই থাকে। কোন এক গ্রুপের ওয়েটেজ বৃদ্ধি করলে অন্য গ্রুপের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব পড়ে যদিও ব্যাংকের রেশিওতে কোন হেরফের হয় না। আইএসআর হচ্ছে এমন এক বিশেষ পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকগুলো বন্টনযোগ্য বিনিয়োগ আয় একটা নির্দ্দিষ্ট রেশিও অনুযায়ী নির্দ্দিষ্ট সময়ের শেষে মুদারাবা আমানতকারীদের মধ্যে বন্টন করে থাকে কিন্তু নির্দ্দিষ্ট কোন রেট উল্লেখ করা থাকে না। প্রতি মাসেই রেট আপডেট করা যায় বলে এটি নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে কোন রেট সংক্রান্ত স্পর্শকাতরতা কাজ করে না। দুইটি পদ্ধতিই যেহেতু শরি‘আহর মানদন্ডে উন্নীত এখন দেখার বিষয় কোনটি সর্বাধিক কল্যাণকর সাধারণ গ্রাহকদের জন্য। ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব নীতিমালার আলোকে শরি‘আহ্ সম্মত যে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।

ইসলামী ব্যাংকিং এর তাত্ত্বিক বিষয়ের অধিকতর গবেষণা এখন সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। কুরআন এবং সুন্নাহ গবেষণা করে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি যেমনটি শুরু হয়েছিল মানুষকে সুদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য ঠিক তেমনভাবেই মানুষের সর্ব্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অধিকতর গবেষণা পরিচালনা করা উচিত যাতে ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত স্বতন্ত্র একটি আইন প্রণয়ণ করতে কর্তৃপক্ষ উদ্বুদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এর অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত। সেন্ট্রাল শরি‘আহ্ বোর্ড একটি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি পরিপূর্ণ আইন থাকলে নতুন যে তাত্ত্বিক বিষয়গুলো সামনে আসছে এগুলোর ব্যবহারিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হত বলে ইসলামী ব্যাংকের বোদ্ধারা মনে করেন। এটি খুবই দুঃখজনক যে ইসলামী ব্যাংকিং এর চার দশক পার হয়ে গেলেও এই শিল্পের সাথে জড়িতরা এখনও একটি আইন পান নাই যার ভিত্তিতে তারা এই শিল্পের বিকাশের জন্য আরও সামনে এগিয়ে যেতে পারে। রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পের জন্য একটি পৃথক আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি আইন প্রণয়ন করা হলে ইসলামী ব্যাংকিং শিল্প যেমন গতি পাবে তেমনিভাবে জাতীয় অর্থনীতি আরও বেশি বিকশিত হবে।

লেখকঃ তাইফুর রহমান, ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button