বিশেষ কলাম

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদঃ বাংলাদেশের আর্থিক খাত বলতে আমরা সাধারণত ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বুঝি। একটা হচ্ছে ব্যাংক, আরেকটা হচ্ছে নন-ব্যাংক ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন। তবে এগুলোকে সাধারণভাবে লিজিং কম্পানি বা ঋণ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ব্যাংকগুলো সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়।

ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়ে আলোচনা হয়। একটা অত্যন্ত জরুরি অংশ কিন্তু এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলো আমাদের বাংলাদেশের ১৯৯৪ সালের ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন রেগুলেশনের আওতায় নিবন্ধিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এটার নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শন করে থাকে। ব্যাংকের মতো এগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন।
বর্তমানে আমাদের দেশে আনুমানিক ৩৪টা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে। অবশ্য এরই মধ্যে আরো দু-একটা লাইলেন্স দেবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক চিন্তা করছে, যদিও এদের অর্থের পরিমাণ কম, তবে এগুলো কিন্তু আমানতকারী এবং ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এদের মূল কাজ হলো মেয়াদি ঋণ দেওয়া, লিজ অর্থায়ন করা, রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ। মোটামুটি এদের কাজগুলো ব্যাংকের মতোই।

তবে তাদের নিয়ম-কানুন ব্যাংকের চেয়ে একটু অন্য রকম। এদের পেইডআপ ক্যাপিটাল হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা, ব্যাংকের যেমন ৪০০ কোটি টাকা। আমরা যদি এদের কার্যকলাপ লক্ষ করি তাহলে দেখব, বর্তমানে বেশ কয়েকটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সমস্যাসংকুল। কারো কেলেঙ্কারি আছে। আমরা পি কে হালদারের নাম শুনেছি। তিনি কয়েকটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু খুব বেশি সুবিধাজনক পর্যায়ের না। তাদের অনেকেই অর্থসংকটে আছে। তারা ডিপোজিট পাচ্ছে না বা লোন আটকে গেছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ এত কম, তারা ভালো একজন প্রধান নির্বাহী বা প্রধান ফিন্যানশিয়াল অফিসার নিয়োগ দিতে পারে না। এরা কোনো রকমে নিভু নিভু করে জ্বলছে।

এত প্রতিষ্ঠান কেন? ব্যাংকেরও দেখি অযৌক্তিক সংখ্যা। অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু ব্যাংকের পারমিশন দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পেয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে এদের সংখ্যা কম। লোকজন এদের কাছে টাকা আমানত রেখেছিল। অনেকের টাকা আটকে গেছে। এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো তাদের অর্থের সোর্স তিন মাসের কম এফডিআর নিতে পারে না। তারা ব্যাংকের মতো নিয়মিত সঞ্চয় নিতে পারে না। তিন মাসের কমে এফডিআর বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ জন্য এদের অর্থের সোর্সটা কম। অনেক সময় এরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। আবার কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে। সেখানেও তাদের আবার ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এদের আরেকটা বিশেষ দিক হলো, যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় বা আমানতকারী থেকে এফডিআর নেয়, সেখানে কিন্তু সুদের হার বেশি দিতে হয়। কারণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এতে তাদের খরচ বেড়ে যায়। তাদের লায়াবিলিটির কারণে প্রফিট অনেক কমে যায়। এটাও কিন্তু তাদের অস্তিত্ব বা তাদের টিকে থাকার পথে প্রধান অন্তরায়।

আমরা দেখি যে বাংলাদেশে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থের উৎসর মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আমানত। এই আমানত এবং অন্যান্য উৎস থেকে ধার করা অর্থের ওপর প্রদেয় সুদের হার বেশি অর্থাৎ তাদের তহবিল খরচ বেশি। তারা প্রধানত যে ঋণগুলো দেয়, সেগুলো গতানুগতিক। ব্যাংক যে রকম ঋণ দেয় ব্যবসা-বাণিজ্যে, এগুলো কিন্তু তারাও দেয়। অর্থাৎ ব্যাংকের সঙ্গে তারা প্রতিযোগিতা করে কাজ করছে। যেগুলো ভালো করছে, তাদের খেলাপি ঋণ কিন্তু কম, ৫-৬ শতাংশের মতো। এগুলো ছাড়া বাকিগুলোর খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।

এখন সমস্যাগুলো যেটা প্রথমত, তাদের তহবিলের অপর্যাপ্ততা। সাম্প্রতিক সময়ে মনে হচ্ছে, তাদের ওপর মানুষের আস্থার অভাব। আস্থার জায়গাটায় তারা ব্যর্থ হয়েছে, যার কারণে লোকজন আর টাকা-পয়সা রাখতে চায় না। অতএব, তাদের সোর্স অব ডিপোজিটটা কমে গেছে। এটা তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও দেখুন:
◾ সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু

দ্বিতীয়ত, আর্থিক প্রতিনিধির প্রডাক্টগুলো সীমিত। এগুলোর কোয়ালিটি এবং তাদের কর্মক্ষেত্রের বিস্তারও তেমন সন্তোষজনক নয়। সর্বসাকল্যে তাদের ব্রাঞ্চ ২৫০টা আছে, তারা কিন্তু লোকাল লেভেলে বেশি কাজ করতে পারে না। ব্যাংক কিন্তু সেটা পারে, ব্যাংক এজেন্ট টাইপের লোক নিয়োগ করে, যারা ডিপোজিটটা নিয়ে আসে, তারা কমিশন পায়। এ রকম কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পারে না। এটা তাদের আউটফিট, কোয়ালিটি এবং তাদের ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট দুর্বলতা।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রেগুলেশন বা নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ, এটা অনেক দুর্বল। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এর পরও ব্যাংকের সমস্যা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কোনো তথ্য, কার্যকলাপ ও সমস্যা সম্পর্কে মিডিয়ায়ও তেমন আসে না। এটার কারণে কিছু ঘটনা ঘটেছে; দুর্বলতা, করাপশন নিয়ে ধরা পড়েছে; বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সব দিক দিয়ে এগিয়ে আসা। নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি জোরদার করা।

ভালো যে কয়টা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, তারাও আবার যেকোনো সময় সমস্যায় পড়তে পারে। কারণ আমরা দেখেছি, প্রতিষ্ঠানের খুব নামদাম ছিল; তারাও আবার হঠাৎ করে একেবারে বসে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এ খাতে সবিশেষ নজর দেওয়া।

বিশেষ করে আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মানে তাদের লোন দেওয়ার ব্যাপারে, তাদের লিকুইডিটির যে ক্রাইসিসটা আছে, এ ব্যাপারে সাহায্য করা যেতে পারে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক স্মল এন্টারপ্রাইজে, উইমেন এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন আর্থিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পুনরর্থায়ন অর্থাৎ রিফিন্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসতে পারে। স্বল্পবিত্ত বা মধ্যবিত্ত লোকের গৃহঋণের ব্যাপারে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক পুনরর্থায়ন করতে পারে। এ জিনিসগুলো কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ব্যাংকগুলো অনেক সময় এদের ঋণ দেয় না। বিশেষ করে ছোট শিল্প, মাঝারি শিল্প এবং কুটির শিল্পে ব্যাংক খুব উৎসাহী হয় না। আবার নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ব্যক্তির বেলায়ও ব্যাংক তেমন একটা উৎসাহ দেখায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত রিফিন্যান্স করা। কভিড প্যাকেজের অর্থ মূলত ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশ হারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রিফিন্যান্স করলে তাদের তহবিলসংকট লাঘব হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করলে তাদের ওপর জনগণের আস্থাও বৃদ্ধি পায়।

অতএব, এই পলিসিগুলো এখন আমাদের নিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে চলছেই না, তাদের একীভূত করতে পদক্ষেপ নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। বা কোনো একটা ব্যাংকের সঙ্গে বা কোনো একটা ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এটা করা যেতে পারে। এটা করলে হয়তো লোকজনের আস্থা ফিরে আসবে এবং এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। অন্যথায় কভিডের চ্যালেঞ্জ আর বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতার যে চ্যালেঞ্জ, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে আমাদের বেগ পেতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button