বিশেষ কলাম

যুগে যুগে শিল্প বিপ্লব ও ব্যাংকিং পরিষেবা প্রবর্তন

দিনু প্রামানিকঃ যুগে যুগে শিল্প বিপ্লব ও ব্যাংকিং পরিষেবা প্রবর্তন- সম্ভবত খুব বেশি দিন আগের কথা না। কথিত আছে, রাতের রাস্তায় কার দেখা পাওয়া যায়। হয় ব্যাংকার না হয় ড্র্যাংকার। সেই সময়ে ব্যাংকারগণ ব্যাংকে দীর্ঘ সময় কাজ করতেন, কখনও কখনও মধ্যরাত পর্যন্ত। আর গ্রাহক সেবা পেতো সকাল নয়টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত দুপুরে বিরতির অপেক্ষা সহ। ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দেখা যেত লম্বা লাইন। টিটি, ডিডি, এমটি করতে ব্যাংকার আর গ্রাহক গলদ ঘর্ম হয়ে যেতো। তখন যে টেবিলে যত ফাইলের স্তূপ থাকত হয়তো তিনি তত বড় অফিসার। আর ডিজিটাল যুগে ফাইলবিহীন টেবিল স্মার্ট অফিসার।

এই ডিজিটাল যুগে ব্যাংক খাতের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, বেড়েছে ব্যাংকিং পরিষেবা। এখন ব্যাংকাররা স্মার্ট ব্যাংকিং করে। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ করেন আর গ্রাহকগণ সেবা পান রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা। টিটি, ডিডি, এমটি আর টেস্ট কোড মিলানোর পরিবর্তে এখন রিয়েল টাইম সেটেলমেন্ট অ্যাপসভিত্তিক ব্যাংকিং এখন গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। যুগে যুগে শিল্প বিপ্লব ঘটেছে আর ব্যাংকিং কার্যক্রম এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর এ সময় ঘিরে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জল্পনা কল্পনা। থেমে নেই আমাদের দেশ। প্রযুক্তির সাথে তার মিলিয়ে ছুটে চলছি আমরা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগ সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর আর এর সুফল পাচ্ছে আপামর সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ।

আরও দেখুন:
প্রসঙ্গঃ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা- পক্ষে বিপক্ষে

প্রশ্ন হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কী! নেট ভিত্তিক বিভিন্ন জার্নাল The Fourth Industrial Revolution: what it means and how to respond”। World Economic Forum এবং Industry 4.0? Everything you need to know” হতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত যে ধারণা পাওয়া যায় তা হলো জার্মান সরকারের উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল ধারণা থেকে প্রবর্তিত আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া যা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” সংক্ষেপে আই ৪.০ বা শুধু আই৪ নামেও পরিচিত। স্বয়ংক্রিয়করণ, উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরূপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরি করার জন্য বৃহৎ পরিসর মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)কে একত্রিত করা। এটা এমন এক প্রযুক্তি যা হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং বায়োলজি (সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস)কে একত্রিত করবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ টি রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অফ থিংস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস, ডিসেন্ট্রালাজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের এবং সম্পূর্ণ স্ব শাসিত যানবাহন এর ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্রেট রিসেট প্রস্তাবনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব COVID-19 মহামারি পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনের কৌশলগত টেকসই সমাধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

অন্যান্য সেক্টরের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এ থেকে নেই ব্যাংকিং সেক্টর। শুরু হয়েছে প্রযুক্তির এসব ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। তার পূর্বে আরো তিনটি শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে। যুগে যুগে শিল্প বিপ্লব ও ব্যাংকিং কার্যক্রম বিকাশ ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।

প্রথম শিল্প বিপ্লব সূচনা হয় বাষ্প এবং জলশক্তি ব্যবহার করে হস্ত সাধিত শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ায় মেশিন চালিত পদ্ধতিতে রূপান্তর মাধ্যমে। এর সামাজিক প্রভাব মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। বস্ত্র শিল্প, লৌহ শিল্প, কৃষি এবং খনি খনন কাজে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এই সময় কাল তথা ১৬ শতকের শেষের দিকে এবং ১৭ শতকের সময় ব্যাংক ঋণের, যা সোনা এবং রৌপ্য মুদ্রার বিকল্প হিসাবে কাজ করত, পাশাপাশি আমানত গ্রহণ, অর্থায়ন, অর্থ পরিবর্তন এবং তহবিল স্থানান্তর ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং পরিষেবাগুলি চালু হয়। নতুন নতুন ব্যাংকিং পরিষেবা ও কার্যক্রম ব্যাপ্তি বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়নে সহায়তা করেছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সরকারি প্রবিধান জারি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করে এবং এতে ব্যাংকগুলির মধ্যে ব্যাংক নোট ইস্যুসহ অধিকার পায়।

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব হয় প্রযুক্তিগত বিপ্লব সূচনা মধ্য দিয়ে। এ সময় ছিল বিদ্যুতের উৎপাদন, রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্ক ব্যাপক বিস্তার; ফলে মানুষ এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনার দ্রুততর স্থানান্তর বিকাশ ঘটে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যায় বহুগুণে। আর এই সময়কালেই ব্যাংকিং সেক্টরের পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত হয় মানসম্মত মুদ্রিত নোট জারি, ক্লিয়ারিং সুবিধা, নিরাপত্তা বিনিয়োগ, চেক এবং ওভারড্রাফ্ট সুরক্ষা প্রভৃতি।

তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ইন্টারনেট আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে যার ফলে পৃথিবীর সব সেক্টরের ঘটে যায় ডিজিটাল বিপ্লব। এই সময়ে শিল্পায়নের এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পরবর্তী সময়ে আসে জেড ওয়ান কম্পিউটার, যা ফ্লোটিং-পয়েন্ট নাম্বার এবং বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করে হয় হিসাব নিকাশ। এই সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রণয়ন করা হয় মেশিন রিডেবল ক্যারেক্টার, অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম), আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় পরিশোধ জন্য ইলেকট্রনিক্স পেমেন্ট সিস্টেম, সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক মতন শক্তিশালী ব্যাংকিং পরিষেবা নেটওয়ার্ক। আর্থিক পরিষেবা বড় ধরনের পরিবর্তন আসায় বীমা, পেনশন ফান্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, মানি মার্কেট এবং হেজ ফান্ড ও ক্রেডিট এবং সিকিউরিটিজ পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়।

ব্যাংকিংয়ে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোয় ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রথাগত ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে দিকে ধাবিত হয়। বর্তমানে ওপেন ব্যাংকিংয়ের মতো উদ্ভাবন তৃতীয় পক্ষের জন্য ব্যাংক লেনদেন ডেটা অ্যাক্সেস করা সহজ করে দিয়েছে এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) এবং নিরাপত্তা মডেল চালু হয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হল উৎপাদন পদ্ধতিতে এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলন। যার মধ্যে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (সিপিএস), আইওটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস, ক্লাউড কম্পিউটিং, কগনিটিভ কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিগুলি অন্তর্ভুক্ত। যার প্রধান নিয়ামকগুলি হলো- মোবাইল ডিভাইস, ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) প্লাটফর্ম, অবস্থান শনাক্তকরণ প্রযুক্তি তথা বৈদ্যুতিক শনাক্তকরণ, উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস, প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি শনাক্তকরণ, স্মার্ট সেন্সর, বিগ অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া, বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি/ ওয়্যারেবল টেকনোলজি, চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ট্রিগারড লাইভ ট্রেনিং প্রভৃতি। মূলত এই প্রযুক্তিগুলি চারটি প্রধান উপাদানে নিয়ে আসা যেতে পারে, যা “ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” বা “স্মার্ট ফ্যাক্টরি” শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে। যেগুলি হলো-
১. সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম যা ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরি করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা।
২. ইন্টারনেট অফ থিংস সংক্ষেপে আইওটি বলে, যার বাংলা অর্থ হল বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ।
৩. চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা। ও
৪. কগনিটিভ কম্পিউটিং।

বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং পরিষেবা সমূহের উন্নতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকিং পরিষেবা প্রাথমিক কার্যক্রম সমূহ ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। নিজস্ব সক্ষমতায় আন্তঃব্যাংক তহবিল লেনদেন জন্য ওয়্যার ট্রান্সফার এবং ইলেকট্রনিক্স ফান্ড ট্রান্সফার সুবিধা প্রদান করা; গ্রাহক হিসাব থেকে নিয়মিত গ্রাহক কর্তৃক মাসিক ব্যয় লেনদেন স্বয়ংক্রিয় ভাবে সম্পূর্ণ করা; গ্রাহকদের ইন্টারনেট মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ হিসাব দেখতে ও পরিচালনা করার সুবিধার্থে ইন্টারনেট ব্যাংকিং পরিষেবা প্রদান করা; মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা ইলেকট্রনিক্স ফান্ড ট্রান্সফার সুবিধা ব্যবহার করে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে বা মোবাইল ওয়ালেটে অর্থ স্থানান্তর; ইউটিলিটি বিল পরিশোধ যেমন- বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ল্যান্ড ফোন, মোবাইল, টিউশন ফি, ইন্টারনেট বিল ইত্যাদি, অনলাইন কেনাকাটা; হিসাবের বিবরণী অনুসন্ধান; ক্রেডিট কার্ড এর বিল পরিশোধ; বিভিন্ন ডিপজিট স্কিম এ সঞ্চয় ও ইনস্যুরেন্স এর প্রিমিয়াম প্রদান ইত্যাদি। যুক্ত হয়েছে অনলাইন সঞ্চয়পত্র ইস্যু, ভ্যাট-ট্যাক্স এ-চালান, আরটিজিএস, বিইএফটিএন, কেন্দ্রীয় ঋণ ব্যবস্থাপনা, এএমএল স্কীনিং, রিয়েল টাইম, সিআইবি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রভৃতি। আই ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট পরিষেবা’র সুফল ইতিমধ্যে গ্রাহক হাতের নাগালে।

পরিশেষে, একথা বলা যায় যে, যুগে যুগে শিল্প বিপ্লব সংঘটন ফলে আর্থ সামাজিক পরিবর্তন তথা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈদেশিক সম্পর্কে, মানুষে জীবন এবং চিন্তা-চেতনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছে তেমনই ব্যাংকিং সেক্টরের নতুন নতুন পরিষেবা প্রবর্তন হয়েছে যা আপামর সাধারণের সুফল বয়ে আনছে এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে ব্যাংকিং পরিষেবা আরো উতকর্ষতা আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করি।

দিনু প্রামানিক, লেখক ও ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button