বিশেষ কলাম

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশের অগ্রগতি

দীপক কুমারঃ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশের অগ্রগতি- ​​​​​চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির বিপ্লব, যা পৃথিবীর মানুষকে এক লাফেই ১০০ বছর সামনে নিয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, এ পরিবর্তন সব মানুষের জীবনমান উন্নত করবে, আয় বাড়াবে সব শ্রেণীর মানুষের। প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প ও অর্থনীতির সব ক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বগ্রামে পরিণত করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে অভাবনীয় উন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হবে পাড়ার দোকানে কেনাবেচার মতোই সহজ। মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেশির ভাগ সমস্যা নির্ণয়, সমস্যা বিশ্লেষণ, সমস্যার সমাধান, মেশিন টু মেশিন যোগাযোগ, ইন্টারনেট অব থিংস, সম্মিলিতভাবে এসবকেই একত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে বোঝানো হচ্ছে।

অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধু মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে যন্ত্র ও প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে দ্রুততর করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমকে আরো বেশি গতিশীল ও নিখুঁত করে তুলছে। ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসছে এ ভার্চুয়াল জগতেরই আরো বিস্তৃত পরিসর নিয়ে। ক্লাউস সোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে, সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুন:
◾ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ফলপ্রসূ করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, কৃষি খাত, ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসার বিকল্প নেই। আগামীর প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতকেই সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ওই গভর্ন্যান্স, সার্ভিস ডেলিভারি, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিমেনটেশন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিকেন্দ্রীকরণ, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা এবং এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও প্রশাসনিক নীতি কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ক্লাউড সার্ভার, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ৩০ বছরজুড়ে তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার এটাই সব থেকে বড় হাতিয়ার। যেখানে মানুষের আয়ত্তে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট, যা সম্পূর্ণ মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! এ নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে দুনিয়াজুড়ে।

ডিজিটাল বাংলাদেশকে টেকসই করতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, অ্যাডভান্স টেকনোলজি, ইন্সট্রাকশনাল টেকনোলজি Robotics, IT/ITES, Cloud Computing, VLSI (Very-Large-Scale-Integration), Navigation (Vehicle), Hardware Navigation, ই-কমার্স, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, নেটওয়ার্ক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারীভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পেতে সরকার দেশে অনেক হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি তথা আইটিসংক্রান্ত সব ধরনের কাজ সম্পাদন, আইটিকে ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা, আইটি সেক্টরে সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত সব আমদানি-রফতানির সুবিধা নিশ্চিত করা হবে হাইটেক পার্কের কাজ। সরকার এরই মধ্যে সেবাগুলোকে জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছাতে, সেবাপ্রাপ্তিতে নগর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে আনতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বর্তমানে ইউরোপের আইটি কোম্পানিগুলো তাদের কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। টেক জায়ান্ট গুগল প্রায় ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ইলন মাস্ক টুইটারের মালিকানা নেয়ার পর প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। মেটা তার মোট জনশক্তির প্রায় ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করার ঘোষণা দিয়েছে। এতেই ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এরই মধ্যে ইউরোপের অসংখ্য কোম্পানি বাংলাদেশসহ থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশগুলো থেকে সস্তায় প্রযুক্তি শ্রম কেনার দিকে ঝুঁকছে।

জার্মানির বিখ্যাত রিভার্স রিটেইল কোম্পানি তার ই-কমার্স কোম্পানি ভিটা অ্যান্ড ভোগের সম্পূর্ণ টেকনোলজিক্যাল সহায়তা নিচ্ছে বাংলাদেশের বিটবাইট টেকনোলজি কোম্পানি থেকে। এরই মধ্যে তারা তাদের টেকনোলজিক্যাল সব কাজ বাংলাদেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। এভাবেই ইউরোপ-আমেরিকার টালমাটাল অর্থনীতি তাদেরকে দক্ষ জনশক্তি আউটসোর্সিং করতে বাধ্য করছে যা তাদের ব্যবসায়িক খরচ ২০-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনবে। ফলে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বেড়েই চলেছে ক্রমবর্ধমান হারে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যার প্রভাব লক্ষণীয়। বিশ্ববাজারে দেশের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে প্রযুক্তি শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইন শ্রমশক্তির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হচ্ছে ভারত; যাদের প্রায় ২৪ শতাংশ গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সার ওয়ার্কার আছে। এর পরের অবস্থানটিই বাংলাদেশের, অনলাইন শ্রমশক্তিতে যাদের অবদান হচ্ছে ১৬ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যাদের ফ্রিল্যান্সার হচ্ছে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে নিয়মিত কাজ করছে পাঁচ লাখ ফ্রিল্যান্সার। আর মোট নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৬ লাখ ৫০ হাজার। বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর ফ্রিল্যান্সাররা ১০ কোটি ডলার আয় করে থাকেন। দেশীয় অর্থনীতিতে প্রযুক্তি শিল্পের এ অবদান আরো বেশি বেগবান করতে হলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সুদৃঢ় পরিকল্পনার প্রয়োজন। না হলে সময়ের পাল্লায় আমরা প্রতিযোগিতার বাজার থেকে পিছিয়ে পড়ব।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এখন অনেক শিক্ষিত নারীকে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। তাদের জন্যও ফ্রিল্যান্সিং দারুণ সুযোগ। ঘরে বসেই কাজের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশের নারীরা এখন তাদের প্রথাগত সাংসারিক দায়িত্বের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্রিল্যান্স কাজকে ক্যারিয়ার সংকটের সমাধান হিসেবে দেখছে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের নারীরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এখন পুরুষের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। আর নারীদের অংশগ্রহণে এ সেক্টর আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সার সিপিএ মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছে অন্যদিকে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ দখল করে আছে ভারত। প্রতিযোগিতার বাজারে নেতৃত্ব দিতে হলে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের আরো বেশি দক্ষ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার গড়ে তোলার দিকে নজর দেয়া উচিত।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধাক্কায় তাদের ব্যবসায়িক ও প্রাতিষ্ঠানিক অটোমেশনের দিকে নজর দিচ্ছে। বাংলাদেশও এ স্রোতের বাইরে নয়। ফলে আগামীর গতিশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আমাদের বর্তমান তরুণ জনশক্তিকে প্রযুক্তি শিক্ষায় আরো যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবার গতি বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এর দাম কমিয়ে এনে প্রযুক্তির শিক্ষায় সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার যদি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে টেকনিক্যালি আরো বেশি সক্ষম করতে পারে তবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে। দেশ এগিয়ে যাবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সমান তালে। প্রযুক্তির এ বিপ্লব একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, একই সঙ্গে অদক্ষ জনশক্তি তাদের কাজ খুঁজে পেতেও বেগ পেতে হবে। আর যদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে অগ্রাহ্য করে অথবা অবহেলা করে আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনায় এর ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা না হয়, তবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে শত বছর পেছনে।

লেখকঃ দীপক কুমার আঢ্য, ব্যাংকার ও গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button