ব্যাংক গ্রাহকব্যাংকার

গ্রাহক অসন্তুষ্টির কারণ ও ব্যাংকের করণীয় ১

সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। এতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ব্যাংক হিসাব বন্ধ হয়েছে গ্রাহকদের অসন্তুষ্টিজনিত কারণে। অর্থাৎ ব্যাংকের সেবামানে অসন্তুষ্ট হয়ে কিংবা হয়রানির শিকার হয়েই এসব হিসাব বন্ধ করেছে গ্রাহকরা। ২০১৬ সালে মোট গ্রাহকের ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ অসন্তুষ্ট হয়ে ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ১২ শতাংশে। আমাদের দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিআইবিএম একটি বড় নাম। তাই এই গবেষণার ফল সম্পর্কে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। এমন গবেষণা আমাদের ব্যাংক খাতের জন্য খুবই কল্যাণকর।

কিন্তু গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে অনেকেই ব্যাংক এবং ব্যাংকারদের ধুয়ে দিচ্ছেন। ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে ব্যাংকের সেবার মানের কোনো উন্নয়ন হয়নি, মানুষ কোথাও ভালো সেবা পায় না, ব্যাংকে গ্রাহকদের অধিকারের কোনো মূল্য নেই, সব অধিকার ব্যাংকারদের ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আসলেই কি দেশের ব্যাংক তথা ব্যাংকারদের আচরণ এতই জনবিদ্বেষী? যদি তা-ই হবে, তাহলে দেশের ব্যাংকগুলো ব্যবসা করছে কীভাবে? মানুষ ব্যাংক বিমুখ হচ্ছে যদি ধরে নিই, তাহলে একটার পর একটা বেসরকারি ব্যাংক কোন সম্ভাবনা দেখে ব্যবসায় আসছে?

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে জেনেছি পিপলস ব্যাংক ও ‘বেঙ্গল ব্যাংক’ নামে আরও দুটি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এরপর সম্ভবত আসছে পুলিশ মালিকানাধীন পুলিশ ব্যাংকও। এই ব্যাংকগুলো কি আহামরি কোনো সেবা নিয়ে বাজারে আসবে? সেবায় নতুনত্বের শর্তেই হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লাইসেন্স দেবে, কিন্তু তারা নামেমাত্র ব্যাংকিং সেবা নিয়েই বাজারে আসবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বাজার দখল কিংবা বাজার সম্প্রসারণ করতে হলে এই ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই সেবামুখী এবং গ্রাহকবান্ধব হতে হবে। কারণ বিপণন ব্যবস্থাপনার একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে এবং ব্যাংকিং পেশার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, দেশের ৫৮টি (সর্বশেষ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ) তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে বিশেষায়িত, সরকারি এবং গুটিকয়েক বেসরকারি ব্যাংক বাদে বাকি প্রায় সব ব্যাংকই একই ব্যাংকিং পণ্যের ব্যবসা করছে।

ধরা যাক, ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংক (যারা একই হারে আমানত নিচ্ছে কিংবা একই হারে ঋণ দিচ্ছে এবং কাছাকাছি মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে) একজন গ্রাহকের নাগালের মধ্যে। তাহলে ব্যাংকিংয়ের জন্য সেই গ্রাহক কোন ব্যাংকটিকে বেছে নেবেন, কিংবা তার বর্তমান ব্যাংক ছেড়ে কেনই বা আরেক ব্যাংকে সুইচ করবেন? উত্তর খুব সহজ- সেবায় এগিয়ে থাকা ব্যাংকে। আর সেবার এই অগ্রগামিতার কর্মী কে? নিশ্চয়ই ব্যাংকার তথা ব্যাংকারের সেবামান, সেবার মানসিকতা ও মানবিকতা। গ্রাহকদের দৃষ্টিতে ব্যাংকগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরিতে ব্যাংকাররাই সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ব্যাংকগুলো হুবহু একই বা কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের ব্যাংকিং পণ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা করার কারণে তাদের ব্যাংকারদের কারণেই তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড ইমেজ এবং পজিশনিং তৈরি হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বলছিলাম গ্রাহক অসন্তোষ প্রসঙ্গে। বিআইবিএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে সাড়ে ১৬ লাখ ব্যাংক হিসাব বন্ধ হয়েছে গ্রাহকদের অসন্তুষ্টিজনিত কারণে। আচ্ছা, হিসাব বন্ধ করে দেওয়া এই সাড়ে ১৬ লাখ গ্রাহক কি পরবর্তী সময়ে আর কোনো ব্যাংকে হিসাব খোলেননি? নিশ্চয় খুলেছেন। তাহলে এই কারণে গ্রাহক অসন্তোষ বেড়ে গেছে কীভাবে বলি? গ্রাহক তো ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাননি। এক ব্যাংকের সেবা বা পণ্য ভালো লাগেনি। তাই অন্য ব্যাংকে চলে গেলেন। যে ব্যাংকে চলে গেলেন, সেখানে তার সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করছেন বা নিজেকে সন্তুষ্ট মনে করছেন বলেই তো তিনি সেখানে যাচ্ছেন। ব্যাংকগুলো পরস্পর প্রতিযোগী। তাই গ্রাহকদের এই রকম ব্যাংক সুইচ অব্যাহত থাকবেই, এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, এই ব্যাংক বদল ব্যাংক বা ব্যাংকারের কোনো বেআইনি কিংবা গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজের ফল যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

আর যে ব্যাংক গ্রাহক হারাচ্ছে, সেটিকে কারণ অনুসন্ধানপূর্বক সেবাকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। আর যারা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবেন, তারা নিশ্চয় বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সেবা যেমন সঞ্চয়পত্র, অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমএফআই প্রভৃতির দ্বারস্থ হবেন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যাংকের আসলে কিছু করারও থাকে না। যেমন ব্যাংক ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেবে, আর পোস্ট অফিসগুলো নেবে ১১-১২ শতাংশে, তাহলে কোনটি গ্রাহকের নজর আকৃষ্ট করবে? নিশ্চয় ব্যাংক নয়। তাই এক্ষেত্রে হিসাব বন্ধের জন্য ব্যাংকের কোনো বিশেষ দায় আছে বলা যাবে না। এছাড়া দেখি আরও কী কী অসন্তোষের কারণে গ্রাহক হিসাব বন্ধ করে দিতে পারে কিংবা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানতে পারে।

০১. আয়কর ও আবগারি শুল্ক। একজন গ্রাহক তার ১ লাখ টাকার ডাবল বেনিফিট স্কিম অ্যাকাউন্ট মেয়াদ শেষে ভাঙাতে আসলেন। তিনি জানেন, ১ লাখ টাকায় তিনি এখন মূল টাকাসহ মোট ২ লাখ টাকা পাবেন। তাই সঙ্গে করে তিনি আরও ৩ লাখ টাকা নিয়ে এলেন, ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত ২ লাখ টাকার সঙ্গে এই ৩ লাখ টাকা যোগ করে ৫ লাখ টাকা দিয়ে আরেকটি ডাবল বেনিফিট অ্যাকাউন্ট খুলবেন। কিন্তু আয়কর ও আবগারি শুল্ক কর্তন বাবদ প্রায় ১৮ হাজার টাকার মতো কম পাচ্ছেন জানতে পেরে গ্রাহক পিছু হটলেন, সঙ্গে নিয়ে আসা ৩ লাখ টাকা তো ব্যাংকে রাখলেনই না, বরং ব্যাংকে থাকা ডাবল বেনিফিটের সেই টাকাটাও তুলে নিয়ে নিলেন। ব্যাংকার তার যুক্তির ঝুলি খুলে দিয়েও গ্রাহককে ম্যানেজ করতে পারলেন না। এমন একজন গ্রাহক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি আমানত ভাঙাতে এসে আয়কর ও আবগারি শুল্কের কর্তন প্রসঙ্গে ব্যাংকারের সঙ্গে তর্ক করেন না এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেন না। আয়কর ও আবগারি শুল্ক তুলে দিলে গ্রাহক অসন্তোষ অর্ধেক কমে যাবে।

০২. ব্যাংকের পদ্ধতিগত কারণে যেমন-
ক. লেনদেনে কড়াকড়ি, উদাহারণ পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন ছাড়া চেকের পেমেন্ট না দেওয়া, টিপি ভায়ুলেশনে লেনদেন ব্লক করে দেওয়া,
খ. পুরোনো হিসাব থাকা সত্ত্বেও নতুন দ্বিতীয় কোনো হিসাব খুলতে আসা গ্রাহকের কাছে আবারও আইডি, ছবি প্রভৃতি চাওয়া।

০৩. ব্যাংকারের আচরণে যেমন-
ক. ছোট নোট গ্রহণে অনীহা
খ. বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল নির্ধারিত সময়ের (দুপুর ১২টা) পর গ্রহণ না করা;
গ. গ্রাহকদের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করা;
ঘ. গ্রাহকদের জিজ্ঞাসাগুলোর যথাযথ উত্তর দিতে না পারা, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে গ্রাহকদের অসম্পূর্ণ বা মিথ্যা তথ্য দেওয়া।

০৪. সুদহারের অনাকাক্সিক্ষত হ্রাস-বৃদ্ধি।

০৫. গ্রাহকদের ব্যাংকিং জ্ঞানের অভাবেও গ্রাহকরা ব্যাংকারদের ভুল বুঝে এবং নিজেদের সেবাবঞ্চিত মনে করে। যেমন, চেক বই খুঁজে পাচ্ছে না কিংবা হারিয়ে গেছে, কিন্তু হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করতে দিতে হবে। ব্যাংকের আইন এবং নিয়মনীতির প্রতিও অনেকের অনীহা। যেমন, অনেক গ্রাহককেই বলতে শোনা যায়, ‘আপনার ব্যাংকেই এত নিয়ম-কানুন, অন্য কোনো ব্যাংকে তো এত নিয়ম-কানুন নেই!’ নিবন্ধের বাকি অংশে এ বিষয়ে আরও ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এবার আসছি বন্ধ হিসাবের ধরন এবং বন্ধের আরও কিছু কারণ প্রসঙ্গে। বিআইবিএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে অসন্তোষজনিত কারণে ব্যাংক হিসাব বন্ধের হার দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। তার মানে গ্রাহক অসন্তোষের হার দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে গেছে? যদি তা-ই হবে, তাহলে সব হিসাবের ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়ার কথা। আমার ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, তাহলে দেখতে পাই গত ছয় মাসেও আমি কোনো গ্রাহককে কোনো সঞ্চয়ী কিংবা চলতি হিসাব বন্ধ করতে দেখিনি। প্রতিনিয়ত বন্ধ হওয়া হিসাবগুলোর মধ্যে সর্বাধিক হচ্ছে, স্কিম হিসাব যেমন, মাসিক কিস্তিভিত্তিক সেভিংস স্কিম, মাসিক মুনাফা ভিত্তিক স্কিম, ডাবল বেনিফিট স্কিম প্রভৃতি যেগুলো নবায়নযোগ্য নয়। আবার অনেক গ্রাহক আছেন, যারা মাসিক সঞ্চয়ী স্কিমটি চালিয়ে নিতে অসমর্থ হয়েও হিসাবটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। স্কিম হিসাবের পরেই নিয়মিত বন্ধ হওয়া হিসাবের মধ্যে আছে এফডিআর, যদিও এই হিসাবটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নবায়ন হয়ে যায়। কিন্তু একশ্রেণির গ্রাহক একটি সাময়িক সময়ের জন্যই এফডিআর হিসাব খোলেন এবং মেয়াদান্তে হিসাবটি বন্ধ করে লাভসমেত টাকা নিয়ে যান তার ঈপ্সিত উদ্দেশ্য পূরণে।

এবার আসি সেবামানে অসন্তুষ্ট হয়ে হিসাব বন্ধ করা প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, এ বিষয়টিতে ব্যাংকগুলোর অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। নিয়মিত তদারকি, জরিপ ও গবেষণা, গ্রাহকদের সাক্ষাৎকার, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। কারণ ভয় দেখিয়ে কাজ করানো যায়, কিন্তু সেবামানের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। কোনো একজন গ্রাহক হিসাব খুলতে ব্যাংকে এলেন, ব্যাংকার যথারীতি হিসাব খুলে দিলেন। ব্যস, গ্রাহকের কাজ হয়ে গেল? তাহলে এখানে সেবার কী সম্পর্ক? সেবার সম্পর্ক অবশ্যই আছে। গ্রাহককে হাসিমুখে গ্রহণ করা, তার জিজ্ঞাসা ও সমস্যাগুলো মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শোনা, তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা, গুরুত্বের সঙ্গে গ্রাহকের ঈপ্সিত সেবাটি প্রদান করা এবং সেবার শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের সঙ্গে হাসিমুখ বজায় রাখাতেই একটি সেবার সার্থক এবং সম্ভাবনাময় সমাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে।

যে হিসাব খোলার ফরম গ্রাহকের পূরণ করার কথা, যে চেক এবং জমা স্লিপ গ্রাহকের লেখার কথা, তা গ্রাহকের হয়ে গ্রাহকের ব্যাংকার নিজেই সম্পাদন করে দিচ্ছে, কোনো বাড়তি টাকা-পয়সার বিনিময়ে নয়, সেবার সংস্কৃতি ও মানসিকতা বলেই তা সম্ভব হচ্ছে। গ্রাহকরা এরপরও কিছু অজ্ঞতা ও অবিবেচনাপ্রসূত মনোভাবের কারণেও নিজেকে সেবাবঞ্চিত মনে করেন, যেমন-

০১. নাবালকের নামে ব্যাংকিং সেবা পেতে চাওয়া, উদাহরণ, ফরেন রেমিট্যান্স গ্রহণ, হিসাব খুলতে চাওয়া, নাবালককে নমিনি দিতে চাওয়া;
০২. জন্ম নিবন্ধন বা চেয়ারম্যান সনদ দিয়ে হিসাব খুলতে চাওয়া;
০৩. ওয়াক-ইন গ্রাহকগণের পরিচিতিমূলক কাগজপত্র ছাড়াই ব্যাংকিং সেবা যেমন, পে অর্ডার বা ডিডি ক্রয়, অনলাইন সুবিধা নিতে চাওয়া;
০৪. চেক ছাড়াই টাকা উত্তোলন করতে চাওয়া;
০৫. চেকে ওভাররাইটিং, ঘষামাজা বা ভুল থাকা সত্ত্বেও কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে বা কচলানো চেকের পেমেন্ট দাবি করা;
০৬. ব্যাংকিং সময়ের পরেও লেনদেন করতে চাওয়া;
০৭. নিজেদের হিসাবে কোনোরকম ব্যাংকিং চার্জ- কর্তন প্রত্যাশা না করা;
০৮. ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের সুদবহির্ভূত অন্য কোনো চার্জ যেমন অনলাইন ও পে-অর্ডার কমিশন, বিমা ও রেটিং খরচ, হিসাব বিবরণী ও সলভেন্সি সনদ চার্জ প্রভৃতি প্রদানে অনীহা;
০৯. সেবাগ্রহণে অপেক্ষা করতে এবং ব্যাংকারের কাজের চাপ বিবেচনা করতে অনিচ্ছা;
১০. অন্যের (স্বামী বা স্ত্রীর) হিসাবের ব্যালান্স জানতে চাওয়া;
১১. ব্যাংকার কর্তৃক জাল নোট জব্দ ও ধ্বংসকরণে আপত্তি;
১২. নন-ইস্যু নোটকে (ছেঁড়া-ফাটা, মরচে ধরা, স্যাঁতস্যাঁতে, বিল্ট-আপ নোট) ইস্যু নোটের সঙ্গে জমা দিতে চাওয়া;
১৩. ভুল নামে আসা রেমিট্যান্স উত্তোলন করতে চাওয়া প্রভৃতি। তাই গ্রাহকদের ব্যাংকিং জ্ঞান সচেতন করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ ব্যাংকগুলোকে নিতে হবে।

বিআইবিএমের প্রতিবেদনে যে ১৬ লাখ ৫০ হাজার হিসাবের কথা বলা হয়েছে, সংখ্যাগত দিক থেকে তা পুরো ব্যাংক খাতের সামগ্রিক চিত্র কি না, সেটা দেখতে হবে। কারণ আমার জানামতে ব্যাংক শাখাগুলোকে বন্ধ হিসাবের সংখ্যা এবং কারণ প্রধান কার্যালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হয় না। যেসব ব্যাংক ‘কোর ব্যাংকিং সিস্টেম’ ব্যবহার করে, সে ব্যাংকগুলো হয়তো সহজেই বলতে পারবে এক বছরে বন্ধ হওয়া হিসাবের সংখ্যা কত। কিন্তু যেসব ব্যাংক ‘কোর ব্যাংকিং সিস্টেম’ ব্যবহার করে না, তারা তাদের শাখাগুলোর নিজস্ব রিপোর্ট না নিয়ে বলতে পারবে না এক বছরে তাদের কতটি হিসাব বন্ধ হয়েছে। আর বলতে পারলেও এর মধ্যে কতটি হিসাব গ্রাহকের অসন্তুষ্টির কারণে বন্ধ হয়েছে, তা জানার কথা নয়। কারণ হিসাব বন্ধের আবেদনে গ্রাহকরা বন্ধের কারণ হিসাবে সাধারণত অসন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করেন না, কিংবা ব্যাংকও অসন্তোষের কোনো কারণ আছে কি না; তা জানতে চায় না।

তাছাড়া ২০১৫ ও ২০১৬ সালের তুলনায় গ্রাহক অসন্তুষ্টির হার বেড়ে গেছে, দেখানো হয়েছে। এতে করে অনেকেই বলতে চেয়েছেন যে, ব্যাংকের সেবার মান ২০১৫-২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কমেছে। ২০১৫-২০১৬ সালে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে মোট গ্রাহকসংখ্যা নিশ্চয় ২০১৭ সাল শেষে ইন্ডাস্ট্রির মোট গ্রাহকসংখ্যার কম ছিল। ফলে গ্রাহকসংখ্যা বিবেচনা করে অবশ্যই বলা যাবে না যে, ব্যাংকের সেবার মান কমে গেছে। সেবার মান কমলে গ্রাহকসংখ্যা বাড়ার কথা নয়। আর গ্রাহকসংখ্যা যেমন বেড়েছে, সে কারণে অভিযোগ সংখ্যাও হয়তো বেড়েছে। তাছাড়া গ্রাহকদের অভিযোগকারী হতে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমের (ফেসবুক) বদৌলতে গ্রাহকদের সচেতনতা বৃদ্ধিও বড় ভূমিকা পালন করেছে।

তাই হিসাব বন্ধের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে শুধু সেবার মান কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আর ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়তই সেবায় উৎকর্ষ আনয়নে সচেষ্ট। দশ বছর আগের ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে বর্তমান ব্যাংকিংয়ের তুলনা করলে খুব সহজেই পার্থক্যগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। একটি ক্লিয়ারিং চেকের কালেকশনে সাত দিন, আর একটি ওবিসি কালেকশনে ১৫ দিনের স্থলে এখন অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজের মাধ্যমে দিনে দিনেই কালেকশন হয়ে যাওয়া; কিংবা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে আরটিজিএসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানোর সুবিধা নিশ্চয় সেবার অবনতি নির্দেশ করে না। সেবার বৈপ্লবিক উন্নয়নের এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। (চলবে)

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, ব্যাংক কর্মকর্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button