ব্যাংকিং প্রফেশনাল এক্সাম

ব্যাংকারদের পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা কতটা জরুরি

মোঃ মাইন উদ্দিনঃ বিএসসি প্রকৌশলীরা আরও পেশাদার উৎকর্ষের জন্য প্রকৌশলে ডিপ্লোমা নেবেন না; কারণ, তাঁরা তাঁদের স্নাতক ডিগ্রিতে যা শিখেছেন, তা ডিপ্লোমার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।

ডিপ্লোমা তাঁদের কোনো মূল্য যোগ করবে না। একইভাবে, ব্যাংকাররা যাঁরা ইতিমধ্যে ব্যবসায় প্রশাসন এবং ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাঁদের জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা খুব বেশি মূল্য সংযোজন করবে না; কারণ, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার কোর্সগুলো তাদের ব্যবসায়িক ডিগ্রিতে শেখা কোর্সগুলো থেকে কম কঠিন।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাস মার্ক ৪৫ হচ্ছে

যাই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব সম্প্রতি একটি সার্কুলার জারি করেছে, যেখানে সিনিয়র ব্যাংক অফিসার বা তাঁদের সমতুল্য কর্মকর্তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নির্বিশেষে পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দুটি অংশ পাস করতে হবে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটি করা হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (আইবিবি) ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা পরিচালনা করে। এর একটি হলো জুনিয়র অ্যাসোসিয়েট ডিপ্লোমা, যার লক্ষ্য ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রাথমিক এবং মৌলিক জ্ঞান দেওয়া। অন্যটি ডিপ্লোমা অ্যাসোসিয়েট, যার উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকিং এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উন্নত জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা।

আইবিবি যে কোর্সগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকারদের মৌলিক ও উন্নত জ্ঞান যাচাই করে, তা বেশির ভাগ সিনিয়র ব্যাংকাররা তাঁদের পূর্ববর্তী পড়ালেখা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং তাঁদের দীর্ঘ পেশাজীবনে চলমান বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জেনে থাকেন। যাঁরা ব্যবসায় প্রশাসন, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং কিংবা ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে পড়ালেখা করেছেন, তাঁদের মৌলিক ব্যাংকিং সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান। পাশাপাশি আইবিবির পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা।

তাঁদের পরীক্ষার হলে গণটোকাটুকি, একে অপরের সঙ্গে কথা বলা এমনকি মুঠোফোনে বাহির থেকে উত্তর জানা সাধারণ চিত্র। প্রত্যবেক্ষকগণ এসব বিষয়ে প্রায়ই উপেক্ষা করে থাকেন। খাতা মূল্যায়ন প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ। এটা খুবই সাধারণ যে অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়ালেখা করা ব্যাংকাররা প্রায়ই তাঁদের নিজেদের প্রাথমিক কোর্সে পাস করতে ব্যর্থ হন। আবার ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং স্নাতকদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন খুব সিনিয়র ব্যাংকার যিনি ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং উভয় ক্ষেত্রেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন, তিনি ম্যানেজমেন্ট অব ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস এবং লেন্ডিং অপারেশনস অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কোর্সে পাস করতে ব্যর্থ হন।

প্রথাগত কোর্স ও ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে খুব কমই মূল্য সংযোজন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যাংকার যিনি ব্যবসায় প্রশাসন, বিশেষ করে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং-এ স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন, তিনি ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক মৌলিক ও উন্নত কোর্স পড়াশোনা করেন। তাঁরা মৌলিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ফান্ড ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিট ম্যানেজমেন্ট, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং, ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি, করপোরেট ও রিটেইল ব্যাংকিং, ইসলামিক ইকোনমিকস অ্যান্ড ব্যাংকিং, সেন্ট্রাল ব্যাংকিং, মনিটারি অ্যান্ড ফিসক্যাল পলিসিসহ অন্যান্য অনেক কোর্স পড়ে থাকেন। তাঁরা এই কোর্সের মূল বিষয় জানেন এবং ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে অধিত জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন।

এর পরও তাত্ত্বিক এবং প্রয়োগিক জ্ঞানের ব্যবধান নতুন ব্যাংকারদের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ কিংবা অন্যান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন স্তরের ব্যাংকারদের জন্য ক্রমাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যাংকারদের ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ অবস্থার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। প্রশিক্ষণগুলোতে অভিজ্ঞ ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সেশন পরিচালনা করে থাকেন।

এই প্রশিক্ষণ এককালীন নয় বরং ধারাবাহিক। এ ছাড়া ব্যাংকারদের অন্যান্য প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা মূলত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) পরিচালনা করে। ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এই প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। তদুপরি, ব্যাংকিং বিষয়ে উন্নত জ্ঞান অর্জনের জন্য কিছু ব্যাংক তাদের ব্যাংকারদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠায়।

বর্তমানে, বেসরকারি ব্যাংকের বেশির ভাগ পদে পদোন্নতি পেতে ব্যাংকারদের বিআইবিএম দ্বারা পরিচালিত একটি পরীক্ষায় বসতে হয়। তাদের কোর্সগুলো আধুনিক ও কাঠামোবদ্ধ এবং সিলেবাস ব্যাপক; পরীক্ষা কঠোরভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং মূল্যায়নও সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। পদোন্নতির জন্য কাট অফ মার্ক রয়েছে; পজিশন যত বেশি, কাট অফ মার্ক তত বেশি।

ব্যবসায় প্রশাসন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় ডিগ্রিধারীদের জন্য ব্যাংকিং পেশা উপযুক্ত বলে বিবেচিত। এই ধরনের ডিগ্রিধারী ব্যাংকারদের পদোন্নতির জন্য অন্য ডিগ্রি অর্জন করা উচিত নয়, যা তাদের পূর্ববর্তী ডিগ্রির চেয়ে মোটেও উন্নত নয়। এসব ব্যাংকাররা তাঁদের পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা অর্জন করাকে হতাশার মনে করবেন। এই ডিপ্লোমাগুলি থেকে তারা আসলে কী শিখবেন, যেখানে তাঁরা ইতিমধ্যেই এই কোর্সের বেশির ভাগ বিষয়বস্তু জানেন?

একইভাবে, যাঁরা সফল ব্যাংকার কিন্তু ব্যবসায় প্রশাসন অথবা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় পড়াশোনা করেননি, তাঁদের জন্য এই ডিপ্লোমা কী কাজে আসবে? তাঁরা যদি প্রায়োগিক দিক জানেন, তবে তাঁদের ক্ষেত্রে তত্ত্বের ব্যবহারটা আসলে কী?

ব্যাংকিং সেক্টরে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তা সুশাসনের অভাবের কারণে, ব্যাংকারদের জ্ঞানের অভাবের কারণে নয়, যা ব্যাংকিং ডিপ্লোমা দ্বারা অর্জন করা যাবে। সুশাসনের অভাবে উচ্চ অনাদায়ী ঋণ, তার বিপরীতে প্রভিশনের অভাব, মূলধনের ঘাটতি এবং তারল্য সমস্যা দেখা দেয়। বোর্ড পরিচালকদের রাজনৈতিক নিয়োগ এবং সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ঋণ মঞ্জুর করা, ঋণ মঞ্জুরে বহিরাগত হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ঋণ প্রদান ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

এগুলো সবই পরিচিত সমস্যা এবং এগুলো সমাধান করা সম্ভব যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। যদি ব্যাংকারদের ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাতকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে।

ব্যাংকিং খাত কারা পরিচালনা করছেন, তা একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এর মধ্যে চারটি শিক্ষা বোর্ডের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়সহ মেধায় স্থান পাওয়া ৬৩ জন শিক্ষার্থী ছিল।

তাঁদের মধ্যে কয়েকজন অনুষদ সদস্য হিসেবে যোগদান করেছেন। বাকিদের বেশির ভাগ জাতীয় এবং বহুজাতিক উভয় ব্যাংকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁরা জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ; তাঁরা ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রায় প্রতিটি দিকই জানেন। এই ব্যাংকারদের যদি পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস করতে হয়, তাহলে এটা তাঁদের জন্য এক ধরনের উপহাস।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় অ্যাকাউন্টিং থাকছে না

অবশ্যই সিনিয়র ব্যাংকার যাঁরা যোগ্যতার পরিবর্তে প্রভাব খাটিয়ে কিংবা অন্যভাবে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের জন্য এই ডিপ্লোমার প্রয়োজন হতে পারে। এর মাধ্যমে তাঁদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে এটিকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা একেবারেই ঠিক নয়। বরং ডিপ্লোমাধারীদের পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যিই ব্যাংকারদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে বিভিন্ন পদের ব্যাংকারদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মডিউল তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন মডিউলগুলি আইবিবি দ্বারা পরিচালিত কোর্সগুলো থেকে আলাদা ও উন্নত হবে। মডিউল তৈরিতে অংশীজনদের মতামত বিবেচনায় নিতে হবে। সবার জন্য একই ধরনের মডিউল ব্যবহার না করে বিভিন্ন পদমর্যাদার ব্যাংকারদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মডিউল ব্যবহার করা উচিত। আবার এটা কোনোভাবেই সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়।

লেখকঃ ড. মো. মাইন উদ্দিন: অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button