অর্থনীতি

অলিম্পিক গেমস বাতিল ও অর্থনীতির বিশাল ক্ষতি

পুরো বিশ্ব যেমন অপেক্ষা করেছিলো একটি হাই-টেক অলিম্পিক গেমসের তেমনি জাপানও এবার অলিম্পিককে বেছে নিয়েছিল তাদের প্রযুক্তির অসাধারন আবিষ্কার দেখাতে যা পৃথিবী কখনো দেখেনি। রোবট, স্বচালিত গাড়ি, হাই-ডেফিনেশন টিভি, সৌরশক্তির ব্যবহার আরো বিস্ময়কর আবিষ্কার অপেক্ষা করছিলো বিশ্ববাসীর জন্য। খেলার বিচারেও এবার অলিম্পিকে যোগ করা হয়েছে আরও নতুন গেমস। অলিম্পিক গেমসকে ঘিরে বিগত ৭ বছর ধরে জাপানকে আন্তর্জাতিক বাজারে শেয়ার বিনিয়োগের একটি অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হত। পর্যটন ব্যবসায় ও চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো দেশটিতে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যেন সব জল্পনা কল্পনাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো।

পরিশ্রমী জাতি
প্রযুক্তির কথা বলতেই চলে আসে সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের কথা। শুধু প্রযুক্তি নয়; শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে তাদের অসামান্য অবদান রয়েছে। অসম্ভব পরিশ্রমী জাতি হিসেবে জাপানের সুনাম রয়েছে। নিজেদের তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও এবং প্রতিবছর প্রায় ১৫০০ ভূমিকম্প মোকাবেলা করে জাপান বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ। আচার-আচরন, ব্যবহার, নৈতিকতা, শিষ্টাচার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা এই সকল বিষয় অত্যাধিক গুরুত্তের সাথে বিবেচনা করা হয় এই জাতিকে। জাপানে রাস্তায় কোন ডাস্টবিন নেই, বাসায় কোন কাজের লোক রাখা হয় না, ট্রেনের এক মিনিট ও বিলম্ব হয় না এবং কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ বাড়ি ফিরে না।

এই প্রথম কোন যুদ্ধ ছাড়া অলিম্পিক গেমস বাতিল
করোনার ভয়াবহতা জের ধরেই একের পর এক দেশের সরকার প্রধান লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি এবং টোকিও ২০২০ অর্গানাইজিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২০ সালের জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমস বাতিল করা হলো COVID-19 এর জন্য। অলিম্পিকের অংশগ্রহণ করা কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া কানাডা অলিম্পিক ২০২০ থেকে নিজেদেরকে বাতিল ঘোষণা করার পর এই সিদ্ধান্তে অলিম্পিক কমিটি আসতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক ট্যুরস এবং ট্রিপস রেস্ট্রিকশন করা, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যান্য কাজে ঝুঁকি যথেষ্ট বেশি থাকার কারণে এই সময় রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে ১২৪ বছরের মধ্যে এই প্রথম অলিম্পিক ইভেন্ট বাতিল ঘোষণা করা হলো। অন্যভাবে বলা যায়, যুদ্ধের কোন সিচুয়েশন ছাড়াই এই প্রথম শান্তিপূর্ণ সময় (Peacetime) অলিম্পিক গেমস বাতিল ঘোষণা করা হয়। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা বিশ্বের নাজুক অবস্থা এবং অশান্তির কারণে অলিম্পিক গেমস বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

ক্ষতির হিসাব নিকাশ
অলিম্পিক গেমসের সুবাদে আয়োজক দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পায় যার ফলে আয়োজক দেশ পুরো বিশ্বের কাছে নিজেদের উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। বিভিন্ন দেশের স্পন্সররা এই আয়োজনে নিজস্ব পণ্য বিপণনের বিপুল পরিমান তহবিল বিনিয়োগ করে। জাপানের টোকিও এই গেমস উপলক্ষে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অলিম্পিক গেমস বাতিল ঘোষণা হওয়ার পর প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের শর্ট টার্ম পিরিয়ড লস ক্যালকুলেশন করা হয়েছে।

আরো যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা হচ্ছে স্পন্সর এবং ব্রডকাস্টার যারা প্রায় চার বছর ধরে এই গেমসের এডভারটাইজিং করে আসছিল এবং এর উপরে অনেক ইনভেস্ট করেছে। এছাড়া অলিম্পিক গেমস সরাসরি সম্প্রসারণের জন্য স্পোর্টস চ্যানেল ৪.৩৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

অলিম্পিক গেমস আয়োজনের সাথে আরো জরিয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি এবং কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ। খাবার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে হোটেল কর্মচারী, প্রশিক্ষক থেকে এথলেট এবং উৎসুক দর্শক যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি গেমস উপভোগের জন্য অগ্রিম টিকিট কিনে রেখেছিলেন সকলেই আজ করোনার আবির্ভাবের কারনে লোকসানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে এই অলিম্পিক গেমসের মাধ্যমে জাপান বর্তমান বিরূপ অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করেছিল যা এখন লাভের পরিবর্তে কোটি কোটি টাকার লোকসান বয়ে আনবে।

করোনা ভাইরাসের কারনে জাপানের পর্যটন ব্যবসায় বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং এর ফলে দেশটির জিডিপি ০.৭-১.৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসতে পারে। জিডিপি কমে যাওয়ার অর্থ হল মানুষের খরচ করার প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হওয়া। এছাড়াও অনুমান করা হচ্ছে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক ক্ষতির পরিমান ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে। বীমার মধ্যে অন্তর্গত হল টেলিভিশন সম্প্রচার, স্পন্সরশিপ এবং আতিথেয়তা খরচ।

অলিম্পিকের ইতিহাস
প্রথম মডার্ন অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯৬ সালে গ্রিসের এথেন্স-এ এটি তাদের ধর্মীয় উৎসবের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই ধর্মীয় উৎসব পালন করা হত গ্রিসের অলিম্পিয়া নামক স্থানে তাদের দেবতা জিউস এর নামে যিনি ছিলেন আকাশের দেবতা। The Greek God of the sky. অলিম্পিকের বিজয়ীদের তখন বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হত। চার বছর পর পর এই গেমস অনুষ্ঠিত হত এবং এই অলিম্পিয়াড সময়কাল ছিল গ্রিকদের সময় পরিমাপের একক। অলিম্পিক গেমস সবসময় কোন শহরকে প্রাধান্য দিয়ে নামকরণ করা হয় কোন দেশকে নয় যেমন জাপানের টোকিও শহরে হতে যাওয়া এবারের অলিম্পিকের নাম দেয়া হয়েছিল ‘TOKYO 2020’.

অলিম্পিক গেমসের মূলমন্ত্র হচ্ছে একটা সুন্দর পৃথিবী স্পোর্টস এর মাধ্যমে তৈরি করা। যুবকদের মাঝে স্পোর্টসের গুরুত্ব এবং পারস্পরিক মেলবন্ধন ও সহযোগিতাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এই গেমসের আয়োজন। জাপান এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪০ সালে অলিম্পিক এর হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে মনোনীত হয়। কিন্তু সে সময় মিলিটারি আগ্রাসনের কারণে জাপানের অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমস ফিনল্যান্ডের heisinki তে স্থানান্তর করা হয়। এই অলিম্পিক গেমসকে অনেকে মিসিং অলিম্পিকস নামেও অভিহিত করে থাকে কিন্তু ফাইনালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়।

১৯১৬ সালে সামার গেমস বাতিল করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ সালের অলিম্পিকস বাতিল করা হয়। ২০১৬ সালে বিশ্বে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলেও নিশেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্রাজিলের রিও (RIO) শহরে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়।

করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা দেখে ফ্রান্স, স্পেইনসহ কয়েকটি দেশ নিজেদের সরিয়ে নেয়। আন্তর্জাতিক চাপ, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সিদ্ধান্ত এবং জাপানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আসন্ন ২৪ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ৯ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক স্থগিত করে দেওয়া হয় ১ বছরের জন্য। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অলিম্পিক গেমসের স্পন্সর যেমন কোকা-কোলা, প্রক্টর এন্ড গেম্বল (P&G) ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে করোনার ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আপাতত এক বছর স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রিশাদ মাহমুদ, লেখক ও ব্যাংকার, ডিজিটাল ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button