অর্থনীতিইসলামী অর্থনীতি

সেক্যুলার অর্থ ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব-৩

উন্নত বিশ্ব কৌশলে দরিদ্র দেশগুলোকে শোষণ করছে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সেক্যুলার ব্যবস্থায় কোনো কর্মসূচী নেই এটাই মূল কথা,যা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে পাক কুরআন বলে, ‘অতএব যে আমার স্মরণে বিমুখ এবং কেবল পার্থিব জীবনই যাদের লক্ষ্য, তাদের নিকট থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিন’। (সূরা আনজুম: ২৯)। কুরআন এ সব নৈরাজ্যবাদীদের সম্পর্কে আরো বলছে, ‘নিশ্চয়ই এরা শুধু পার্থিব জীবনকেই ভালোবাসে এবং এ কঠিন দিবসকে (পরকাল) পশ্চাতে ফেলে রাখে।’ (সূরা দাহর: ২৪)।

উল্লেখ্য, এ সব অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো সুদ। আর সুদের কারণে এর ব্যর্থতা আরও তরান্বিত হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকে মন্তব্য করেছেন। অপরপক্ষে, সুদকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ও সাথে সাথে বর্জনের নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন বলে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম’ (সূরা আল বাকারা: ২৭৫)।

সুদ হলো সেক্যুলার অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি:
সুদ মুদ্রা স্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। অলস অর্থ এবং তার বিপরীতে প্রদত্ত সুদের কারণে কিছু মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা আসতে থাকে ও বাজারে জিনিষপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, ফলে গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় ও দারিদ্র বেড়ে যায়।

সুদের কুফল:
১। সুদ বিনিয়োগ হ্রাস করে এবং বিনিয়োগকে অনুৎপাদনশীল খাতে ঠেলে দেয়। মূলধন গঠনকে পিছিয়ে রাখে, পুঁজিকে অলস রাখতে সাহায্য করে। এমনকি সুস্থ ও কল্যাণকর পথে পুঁজি কমিয়ে দেয়, সঞ্চয়কারীদের মধ্য অলসতা সৃষ্টি করে, উৎপাদন হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পণ্য সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়া ও অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। এভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে থাকে। সুদের হার শূন্যের কোটায় না নেওয়া পর্যন্ত প্রকৃত শিল্পায়ন সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

২। সুদ সমাজে লোভ-লালসা ও কৃপণতা সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগায়। রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি ও বিদেশ নির্ভরতা বৃদ্ধি করে। এভাবে এককেন্দ্রিকতার উদ্ভব হয় ও সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। সুদ নৈতিক অবক্ষয় সাধনে সহায়তা করে, মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। সামাজিক জুলুম ও রাজনৈতিক অনাচারের প্লাটফরম তৈরি হয় এভাবে।

৩। সুদ বাংলাদেশের সমাজ জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুদের বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন ৪০% লোক দারিদ্র সীামার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে ২০% হত দরিদ্র। ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের মাধ্যমে ও এনজিওগুলো দারিদ্র বিমোচনের নামে স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রায় ৪ দশক ধরে সুদকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। এ সব ঋণ বিতরণ ব্যবস্থা আসলে কি গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে? দরিদ্র মানুষ যুগ যুগ ধরে দরিদ্রই রয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের দিকে সারা দেশের গরিব মানুষ স্রোতের মত ধাবিত হচ্ছে।

স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিক্রমায় প্রবৃদ্ধির হার ৫-৬% এর উপরে উঠানো গেল না। গ্রামের অভাবগ্রস্থ লোকেরা গ্রামীণ ব্যাংক সহ অন্যান্য সুদি ব্যাংক থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে তারা পুনরায় আরেকটি ঋণ নেয়। এভাবে কয়েকটি ঋণ নিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে জায়গা জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। আর জায়গা জমি না থাকলে শেষ পর্যন্ত নিজের কিডনী/ লিভার বিক্রয় করে তা শোধ করে অথবা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দেশপ্রেমের অভাব, অসৎ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা, সামাজিক বৈষম্য, ঘুষ, দুর্নীতি এবং সুদ নির্ভর অর্থ ব্যবস্থা সব কিছুকে স্থবির করে দিয়েছে। এরপরও আমাদের হুশ হলো না। ভয়ংকর অবস্থা হলো সুদের অভিশাপ থেকে আলেম-ওলামা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে কোনো মানুষই মুক্ত হতে পারছে না। কোন না কোনভাবে সুদ আমাদের জীবনে, কর্মে অনুপ্রবিষ্ঠ হচ্ছে ও সব কিছুকে তিলে তিলে ছারখার করে দিচ্ছে। সুদ আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, অস্থি-মজ্জায় প্রবিষ্ট হয়ে দুষ্ট চক্রের মত সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা সুদ ছেড়ে না দাও তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (স) তরফ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রইল’। (সূরা আল বাকারা: ২৭৫)।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

৪। এদেশে মহাজনী প্রথার মাধ্যমে সুদ ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে অথবা মহাজনের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়ার প্রচলন এদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অনেক সময় বন্ধকী সম্পদ লোপাট হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর এদেশের লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ মহাজনের নিকট থেকে বন্ধকী স্বর্ণ ফেরত নিতে না পারায় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাছাড়া বন্ধকী স্বর্ণ ও ঋণ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে বন্ধকী সম্পদ মহাজনদের হাতে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, এই নীতি ভয়াবহ। এ সমস্ত আত্মঘাতি সুদি কারবার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্টীর স্বার্থে সরকারের এখনই বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। তার বিপরীতে গরিব মানুষের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ বা কর্জে হাসানা প্রবর্তন করা জরুরি। নতুবা বিপর্যয় অনিবার্য বলতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে সর্বাগ্রে গরিব মানুষগুলোকে সুদের যাঁতাকল খেকে উদ্ধার করতে হবে।

৫। সুদ মুদ্রা স্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। অলস অর্থ এবং তার বিপরীতে প্রদত্ত সুদের কারণে কিছু মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা আসতে থাকে ও বাজারে জিনিষপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, ফলে গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় ও দারিদ্র বেড়ে যায়। এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সুদ নির্ভর সেক্যুলার অর্থব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বে কাঙ্খিত উন্নতি-অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয় নি। উপরন্তু, এ সব ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণে। সমৃদ্ধির সোনার হরিণ সুদূর পরাহত। এখন ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য কিছু বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুই প্রান্তিক সমার্থক অর্থনীতির বিপরীতে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা অধিকতর সমতা ভিত্তিক ও বাস্তবতার নিরিখে দারিদ্র বিমোচনে কার্যকর।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘The adaptation of western secular economic theory and practice will not help us in achieving our goal of creating a happy and contented people. We must work with our destiny in our own way and present to the world and economic system base on the true Islamic concept of equality of mankind and social justice. We will thereby be building our mission as Muslims and giving to humanity the message of peace which alone can save it and secure the welfare, happiness and prosperity of mankind.’
অর্থাৎ, পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন আমাদের সমাজে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন ও সুখী-সমৃদ্ধ মানুষ সৃষ্টিতে কখনও কার্যকর হবে না। আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব পন্থা-পদ্ধতি অনুসরণ করে এগুতে হবে, যার ভিত্তি হবে সঠিক ইসলামী চিন্তা-চেতনা, সমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। সুতরাং, মুসলিম হিসাবে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং মানব সম্প্রদায়কে শান্তির পয়গাম পৌঁছাতে হবে, যার মাধ্যমেই কেবল অর্থনীতির সুরক্ষা ও মানব কল্যাণ নিশ্চিতকরণ ও সুখী সমৃদ্ধ মানব জাতি গঠন সম্ভব।

ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস হলো, আল্লাহর কুরআন ও সুন্নাতে নববী (স), অতঃপর ইজমা ও কিয়াস। শরীয়াহ আইন মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণধর্মী এটা বলাই বাহুল্য। কেননা, তার প্রবক্তা হলো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তিনি মানুষের বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সেই হিসাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানই বাস্তব, সময়োপযোগী ও কল্যাণমূখী হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজালী রহ. বলেন, “শরীয়াহর গূঢ় উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের আকিদা-বিশ্বাস, জীবন পদ্ধতি, বুদ্ধিবৃত্তিক, সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। যা কিছূ এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তাই জনস্বার্থ বলে গণ্য হবে এবং সেটাই কাম্য”।

বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. ওমর চাপড়া বলেন, “প্রত্যেকটি সমাজেরই স্বীকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ আর প্রত্যেকটি পদ্ধতিরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে।” তবে কল্যাণের মৌলিক উপাদান কী এবং কীভাবে লক্ষ্য অর্জিত হবে সে সম্পর্কে মত পার্থক্য থাকতে পারে। ইসলাম এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা পোষণ করে, যা বিদ্যমান সেক্যুলার ব্যবস্থাগুলো থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। এই চেতনার উৎস হচ্ছে শরীয়াহ যা থেকে ঐ ব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কৌশলের উদ্ভব হয়েছে।

‘বর্তমান বিশ্বে প্রভাবশালী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদগুলোর মত ইসলামের লক্ষ্য (মাকাসিদ আল শরীয়াহ) মৌলিকভাবে জড় ও বস্তুগত নয়; বরং এর ভিত্তি হচ্ছে, মানবকল্যাণ (ফালাহ) ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন (হায়াতে তায়্যিবাহ); যাতে ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ সামাজিক সুবিচারের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে’। ‘ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মিক উন্নতি হলো মানুষের কল্যাণের অপরিহার্য উপাদান’। ‘মানুষ হলো নৈতিক জীব এবং নৈতিক ভিত্তি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না’। এভাবে বলা যায়, নৈতিক সংশোধনের পথ অবলম্বন ব্যতিরেকে দক্ষতা ও সমতার সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

ইমাম ইবনে আল কাইয়েম শরীয়াহ বিধিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘শরীয়াহর ভিত্তি হচ্ছে মানুষের জ্ঞান এবং পার্থিব জগৎ ও পরকালের কল্যাণ সাধন আর কল্যাণ নিহিত রয়েছে সার্বিক ন্যায় বিচার, দয়া, সুখ সমৃদ্ধি ও জ্ঞানের মধ্যে। যেখানে ন্যায় বিচারের পরিবর্তে নির্যাতন, দয়ার স্থলে কঠোরতা, কল্যাণের পরিবর্তে কার্পণ্য এবং জ্ঞানের বদলে মূর্খতা স্থান পায়, সেখানে শরীয়াহর কিছুই করার নেই’। ‘এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যদি নৈতিক মানদ- ছাড়া দক্ষতা সংজ্ঞায়িত হয়; তাহলে এ সব ব্যতীত ন্যায় বিচার (ইকুইটি) আরও কঠিন হবে’। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা রাসূলগণকে সুষ্পষ্ট নিদর্শন সহকারে প্রেরণ করেছি এবং তাদের উপর অবতীর্ন করেছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে’। (সূরা হাদিদ: ২৫)।

এ প্রসঙ্গে ‘নাইজেল লসন’ বলেন, “ইসলামী ধ্যান-ধারণার একটি সহজবোধ্য চেতনা আছে বরং ইহার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো অতি সহজেই এগিয়ে নেওয়া যায়”। অনেক বিশেষজ্ঞ চিন্তাবিদ ইসলামী অর্থনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু, এ অর্থনীতি ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান ও বিশ্লেষণ করে থাকে। এ অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত কোনো মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশ্বাসের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।

এর দর্শন হলো কর্ম, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফল। এ প্রসঙ্গে কুরআন ঘোষণা করছে, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়’ (সূরা রা’দ: ১১)। অর্থাৎ কর্মোদ্দীপনা ও দক্ষতাই কেবল মানুষকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। কর্ম নির্ধারিত হবে তাওহীদের ভিত্তিতে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এ বিশ্বকে সচেতনভাবে পরিকল্পনা মাফিক সৃষ্টি করেছেন এবং তা হঠাৎ করে বা দূর্ঘটনাবশত সৃষ্টি হয় নি। আল্লাহর একত্ববাদের উপর ভিত্তি করেই ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল ও দর্শন গড়ে উঠেছে। এখানে নিশ্চয়ই একটি উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল রয়েছে এবং তা হচ্ছে তিনি সবকিছূর সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন।

প্রত্যেক ভালো মন্দের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হবে। তার কাছ থেকে মানব জাতি পৃথিবীতে এসেছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রত্যেকটি মানুষকে আবার তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে, যেখানে ভালো-মন্দের জররা জররা বিচার হবে। কুরআন বলে, ‘তিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বাধ্যগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা এর প্রশস্থতার উপর চলাচল কর এবং আহার কর তাঁর প্রদত্ত জীবিকা থেকে আর জেনে রাখ তোমাদের আবার জীবিত হয়ে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে’। (সূরা মুন: ১৫)। সকল সম্পদই যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত সেহেতু মানুষ এর মূল মালিক নয়। সে শুধু আমানতদার, পাহারাদার ও ভোগদখলকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং সকলের উপকারের জন্য নিবেদিত। কুরআন বলে, “তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে রয়েছে সবটুকুই”। মোদ্দা কথা হলো, বৈধভাবে সম্পদ অর্জন জরুরি। সম্পদ বৈধ হলেও ইচ্ছামত তথা আমানতদারীর খেয়ানত হয় এমনভাবে ব্যয় করা যাবে না। আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ ধ্বংস কিংবা অপচয় করার কোনো অধিকার মানুষের নেই। আল্লাহ বলেন, “অর্থ ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন কর না। আল্লাহ অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আনআম: ১৪১)।

মূলনীতি হলো বৈধ আয়ের সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সে মালিকানা সীমাহীন ভোগ বিলাসে মত্ত হওয়ার পক্ষে নয়। অপরপক্ষে, বৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদ ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে। কুরআন বলে, ‘লোকেরা আপনার কাছে জানতে চায় তারা আল্লাহর পথে কী পরিমাণ ব্যয় করবে। আপনি বলুন, তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত।’ (সূরা আল বাকারা: ২১৯)। ইসলাম এই প্রয়োজনের সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনতে হলে ব্যক্তির চরিত্র গঠন ও মন-মানসিকতার সংশোধন অপরিহার্য। বৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে অবৈধ ও হারাম পন্থায় সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলামী অর্থনীতির আরেকটি অন্যতম মূলনীতি হলো সর্বক্ষেত্রে সুদ বর্জন ও লাভ লোকসান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করা। হারাম পন্থায় ইসলামী অর্থনীতি পরিচালিত হতে পারে না, এটি একটি মৌলিক বিষয়। তাছাড়া, ভোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আহার কর, পান কর, সীমা লঙ্ঘন কর না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আ-রাফ: ৩১)।

ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হলো, মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপ করে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করে সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট জীব আর এ জন্য সকলের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত লোভ ও অর্থ পূজাকে ইসলাম কখনও গ্রাহ্য করে নি। তাছাড়া, সম্পদের সমতাভিত্তিক নয় ইনসাফভিত্তিক পূর্ণ বন্টনের ঘোষণা দিয়েছে। উপরন্তু, প্রয়োজনীয় ব্যয় করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হয় নি বরং কৃপণতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে সম্পদ কুক্ষিগত করা যাবে না। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও দীর্ঘদিন মজুদ করা হারাম। ৪৫ দিনের উপর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ করে রাখা যাবে না। নিবন্ধটি আপনি পড়ছেন ব্যাংকিং নিউজ বিডি ডটকম-এ। পারস্পরিক দায়বদ্ধতা অন্যতম বৈশিষ্ট। সরকার ও জনগণ উভয়ে উভয়ের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবে। বল্গাহীন লাভ ও দখলদারী নীতি পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। জুলুম পরিত্যাগ ও ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হবে।

সকল মানুষের জন্য সম অধিকার সৃষ্টি তথা সম সুযোগ সৃষ্টি ও ধনী দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচানোই লক্ষ্য। বিধিবদ্ধ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন রয়েছে তেমনি স্বেচ্ছাচারিতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক রেখে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। বস্তুত শ্রেণি সংগ্রাম নয় সুস্থ প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক সহমর্মিতায় উদ্দীপ্ত হওয়া মৌলিক বিষয়। সেক্যুলার অর্থনীতিতে শ্রেণি সংগ্রামকে উস্কে দিয়ে অবৈধ ফায়দা হাসিলের প্রবণতা ইসলাম গ্রহণ করে নি মোটেও। তাছাড়া, হারাম পণ্য উৎপাদন-বিপনন ইসলামে নিষিদ্ধ। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্যও উৎপাদন-বিপনন হারাম। এভাবে সমাজে একটি সুস্থ ও সুন্দর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা ও তার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সেক্যুলার অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে ও বাস্তবিকই এ অর্থনীতি বিশ্ব মানবতাকে সঠিক গন্তব্যের কাছে কিনারেও ধাবিত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা এ ব্যবস্থার অসারতাকে প্রকট করে তুলেছে। এ জন্যই সেক্যুলার অর্থনীতির যাঁতাকল থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচাতে হবে। এ লক্ষ্যে ইসলামী অর্থনীতির প্রচার ও প্রসারে একযোগে কাজ করতে হবে ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা সেক্যুলার অর্থ ব্যবস্থার বিপরীতে একটি সুষম, ন্যায়ভিত্তিক ও গরিববান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে ইতোমধ্যে বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ও সফলভাবে এগিয়ে চলছে। এমতাবস্থায়, ইসলামী অর্থ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাস্তবায়নে মুসলিম সমাজকে জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর বর্তমান অর্থনৈতিক যুগ সন্ধিক্ষণে ইসলামী অর্থনীতিকে আল্লাহর দর্শন ও মতবাদ হিসাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও সমাজ শেষ রক্ষাকবচ হিসাবে গ্রহণ করবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

লেখকঃ এম ওসমান গনি: বিশিষ্ট ব্যাংকার, লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট।

তথ্য সুত্র:
ইসলামী অর্থনীতি- সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ)।
ইসলামী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ- ড. ওমর চাপড়া।
Failure of Secular Economics- John W. Robbins
সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ও মুসলিম সমাজ- এম. ওসমান গনি।
সুদ, সমাজ, অর্থনীতি- শরীফ হোসাইন।
সুদ নিষিদ্ধ- মাওলানা তকী ওসমানী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button