বিশেষ কলাম

টেকসই উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীনঃ টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পের বিকাশ জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেলেও নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। সম্পদের সুষম বণ্টন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হলে এবং জবাবদিহির ঘাটতি অর্থনীতিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে। বড় বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ এ খাতটি অনেকটা অবহেলিত। অর্থনীতির এ খাতটির বিকাশ ঘটানো গেলে কর্মসংস্থানের বিরাট ক্ষেত্র তৈরিসহ দারিদ্র্য দূরীকরণে অনন্য অবদান রাখতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারে দৈনদিন প্রয়োজনের পণ্য সামগ্রীর সরবরাহ ক্ষুদ্র মাঝারি খাত থেকে এসে থাকে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের পুঁজি কম, আয়ও কম। প্রয়োজনীয় পুঁজি, অর্থায়ন ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পেলে জাতীয় অর্থনীতিতে (এসএমই) ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

বর্তমানে এসএমই বলতে মূলত কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অর্থাৎ একে সিএম-এসএমই বলা হয়। কটেজ ও মাইক্রো শিল্প খাতে স্বল্প পুঁজিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। কিন্তু আমাদের দেশের এসএমই খাত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। পাশের দেশ ভারতেও এর অবদান ৪৫ শতাংশ। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে এসএমই খাত।

২০১৩ সালের বাংলাদেশের শিল্পনীতি-২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে শিল্প খাতে জরিপ অনুযায়ী দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। যার ৯৩ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিসিক) ১৯৫৭ সাল থেকেই এ খাতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৪ সাল থেকে এসএমই খাতে পুনঃঅর্থায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট নামে একটি বিভাগ খোলা হয়।

এ খাতের জন্য ২০১০ সালে বিস্তৃত এসএমই ঋণনীতি মালা প্রণয়ন করা হয়। সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এসএমই নীতিমালার আওতায় এনে এ খাতে বিনিয়োগ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকেএসএফ এবং এসএমই ফাউন্ডেশন মূলত এসএমইতে ঋণ বিতরণের কাজ করছে। এ খাতে বিসিকের ভূমিকা তো আছেই। কটেজ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য থেকে জানা যাই বিতরণকৃত ঋণের ৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা এবং ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বিতরণকৃত ঋণের ৮০ দশমিক ২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরের।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সম্প্রতি এসএমই ফাউন্ডেশন ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রণোদনার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। দেশের পল্লি ও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দেয়ার জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হয়েও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। সার্বিকভাবে অর্থায়নে মূল স্রোতধারায় এসএমই খাত আসতে পারেনি। এসএমই বিনিয়োগ উন্নয়নের মূলধারায়ও আসতে পারেনি। লক্ষ্য করা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে কভিড-১৯ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে প্যাকেজ দেয়া হয় তাতে ছোট-বড় সব সেক্টর অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয় রপ্তানি খাত আর এমজি এক্সপোর্ট সেক্টর ও বৃহৎ শিল্প খাতে দ্রুত প্যাকেজের অর্থ বিতরণ হলেও এসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাক্সিক্ষত হারে অর্থ বিতরণ করতে সক্ষম হয়নি।

এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াও ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতির কথা বলা হয়। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বিতীয় দফায় আরও ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। ১ এপ্রিল ২০২১ থেকে যা শুরু হয়। দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনার প্যাকেজে বলা হয় বরাদ্দের ৭০ শতাংশ দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের, ৩০ শতাংশ দিতে বলা মাঝারি উদ্যোক্তাদের। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৭০ শতাংশের মধ্যে ৬৫ শতাংশ সেবা ও উৎপাদন খাতে এবং ৩৫ শতাংশ টেডিং ও ব্যবসা খাতে দেয়ার জন্য বলা হয়। প্যাকেজে বলা হয়, ৮ শতাংশ দিতে হবে নারী উদ্যোক্তাদের। গবেষণায় দেখা গেছে, কভিডকালে সিএমএসএমই খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসএমই খাতে সামগ্রিক আয় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থেকেছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। এবার এসএমই খাতের কিছু সমস্যার কথা বলা যায়। এ খাতের বড় সমস্যা হলো অর্থায়ন। উদ্যোক্তারা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে খুব কমই ঋণ পান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এনজিও মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনের ওপর নির্ভর করতে হয়, যেখানে অতি উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিতে চায় না, ঋণ দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। অল্প অল্প করে অধিক মানুষকে ঋণ দিতে হয়, এতে সুপার ভিশনে অনেক সময় ব্যয় হয়Ñএসব অজুহাত দেখিয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র বিনিয়োগে কম যেতে চায়। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি, আধুনিক কৌশল ও সৃজনশীল উপায় চিন্তা করলে এসব অজুহাত টিকে না।

তাই সহজে ঋণপ্রাপ্তি ও এ খাতের পরিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এসএমই উদ্যোক্তাদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করা যেতে পারে। কারণ এসএমই খাতের সঙ্গে বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দ্রুত বিকাশমান একটি খাত, আগের চেয়ে বেশি প্রযুক্তিনির্ভর আয়বর্ধক খাত ও শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিতদের নিয়ে এ খাত। কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়Ñউচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১৬.৪ শতাংশ। পরিসংখান ব্যুরোর মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শ্রমশক্তি বেকারের হর ২৬ লাখ ৮০ হাজার বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। তাছাড়া আমাদের শিল্প কারখানা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোক পাচ্ছে না। বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) নামে এই সরকারি সংস্থার গাফিলতির কারণে দেশের শিল্পায়নের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাস কাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। দেশে এখন ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। বিশাল এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে এসএমই শিল্প খাতে বিকাশ ও প্রসারের বিকল্প নেই। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনের বড় হাতিয়ার হলো এসএমই খাত। টেকসই উন্নয়নে পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় এ খাতের যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসএমই শিল্প খাতের বিকাশ ও এ খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যথাযথ নীতি-কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। এসএমই পণ্যের দেশীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টির পাশাপাশি রপ্তানির ক্ষেত্রেও সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি মানে বড় বড় শিল্পে ঋণ বাড়াতে হবে- এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজীকরণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় সব ধরনের তথ্য পৌঁছাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। উদ্যোক্তাদের কোন ব্যবসায়ে কী ঝুঁকি বা সম্ভাবনায় কেমন, তা জানানোর ব্যবস্থা করা উচিত। বাংলাদেশ বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ী সংযোগ গড়ে ওঠেনি। বড় বড় শিল্পের সহায়ক হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে গড়ে তুলতে হবে। বহির্বিশ্বের বাজারের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যোগসূত্র তৈরি করা উচিত। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে এসএমইর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করলে ও নিয়মিত তদারকি করলে দেশের অর্থনীতি একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি ঋণ আদায়ের হার ও বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থানেরও বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে। এটা নিঃসন্দেহে দেশের সরকার ও জনগণের বড় অর্জন। তবে উত্তরণ শুধু বাণিজিক বিষয় নয়। এটি দেশের সব অর্থনৈতিক খাত যেমন কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেও প্রভাবিত করে। এলডিসি থেকে উত্তরণের লাভ-ক্ষতি হিসাব করতে হবে। শুধু আত্মতৃপ্তি ও অধিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে কৃষি ও বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ অর্থনৈতির চালিকাশক্তিগুলোকে টেকসইভাবে তৈরি করতে না পারলে এলডিসি থেকে উত্তরণ আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে।

মো. মাঈন উদ্দীন, ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button