ব্যাংকার

কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীদের সাথে পুরুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ গণকর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২৭ ও ৩৪ এ মোতাবেক মহিলা সহকর্মীদের প্রতি আচরণ কেমন আচরণ করা যাবে তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোন সরকারি কর্মচারী মহিলা সহকর্মীর প্রতি কোন প্রকারে এমন কোন ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন না যা অনুচিত এবং অফিসিয়াল শিষ্টাচার ও মহিলা সহকর্মীদের মর্যাদার হানি ঘটায়।

অফিসিয়ালি কোন মহিলা সহকর্মীকে বাজে কথা বা কুপ্রস্তাব দিলে কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে। এই বিধিমালার কোন কিছুই সরকারি কর্মচারীদের আচরণ সংক্রান্ত বলবৎ কোন আইনের কোন বিধান বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোন আদেশের প্রয়োগকে হ্রাস করবে না। বিধি সূত্র-এআরও নং ৩৬৮-আইন/২০০২/সম(বিধি-৪)/শৃ:আ:-১/২০০২, তারিখ: ডিসেম্বর, ২০০২ দ্বারা বিধিটি সংযোজন করা হয়।)

সরকারিভাবে আইনে থাকুক বা না থাকুক, অফিসের স্বাভাবিক নিয়ম শৃংখলা ও শিষ্টাচার বলে যে- এখানে নারী পুরুষ সবাই সমমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। সুতরাং প্রত্যেকের ইজ্জত ও আব্রুর নিরাপত্তা রক্ষার স্বাধীনতা রয়েছে। অফিস কলিগগণ নিজেরাই তা সংরক্ষন ও নিশ্চিত করবেন। বাইরে থেকে কেউ এসে তাদের পারষ্পরিক সম্পর্কের দাঁড়ি-কমা পরীক্ষা করবেন না এবং ব্যত্যয় হলে সতর্ক করবেন না যদি না তা অভিযোগ আকারে কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপিত না হয়।

কর্মজীবী নারীর দিনের একটি বড় সময় কাটে সহকর্মীদের সাথে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা সহকর্মীর মাধ্যমে নানান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অনেক নারী তাদের পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পান। তখন সহকর্মীও হয়ে যায় বন্ধুর মতো। আবার কোন কোন নারী পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা এমন বিরূপ আচরণের শিকার হন যে চাকরি করাই কঠিন হয়ে যায়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমাদের সমাজে কর্মজীবী নারীকে সংসার ও চাকরি দুটো দায়িত্ব একসাথে পালন করতে হয়। সাংসারের গৃহস্থালী কাজে পুরুষের সহযোগিতা নেই বললেই চলে। ফলে পুরুষের চেয়ে নারীর দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। সবকিছু সামলিয়ে চাকরি করতে গেলে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় নারীকে। নারীর জীবনের সাথে যে বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত যেমন- গর্ভধারণ, সন্তান লালন, রান্না করা, সাংসারিক অন্যান্য কাজ, অতিথি আপ্যায়ন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের খোঁজখবরি করা ইত্যাদি। তাছাড়া সন্তান জন্মের পরও অনেক মা বিষণ্নতায় ভোগেন। গর্ভপাতও নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রতিমাসে পিরিয়ড নারীর কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই সমস্ত ব্যাপারগুলো নারীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অনেক মেয়ে নিজের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা পুরুষ সহকর্মীকে বলতে পারে, অনেকে পারে না। পুরুষ সহকর্মীর অসহযোগিতামূলক আচরণ, বিরূপ মন্তব্য এবং কোথাও কোথাও তীর্যক দৃষ্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকে চুপ থাকতে বাধ্য করে।

প্রত্যেক পুরুষ তার পরিবারে মা ও স্ত্রীর সংগ্রামী জীবন দেখেন। পরিবারের প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে মেয়েদের যুক্ততা থাকে এটাও সব পুরুষ জানেন। সন্তান জন্ম ও লালন পালনে নারীর ভূমিকাও তারা অস্বীকার করতে পারেন না। নিজের স্ত্রীর গর্ভধারণকালীন সমস্যা কিংবা কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলোও তাদের অজানা নয়। তারপরও কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীকে সহযোগিতা করার মানসিকতা কি সব পুরুষের থাকে? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হ্যাঁ বলে না। দু’ একটি উদাহরণ শুনলেই বুঝবেন আশাকরি।

কোন এক মহিলা অফিসার গর্ভধারণের সময় পুরুষ সহকর্মীর নেতিবাচক আচরণের কারণে নানা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, ‘গর্ভধারণের পর কখনও কখনও শরীরটা একটু খারাপ লাগতো। অফিসে একদিন হঠাৎ বেশি খারাপ লাগলে পুরুষ সহকর্মীকে বলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যেতে চাই। তখন সেই পুরুষ সহকর্মী আমাকে বলেন, আমার স্ত্রী দুটি সন্তান জন্ম দিয়েছে। কোনদিন তার শরীর খারাপ লাগেনি। আপনার এতো শরীর খারাপ লাগে কেন?

আপনি আশ্চর্য হতে পারেন কিন্ত এর চেয়েও মন্দ ঘটনা আমি হ্যান্ডেল করেছি। হঠাৎ সন্ধ্যাবেলা একজন মহিলা অফিসার সরাসরি আমার সেলফোনে কল করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে ক্যাশ তখনো মিলেনি। ফলে ক্লীন ক্যাশের অবস্থা খারাপ। একারণে সেকেন্ড স্যার তাকে প্রচন্ড বঁকেছেন এবং এক পর্যায়ে তাকে চাকুরী খাওয়ারও হুমকি দেন। আমি বুঝতে পারিনি- এমন ঘটনা ব্যাংকে প্রায়শই ঘটে, নভিসদের বেলায় নিত্য। তখন অন্যরা মিলে তাকে সাহায্য করে এবং সহসাই সমাধান মিলে।আমি ল্যান্ড ফোনে তাকে ডেকে সমস্যাটা জানতে চাই। তিনি উল্টে মেয়েটার বিষয়ে অভিযোগ করেন। আমি আরো আশ্চর্য হই যখন জানলাম তারও ঐ বয়সের একজন কন্যা আছে।

অন্য আরেকটি শাখায় একজন পুরুষ সিনিয়র তার এক জুনিয়রকে প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে টিজ করতেন। সে বিরক্ত হয়ে একটি লিখিত অভিয়োগ দায়ের করে। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে পুরুষ সিনিয়র নৈতিকতার সীমা লংঘন করেছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে এবং তিনি চাকুরীচ্যুত হন। ব্যাংকের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পেশাগত দক্ষতার চেয়ে নৈতিক মানে আনকম্প্রোমাইজিং দৃষ্টিভংগী পোষণ করা হয়। এ বিষয়ে প্রত্যেক ব্যাংকের সার্ভিস রুলে বিস্তর ধারা রয়েছে।

অনেকস্থানে কর্মজীবি নারী পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে এমন বিদ্বেষী আচরণ পান যা বর্ণনারও অতীত। তাকে ছুটি চাইতে গেলে এমন প্রশ্ন করা হয় যার জবাব দেয়ার চেয়ে ছুটির আবেদন বাতিল করা বরং সম্মানজনক মনে হয়। পারিবারিক সমস্যার কথা শেয়ার করা তো দূরে বরং বহু বস এমন আছেন তাদের দিকে ফিরেও তাকান না। কোন এক বসের মহিলাদের ট্রেনিং এর কথা বললে বলতে শুনেছি-স্যার ওদের ট্রনিং দিয়ে লাভ কি? এরকম বৈষম্য আর বিদ্ধেষের ফলে একটা সময় চাকরি করাটাই তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। অনেক নারী চাকরিও ছেড়ে দেন।

চাকরি করলে দিনের একটা বড় সময় জুড়ে অফিসে থাকতে হয়। আর এই সময়ের সঙ্গী হন সহকর্মীরা। সহকর্মী যদি সহযোগিতামূলক আচরণ করেন, সহমর্মিতার সাথে একজন আরেকজনকে বোঝার চেষ্টা করেন তাহলে অন্যান্য অনেক সমস্যার মধ্যেও চাকরি করাটা কঠিন মনে হয় না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের নারী সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক নির্মাণ করেন। ফলে তাদের মধ্যে একতা তৈরি হয়। কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীদের পারষ্পরিক বোঝাপড়া ভালো থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়।

অনেক পুরুষ সহকর্মী মনে করেন, মেয়েরা কম কাজ করে বেশি সুবিধা পায়। অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে মেয়েদের ভালো সম্পর্ক থাকে। এতেই মেয়েদের দ্রুত পদোন্নতি হয়। অন্যদিকে পুরুষ সহকর্মীর পদোন্নতিকে স্বাভাবিক চোখে দেখা হয়। মনে করা হয় পুরুষের যোগ্যতা বেশি, তারা কনট্রিবিউট বেশী করেন। যদিও এসবের কোনটাই সত্য নয়। মেয়েরা নিজেদের পারফরমেন্স ও যোগ্যতার বলে পদোন্নতি পায়। কর্মক্ষেত্রে যেকোন পদে নারী পুরুষ সমান যোগ্যতা নিয়ে নিয়োগলাভ করেন তবুও কেন নারীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়? কেন নারীর পদোন্নতিকেও নানাভাবে ছোট করা হয়? এ ধরনের মানসিকতা যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্যই আলটিমেটলি ক্ষতিকর।

আরও দেখুন:
◾ সিনিয়র ব্যাংকাররা কেন জুনিয়রদের কথা শুনতে চায়না?

আসলে প্রতিটি সম্পর্ক পারষ্পারিক দায় ও দায়িত্বের নিগড়ে আবদ্ধ। একজন নারী সহকর্মী যদি পুরুষের প্রতি সহযোগী হোন তাহলে পুরুষও নারী সহকর্মীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাবে। সপ্তাহের পাঁচ দিন লম্বা সময় কাটে সহকর্মীদের সঙ্গে, তাই তাদের সঙ্গে হালাল সীমার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। তাতে কাজের পরিবেশ উন্নত হবে, কাজের চাপ সহনীয় হবে, কর্মক্ষেত্রে আপনার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হবে যা ভবিষ্যতে ক্যারিয়ার গ্রোথের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button