ব্যাংকার

সিনিয়র ব্যাংকাররা কেন জুনিয়রদের কথা শুনতে চায়না?

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ সিনিয়র ব্যাংকাররা কেন এমন, তারা কেন জুনিয়রদের কথা শুনতে চায়না? এটা চমকে উঠার মত শিরোনামই বটে। আমি ব্যাংকার বলে বলছি না, প্রায় জুনিয়রদের মধ্যেই এমন অভিযোগ কমন। আমার লাইফেও বহু উদাহরন ছিলো, এখনো আছে। একটু সিনিয়র পজিশনে গেলেই বুঝি ভারিক্কি হওয়া লাগে, সিনিয়র ভাব আনতে হয়, জুনিয়র কেউ কিছু জানতে চাইলে অনেকক্ষণ নিরুত্তর থেকে বেশ গাম্ভীর্যের সাথে জবাব দিতে হয়।

কর্মক্ষেত্রে অনেকেই জুনিয়র কলিগদের সাথে বেশ বিরক্তিকর আচরণ করেন নিজের অজান্তেই। আর এই কিছু মানুষের বিরক্তিকর আচরণের কারণে অন্য সহকর্মীদেরকে পড়তে হয় বেশ বিপাকে। একজনের বিরক্তিকর আচরণই যথেষ্ট কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য। একজনের একটি ব্যতিক্রমী আচরন তখন গোষ্ঠিগত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জুনিয়ররা ধরেই নেয় সম্ভবতঃ সব সিনিয়রই এমন। আসলে মোটেও তা নয়। অকারণ ভারসাম্যহীন মেজাজ প্রদর্শন, অযৌক্তিক সুবিধা কর্তন, ছুটি চাইলে সাথে সাথে নাকচ, নিবেদিত কাজের পরও অসন্তোষ প্রকাশ এগুলো কয়েকটি উপমা মাত্র।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা: কার কথা থাকবে?

আজই একটু আগে দেশের একটি ভালো মানের একটি ব্যাংক শাখায় কোন এক কাজে গিয়েছিলাম। অবসর যাপনকালে প্রায়ই নিজ ব্যাংক ব্যতীত অন্য ব্যাংকগুলোতে যাতায়াত আমার প্রাত্যহিক। যথারীতি ম্যানেজারকে পরিচয় দিলে উনি সাদরেই স্যার সম্ভোধন করে বসতে অনুরোধ করেন। উপস্থিত কালেই একজন সহকর্মী উনার বুস্টার ডোজের জন্য আজই ছুটি চাইলেন। সরাসরি নাকচ করে অন্য কোনদিন নিতে বললেন। অনুগত সহকর্মী সেটা মেনে নীরবে প্রস্থান করলেন।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমার পর্যবেক্ষন হলো, সহকর্মী মেনে নিলেন হয়তো মনক্ষুন্নতা নিয়ে কারণ তিনি জানেন এরকম ব্যস্ততা ব্যাংকে সবদিনই এবং অন্য কোনদিন আর অবসর মিলবে না। তার কপালে পড়া চিন্তার ভাঁজ এবং চোখে দ্যুতিহীনতাই বলে দেয় যে তিনি স্যারের কথায় বেশ অসন্তষ্ট। আলটিমেটলি সারাদিন তার মন্দ কাটবে। তিনি চেয়ারে থাকবেন কিন্ত মনটা পীড়া দিবে সন্ধ্যা অবধি।

আমার বেশ মনে আছে, নীচের পদবীর লোকদের সাথে মিশতে গিয়ে এমন এন্তার অলিখিত কমপ্লেইন পেতাম যে বসেরা ছুটি চাইতে গেলে যেসব প্রশ্ন করেন তার জবাব দেয়ার চেয়ে নিরুত্তর দরখাস্ত উইথড্র করে নেয়া ঢের ভালো। একবার শুনলাম, বস বলছেন- Leave isn’t a matter of right. জী অবশ্যই। ছুটি অপ্রয়োজনে কেউ চায়না। আগে তার প্রয়োজনটি শুনুন। কিছু শোনার আগেই নাকচ- প্রতিষ্ঠানের এটি নির্দেশ বা নীতি নয়।

আমার জীবনেও এমন ঘটেছিলো। বিয়ের জন্য দু’দিন ছুটি চেয়েছিলাম, পাইনি। অগত্যা বিয়ের তারিখই বদলে দিয়ে জাতীয় ছুটির দিন করেছিলাম যেন পুনরায় আবেদন করতে না হয়। ঐ একদিনই। অন্য শাখায় বদলী হয়ে এলাম, বসও বদলে গেলেন কিন্ত রসমের কোন বদল হলোনা। প্রথম সন্তানটি জন্ম নিবে। স্ত্রীকে সিজারিয়ানের জন্য ওটিতে ঢুকিয়ে অফিসে এলাম। সব ব্যাখ্যা করে ঐদিন ছুটি চাইলাম। সন্মানিত বস বললেন, আপনি ছুটিতে গেলে তো ব্যাংক চলবেনা।এর মধ্যে যা হবার তাই হলো। মায়ের কোলজুডে ফুটফুটে সন্তান। সেদিনের সেই মানসিক ক্ষণটির কথা জীবনেও ভোলার নয়।

এমনই নাকি বস ব্যাংকারগণের চরিত্র। প্রিয় ব্যাংকার ও অন্যতম রম্য সাহিত্যিক মরহুম লুৎফর রহমান সরকার স্যার বলেছিলেন- ফোন এসেছে, বাবা মারা গিয়েছেন। পাকিস্তান আমল তখন। পশ্চিমের লোক পূর্বে চাকুরী করতেন। ছুটি চাইতে গেলেন। বস জবাবে বললেন- তোমহারা বাবা তো মার গিয়া, আওর কুছ নেহি। তোম জানেকে বাদ ও জিন্দা নেহি হোগি। অর্থাৎ তোমার বাবা চলে গেছেন, এই তো। তোমার যাবার পর তো উনি জীবন ফিরে পাবেন না। অতএব ছুটি ক্যানসেল।

আমি তখন ধানমন্ডি শাখায়। নতুন প্রবেশানারী অফিসাররা যোগদান করেছেন। সেবছরই প্রথম ব্যাচ মহিলা ইসলামী ব্যাংকে আসে। পূরো ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। তারাও বেশ সংকুচিত। যদিও প্রত্যেকটি শাখাতে বিশ্রাম, অযুখানা, টয়লেট আলাদা তবুও তাদের জড়তা কাটতে অনেক সময় লেগেছিলো। এর মধ্যে একজনের সন্তান এল। ইন্টারনাল এরেঞ্জমেন্ট করে তাকে সন্তান প্রতিপালনের সূযোগ করে দিয়েছিলাম। এখন সে ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পাঠে। ইনশাআল্লাহ আর কিছু বছর পর সেও হয়তো ব্যাংকে যোগ দিবে। তার মা এখন একটি শাখার ম্যানেজার।

জানা মতে, সব ব্যাংকেই সবই সুলিখিত ও সুপঠিত কিন্ত ব্যক্তি বসগণ সেটা মানেন কি? মানেন না। সন্ধ্যা ছ’টার পর, সেকারণে অকারণ বসে থাকাও কারো কাছে দক্ষতা মাপার বাটখারা। ছুটির দিনে কাজ করা পেশাগত কর্তব্যের প্রতি ভালোবাসা।

জুনিয়রদের সাথে সখ্যতা ও তাদের সমস্যা শেয়ার করায় লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি নেই। ব্যাংকের কাজ কি সব বস একাই করেন? মোটেও নয় বরং কলিগদের করা কাজে তিনি পুরস্কৃত হন, তার সুনাম হয়। কলিগদের হাসি কান্না তো তার হাসি কান্না। তাদের কারো কোন অসুবিধা হলে তো তার প্রথম ধাক্কাটা ব্যাংকে এসে পড়বে। আপনি তার সহযোগীতা হারাবেন। মনে রাখুন, তাঁরাই আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। একজন দু’জন মন্দ কর্মী দশজন ভালো ও সৎ কর্মীর প্রতিনিধি নয়। তাই ভালোদের আস্থায় রাখুন, আপনি জিতবেন প্রতিষ্ঠানেরও উন্নতি হবে।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button