বিশেষ কলাম

যেসব কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য স্বল্পতা দেখা দেয়

আবু আহমেদঃ অর্থনীতির পরিভাষায় লিকুইডিটি বা তারল্য মানে অর্থ ব্যবহারের প্রাপ্যতা। এই প্রাপ্যতা কমে গেলে প্রচলিত অর্থে আমরা এটাকে বলি তারল্য সংকট। প্রকৃত অর্থে এটাকে তারল্য সংকট নয়, তারল্য স্বল্পতা বলা উচিত। এই স্বল্পতা দেখা দেয় অর্থ সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেড়ে গেলে। এটা সাধারণত স্বল্প মেয়াদে হয়। কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ এবং ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক মাস চলতে পারে। হঠাৎ করে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠলে তারল্য স্বল্পতা দেখা দিতে পারে, আবার কোনো দুর্যোগ বা বিশেষ কোনো আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণেও হতে পারে। কোনো কারণে তারল্য স্বল্পতা বেশিদিন স্থায়ী হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি দেশের কিছু ব্যাংক তারল্য স্বল্পতায় ভুগছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাই ঠিক কী কারণে এ স্বল্পতা দেখা দিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খতিয়ে দেখতে হয়। কারণ এর সমাধানও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই।

এই মুহূর্তে দেশে তারল্য স্বল্পতার অন্যতম কারণ হতে পারে অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হয়ে ওঠা। অর্থাৎ কভিডের কারণে অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, অর্থনীতি দ্রুততার সঙ্গে আগের অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে অর্থের চাহিদা বেড়ে গেছে। সে তুলনায় সরবরাহটা তাল মেলাতে পারছে না। ছয় মাস আগের তুলনায় অর্থনীতি এখন দ্রুত পিক-আপ করছে। ব্যবসায়ীরা স্বল্পমেয়াদি ঋণ চাচ্ছেন। আগে যেখানে ঋণের চাহিদাই ছিল না এবং তারল্যের বোঝা নিয়ে অনেক ব্যাংক বসেছিল, সেখানে অনেক ছোট, বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখন ঋণ চাচ্ছেন চলতি মূলধন জোগান দেওয়ার জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দৈনন্দিন যে অর্থ লাগে তার জোগান দেওয়ার জন্য তাঁরা এখন ঋণের জন্য মরিয়া। যেহেতু ইকোনমি পিক-আপ করছে, তাদেরও সেভাবে অগ্রসর হতে হবে। ফলে অর্থনীতিতে নগদ অর্থের ব্যবহার এখন বেশি হচ্ছে।

অর্থ সরবরাহের প্রধান উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেহেতু তারা আমাদের লিগ্যাল টেন্ডার বা টাকা প্রিন্ট করে এবং অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে, তাই স্বল্প সময়ের এই ঘাটতি তাদের পূরণ করতে হয় তাদের মনিটারি পলিসির মাধ্যমে। সাধারণত তারল্য স্বল্পতায় ভোগা ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে চাহিদা মেটায়। তাতে আন্ত ব্যাংক লেনদেনে সুদহার বেড়ে যায়। এই সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং এক পর্যায়ে সুদহার কমিয়ে দেয়। এটা করতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির অংশ হিসেবেই। আর আন্ত ব্যাংকের মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে না পারলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় মাস আগে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে সেটা হচ্ছে নিড বেজড বা অ্যাকোমোডিটিভ মনিটারি পলিসি। অর্থাৎ প্রয়োজনের নিরিখে সাপ্লাই বাড়ানো হচ্ছে এখানে। একেবারে সম্প্রসারণমূলক নয়, আবার সংকোচনশীলও নয়। এটা হচ্ছে মাঝামাঝি একটা অবস্থা এবং খারাপ কিছু নয়। কারণ বেশি সম্প্রসারণে গেলে মূল্যস্ফীতি হতে পারে। এখন যেহেতু উৎপাদনে গতিশীলতা আসছে, সরবরাহ চেনগুলো রি-অ্যাক্টিভেটেড হচ্ছে এবং অর্থনীতি মোটামুটি আগের অবস্থানে যাচ্ছে, সে অবস্থায় অর্থের চাহিদা বাড়াই স্বাভাবিক। সেটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ রাখার কথা। যেহেতু অর্থের চাহিদা বাড়ছে, তাই তাদের উচিত মুদ্রানীতির হাতিয়ার বা ইনস্ট্রুমেন্ট রেপু, রিভার্স রেপু—এগুলোর নিম্নমুখী সুদহার সমন্বয় করা। এর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি করা দরকার।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমি মনে করি এ মুহূর্তে যে তারল্য স্বল্পতা চলছে তা বেশিদিন থাকবে না। আবার সব ব্যাংকের তারল্য স্বল্পতাও নেই। যাদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি দিতে হচ্ছে, তাদের ঘাটতিই বেশি হচ্ছে। আন্ত ব্যাংকের মাধ্যমে সে ঘাটতি পূরণ না হলে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবেই। না হলে অর্থনীতি আবার স্থবির হয়ে যেতে পারে, এর গতি কমে যেতে পারে। এ জন্য নগদ অর্থ প্রবাহ হচ্ছে এক ধরনের লুব্রিকেটিং এলিমেন্ট, যার ওপর দিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরে। খেয়াল করতে হয়, এই লুব্রিক্যান্ট যেন শুকিয়ে না যায়। এর সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে মানুষ যদি নগদ অর্থ ধরে রাখে, তাহলেও তারল্য স্বল্পতা সৃষ্টি হতে পারে। অর্থনীতির ভাষায় এটিকে ক্যাশ হোল্ডিং বলে। এটা সাধারণত সংকটকালে দেখা যায়। যেমন—লকডাউনের সময় দেখা গেছে। ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মানুষ এক বা দুই মাসের টাকা ঘরে নিয়ে রেখেছিল। দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোনো গোলযোগের সময়ও এটা হতে পারে। তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ক্যাশ হোল্ডিং আরেকটি কারণে ঘটতে পারে। সেটা হচ্ছে অর্থনীতি যখন দ্রুত পিক-আপ করে তখন দোকানদার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মালিকরা দ্রুততম সময়ে নগদ অর্থ কাজে লাগানোর জন্য টাকাটা হয় নিজের কাছে রেখে দেন, না হয় ডিমান্ড ডিপোজিট করে রাখেন, যেটার আরেক নাম কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। কারণ ঘরে টাকা রাখা ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টে রাখা একই কথা। এ ধরনের অ্যাকাউন্টে হোল্ডিং বাড়লেও তারল্য স্বল্পতা দেখা দেয়। কারণ ব্যাংক এই টাকা থেকে ধার দিতে পারবে না। টাকা স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়, যাতে চাহিবামাত্রই অ্যাকাউন্টধারী পেতে পারে।

তারল্য স্বল্পতার জন্য কখনো কখনো শেয়ারবাজারও ভূমিকা রাখে। শেয়ারবাজারে নগদ প্রবাহ বা ক্যাপিটাল ইনফ্লো যদি বেশি ঘটে, তাহলে তারল্য স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। ইদানীং শেয়ারবাজারে নগদ প্রবাহ বাড়ছে। শেয়ার বেচাকেনার টাকা ব্যাংকে চলে আসার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী তাঁদের নিজস্ব অ্যাকাউন্টে টাকাটা স্থানান্তর না করে ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে টাকা হোল্ড করছেন। এ কারণে কিছুটা হলেও তারল্য স্বল্পতা দেখা দিতে পারে অর্থনীতিতে। কারণ ব্রোকার অ্যাকাউন্টে থাকার অর্থ হচ্ছে এখান থেকে টাকাটা ধার দেওয়া যাবে না, বাইরে ব্যবহার করা যাবে না। এটাকে কনসোলিডেট অ্যাকাউন্ট বলে। এটা বিনিয়োগকারীদের অর্থ স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। এই টাকা ব্যাংকের ভল্টে পড়ে থাকে। ব্যাংকের ভল্টে যখন টাকা ধারণ বেড়ে যায়, তখনো তারল্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে।

আরেকটা বিষয়ও নজর দেওয়া দরকার। ডলারের দাম বাড়ছে। বেশি দামে ডলার ক্রয় করতে হচ্ছে। এই কেনাকাটা যদি অফিশিয়াল চ্যানেলে হয়, তাহলে তা তারল্য ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ ডলার বিক্রি হলে টাকাটা ব্যাংকিং চ্যানেলেই থাকছে। কিন্তু ব্ল্যাক মার্কেটে সেটা হোল্ড করলে কিছুটা হলেও তারল্য স্বল্পতার কারণ হতে পারে।

নগদ অর্থের স্বল্পতার আরেকটা কারণ হলো মৌসুমি। আমাদের দেশে যেমন ঈদের সময় তারল্য স্বল্পতা দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী মৌসুম তারল্য স্বল্পতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। এই মুহূর্তে দেশজুড়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। কয়েক হাজার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে। এটা আমাদের দেশের বড় নির্বাচন এবং প্রার্থীও অনেক। চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী অনেক। আমাদের দেশে নির্বাচনে নগদ অর্থের ব্যবহার বেশি হয়, টাকার খেলাকে বাস্তবতা বলেই মনে করা হয়। একেকজন প্রার্থী অবিশ্বাস্য রকম অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেন বলে প্রচার রয়েছে। তাই নির্বাচনের সময় নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। দেশজুড়ে একযোগে এটা ঘটে বলে বেশ কিছুদিনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রার্থীরা এবং তাঁদের লোকজন নির্বাচনী খরচের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন। টাকাগুলো আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেরত আসতে সময় লাগবে।

যে কারণেই ঘটুক, তারল্য স্বল্পতা মূলত মুদ্রানীতির ইস্যু। এর সমাধান বাংলাদেশ ব্যাংক করবে বলে আশা করছি। কোনো অর্থনীতিতেই তারল্য স্বল্পতা দীর্ঘমেয়াদি হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি একটু উদার করে এর মোকাবেলা করতে পারে. যাতে অর্থ সরবরাহে কোথাও সমস্যা না হয়। পরে অতিরিক্ত তারল্য দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে অর্থ তুলে নিতে পারবে।

লেখকঃ আবু আহমেদ: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button