বিশেষ কলাম

গ্রাহকের আস্থা তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নেতৃত্ব দিতে হবে

ব্যাংকের প্রতি অনাস্থায় ক্ষতি কার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং একটি সংবেদনশীল খাত। এ ক্ষেত্রে একটি ছোট ভুল তথ্যে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক তথ্যই মানুষের মাঝে আস্থা স্থিতিশীল রাখতে পারে।

রবিবার (১১ ডিসেম্বর, ২০২২) বিকালে বাংলা ট্রিবিউন আয়োজিত ‘ব্যাংকের প্রতি অনাস্থায় ক্ষতি কার?’ শীর্ষক বৈঠকিতে অংশ নিয়ে ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা এসব মত প্রকাশ করেন। এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ বৈঠকি সরাসরি সম্প্রচার করেছে।

বৈঠকিতে অংশ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের আসলে কোনও ঘাটতি নেই, যা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে। প্রতিটি ব্যাংকই একটা নিয়মের মধ্যে কাজ করে। শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর প্রধান শক্তি হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাস। এটাই আমাদের বড় মূলধন।’

সম্প্রতি ব্যাংক নিয়ে সংবাদপত্রের নানা প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি দাবি করেন, প্রকাশিত খবরের কারণে কোনও ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয়নি। তবে তিনি এ-ও উল্লেখ করেন, ‘আমাদের গ্রাহকদের মধ্যে যারা একটু আতঙ্কিত হয়েছিল, তারা টাকা তুলে নিয়ে গেছে। আবার কিছুদিন পর সেই টাকাই ব্যাংকে জমা করে গেছেন। ওভার অল আমাদের কয়েক দিনের প্রভাব পড়েছিল।’

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

‘ইসলামী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ‘অস্বাভাবিক ঋণ উত্তোলনের’ বিষয়টি পত্রিকাগুলো তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ করেছে’ এমন দাবি করেন ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সেলিম উদ্দিন।

মো. সেলিমের ভাষ্য, ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ লিখে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটা আঘাত করতে পারলে, ২০২৩ সালে যে রকম ইকোনমিক গ্রোথ আশা করছি, এটাকে ত্বরান্বিত করার জন্য, ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেন চুরমার হয়ে যায়, এলসি দিতে না হয়, যাতে আমরা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাই, সে জন্য এটা করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে যেসব ঘটনাকে নিয়ে আসা হয়েছে, সেটা হচ্ছে, একটা সাম্প্রতিক ঘটনা লিখতে গিয়ে রেফারেন্স হিসেবে গত ৮ থেকে ১০ বছরের যত ঘটনা আছে, সব তুলে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক আছে। আর্থিক ব্যবস্থার রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক অত্যন্ত শক্ত। এটা নীতিনির্ধারণী আইনকানুনের মধ্য দিয়ে হয়ে আসছে।’

সব সময় মানুষ দুর্বল জায়গাটা খুঁজে নেয় উল্লেখ করে অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশের ও বৈশ্বিক সবকিছুর ওপর নির্ভর করে আমার ব্যাংকিং ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হবে। এগুলোর অবস্থা ভালো হলে ব্যাংকের অবস্থাও ভালো হবে। ব্যাংকের যে লাভ-ক্ষতি নেই, তা কখনও বলবো না। আমি বলবো, এগুলো কুৎসা রটনা। আমরা যেই ব্যাংকগুলো (ঋণ) দিয়ে থাকি, তা নিয়ম অনুযায়ী দিয়ে থাকি।’

বৈঠকিতে ব্যাংকিং খাতের সংবেদনশীলতা নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টরটি খুবই সেনসেটিভ একটি খাত। যদি কোনও কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে ক্ষতি আমাদের দেশের। আমাদের অর্থনীতি মোটামুটি সম্পূর্ণভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল এবং তার একটা বড় অংশ ইসলামি ব্যাংকিং সেক্টর।’

ড. হাবীব উল্লেখ করেন, ‘এটা আমাদের প্রডাক্ট পোর্টফোলিওতে পরিবর্তন এনেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেখানে মিডিয়ার একটা বড় রোল থাকবে। কোনও খাত সম্পর্কে এ ধরনের নিউজ হলে তা অবশ্যই মানুষের সামনে আনবে। যেন তারা সচেতন হয়। কিন্তু এটা মনে রাখা খুব প্রয়োজন, ব্যাংক একটি সেনসেটিভ সেক্টর। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনও বিষয়ে নিশ্চিত হবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত একটা ছোট নিউজও একটা বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে।’

এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কী ভূমিকা হতে পারে? এ প্রসঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন ব্যাংক খাতের সাংবাদিক গোলাম মওলা। তার পর্যবেক্ষণ, ‘দেশের ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি যদি মানুষের আস্থা থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলবে, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করবে।’

‘তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঝে যদি কোনও অনাস্থার জায়গা থেকে থাকে, সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে আমাদের জন্য সাংবাদিকতা করাটা আরও সহজ হবে। তখন সাংবাদিকরা যে তথ্য লিখবে, তাতে সঠিক চিত্রই উঠে আসবে,’ বলছিলেন বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি গোলাম মওলা।

তবে ব্যাংকের নিউজের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সাংবাদিক গোলাম মওলা। তিনি মনে করেন, ‘সাংবাদিকতার জায়গা থেকে, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সংবাদ করার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার। বিষয়টা এমন না যে একটা কাগজ পেলাম, আর নিউজ করে দিলাম।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘এটা আমরা চাই, মিডিয়ায় জোরেশোরে প্রচার হোক। বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় ভূমিকা ছিল। আমানতকারীরা দেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাঁড়িয়ে আছে, পলিসি মেকাররা দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া প্রকাশিত ঘটনাটা কতটা সত্য, তা যাচাই করার জন্য একটি টিম গঠন করা হয়েছে। সুতরাং তার যে ফলাফল তা যেন আমরা আমানতকারীদের জানাই। এটাও সাধারণত মানুষের কাছে একটা দায়বদ্ধতা।’

সাংবাদিক গোলাম মওলার ভাষ্য, ‘১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালের শুরু থেকেই এই ব্যাংক অনেক বাধা পেরিয়ে এসেছে। তাই একটা নিউজের জন্য ব্যাংকটির ক্ষতি হবে, বিষয়টি এমন কোনও কারণ ছিল না। যদি না বৈশ্বিক অর্থনীতির একটা অস্থিতিশীলতা শুরু না হতো।

তিনি আরও বলেন, ‘তবে এটা সত্য যে, ব্যাংকগুলোতে মানুষের আমানত থাকে এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের একটি বড় ব্যাংক। এই ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি মানুষের আমানত আছে। এই ব্যাংক থেকে যেমন সরকার সুবিধা পায়, তেমনি জনসাধারণও সুবিধা পেয়ে থাকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে একটা পরিবর্তন আসার পর থেকে এই ব্যাংকের প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি রয়েছে। তাই ব্যাংকটি নিয়ে এমন নিউজ প্রকাশের এমন সময় বেছে নেওয়া হয়েছে, যখন মানুষ এটাকে খুব সহজেই বিশ্বাস করবে।’

অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘সার্বিকভাবে চাইবো মিডিয়াতে এটা আসুক যে আমানতকারীরা ব্যাংকের সত্যিকারের মালিক। আর কিছু শব্দ ব্যবহার বন্ধ করে দিই যেমন: বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক না বলে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক বলতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক না বলে সরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক। কারণ, ব্যাংকের মালিক কিন্তু সাধারণ মানুষ।’

সোর্সঃ বাংলা ট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button