বিশেষ কলাম

ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখার যুক্তি কি?

কোনো সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তেমনই কোনো সন্দেহ নেই, এই সংকটের সময় কিছু মানুষ খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার বার্তা দিচ্ছে কিংবা বুঝ দিচ্ছে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে আপনি আপনার আমানত কিভাবে খোয়াবেন। আমার এ লেখা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে অস্বীকার করার জন্য নয়। সেই সংকটের সমাধান যদি জানতে চান, তাহলেও এটা পড়ে আপনার লাভ নেই। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিক পরিস্থিতি মোটেই সৃষ্টি হয়েছে কি না, সে বোঝাবুঝিটা যেন আপনি করে নিতে পারেন, সেই কারণেই এই লেখা।

‘দেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে’ গুজব ছড়িয়ে যাঁরা দেখলেন কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কা হয়নি, তাঁরাই এখন ‘ব্যাংকে টাকা নেই, আমানত তুলে নিন’ বলা শুরু করেছেন। প্রশ্ন হলো, মানুষ ব্যাংকে টাকা কেন রাখে? মোটাদাগে মানুষ কাজটা করে তিন কারণে।
এক. ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা মেলে;
দুই. চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলা যায়;
তিন. কিছু মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায়।

বুঝলাম দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে, ডলার মার্কেটের তারল্য কমছে, বুঝলাম টাকা দিয়ে ডলার কিনতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু টাকার তারল্য কি কমেছে? সোজা উত্তর, না। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় যে পরিমাণ তারল্য থাকার কথা, তার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য জমা আছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, ব্যাংকে নগদ আকারে।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে বিভ্রান্তি

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা থাকা মোট আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ প্রায় পনেরো লাখ কোটি টাকা। আমানতকারীদের ওই টাকা চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের অন্য নাম ব্যাংকের তারল্য। আমাদের এই তারল্যের পরিমাণ বর্তমানে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবমতে, আমাদের এই তারল্য থাকা লাগত আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো। অন্য কথায়, নিয়মমাফিক দেশের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা নিরাপদে তুলে রাখার জায়গায় আমরা রেখেছি ২৮ শতাংশ টাকা।

এ রকম উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান থাকতে আপনি লোকের কথা শুনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখবেন কোথায়? বাসা কি ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ? সত্য একটা ঘটনা বলি। এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখা ব্যবস্থাপক জানালেন, তাঁর এক গ্রাহক ১৩ লাখ টাকা বাসায় নিয়ে গেছেন, কারণ তাঁর ইতালিপ্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ না। দুই সপ্তাহ পরে তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।

ওই শাখা ব্যবস্থাপকের মতো শিকড় পর্যায়ে কাজ করা ব্যাংকারদের থেকেই আমি জানছি, যাঁরা দেশের বাইরে থাকেন, তাঁদের মধ্যে এ উৎকণ্ঠা তুলনামূলক বেশি। প্রবাসীরা দূরে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখা বা না রাখা নিয়ে ‘জ্ঞানগর্ভ’ আলোচনা শোনেন, আর একসময় দুশ্চিন্তার কাছে হার মেনে দেশে আত্মীয়কে ফোন দেন টাকা তুলে ঘরে রেখে দেওয়ার জন্য। এ পুরো ব্যাপারটা আমাদের অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোগত শক্তিটাকে বুঝতে না পারার ব্যাপার। সিকি সত্য বা অপ্রাসঙ্গিক সত্যকে অকাট্য ও প্রাসঙ্গিক সত্য ধরে নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলার ব্যাপার। সত্য-মিথ্যার এই উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চে যা মঞ্চস্থ হচ্ছে তার ফলাফল যদি হয় বাস্তবতাবর্জিত আতঙ্ক, তাহলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার একটা বড় তত্ত্ব হলো যে সব আমানতকারীর একসঙ্গে সব টাকা নগদ করার কোনো দিন দরকার পড়ে না। এটা চিরন্তন এক সত্য। গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় যদি সবার একসঙ্গে একদিনে দরকার পড়ত, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাংকিং বলে কোনো কিছুর আবিষ্কারই হতো না। ব্যাংক আপনার আমানত নিয়ে অন্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয় বলেই মানুষ ঋণ নিয়ে তার ব্যবসার আকার বড় করে বা বাসস্থানের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গৃহঋণ নেয়। এখন সব আমানতকারী যদি এসে বলেন যে, ‘সব টাকা ফেরত দাও,’ তাহলে ব্যাংকগুলোকে সব ঋণগ্রহীতার কাছে গিয়ে বলতে হবে, আপনার ফ্যাক্টরি বা বাড়ি বিক্রি করে সব টাকা এখনই ফেরত দিন। সেটা অবাস্তব।

কোনো কোনো ব্যাংকে মন্দ ঋণের সমস্যা আছে, কোথাও মূলধনের ঘাটতি আছে,কোথাও সুশাসনের সমস্যা আছে। তাই বলে আপনার টাকা তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। উঠলে এত দিনে এ দেশে দু-একটা ব্যাংক ধসে যেত। যায়নি, কারণ আপনার সব সমালোচনার পরেও ব্যাংকব্যবস্থায় রয়েছে ওই তারল্য ও উদ্বৃত্ত তারল্যের উপস্থিতি, আর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কড়া চোখ। এ সময়ে কিছু স্বল্প স্থায়ী সমস্যাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আপনার ব্যাংক হিসাবের টাকা যারা অকারণে আপনাকে ব্যাংক থেকে তুলে নিতে বলছে, তারা আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করছে না। সে ক্ষতিটার শিকার যাতে আপনি না হন, তাই ওপরের এতগুলো তথ্য-উপাত্ত-অঙ্ক। অঙ্কই কথা বলুক, আর কথা বলুক আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইতিহাস।

কার্টেসিঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান- (এবিবি ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মাসরুর আরেফীন এর লেখা থেকে সংক্ষেপিত)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button