ব্যাংক

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ব্যাংকগুলোর কার্যকর ভূমিকা অত্যাবশ্যক

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদঃ কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপরই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য দেশগুলো নিজস্ব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, কভিড আসার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায়, বিশেষ করে আঞ্চলিক বা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে মোটামুটি এগিয়ে ছিল। আবার কডিভ আসার পরও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে অন্যদের চেয়ে ‘তুলনামূলক ভালো’ নিয়ে খুব একটা আত্মতুষ্ট থাকারও সুযোগ নেই। কারণ কভিড এসে আমাদের প্রবৃদ্ধির প্রায় অর্ধেকটাই গিলে ফেলেছে এবং সমাজ ও অর্থনীতির যে ক্ষতি করেছে তার ধকল অনেক দিন বইতে হবে।

কভিড আসার আগে থেকেই আমাদের অর্থনীতি এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। এখন আমরা কত দ্রুত আগের জায়গায় পৌঁছতে পারব তার ওপরই লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করছে। তবে এই পথে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। কভিডের আগে আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ বা এর ঊর্ধ্বে। ২০২০ সালে এসে ৫.২৪ শতাংশে নেমে গেছে, যদিও এই প্রবৃদ্ধি আমাদের আশপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো; কিন্তু আমাদের লক্ষ্য সাড়ে ৮ শতাংশের দিকে যাওয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এর বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে।

এই অবস্থায় অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের জন্য আমাদের ব্যাংকগুলোর কার্যকর ও অগ্রণি ভূমিকা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ভূমিকা বরাবরই গতানুগতিক। এর প্রমাণ হচ্ছে কভিডের কারণে গত জুলাই মাসে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটি ছোট-বড় সব খাতের জন্য সুষম প্যাকেজ হলেও এর বাস্তবায়ন সমানভাবে হয়নি। আমরা দেখতে পেলাম ব্যাংক ও ঋণনির্ভর প্যাকেজটির বাস্তবায়ন হয়েছে বড় শিল্পের ক্ষেত্রে এবং রপ্তানি খাতে পোশাকশিল্পের জন্য। অথচ পোশাক খাতে বা বড় শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে বলে মনে হয় না। ফলে এসব বড় খাতের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদন বাড়লেও আমাদের কর্মসংস্থানের বড় খাত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কোনো উন্নতি হয়নি, বরং আরো নিচে নেমে গেছে।

অর্থনীতিতে আমাদের সমপর্যায়ের দেশ ভিয়েতনামের দিকে আমরা তাকাতে পারি। আজ ২০ বছর আগেও দেশটি আমাদের চেয়ে খুব বেশি এগিয়ে ছিল না। অথচ তাদের আগেই আমরা বাজার অর্থনীতির দিকে যাত্রা করি। আমরা ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারতাম; কিন্তু পারিনি। কারণ আমরা ধারাবাহিকভাবে সমন্বিত ও সুষম পদক্ষেপগুলো নিতে পারিনি। এখন ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা আমাদের অর্থায়নের প্রধান উৎস ব্যাংকগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরে অর্থ পান না। এটা নিয়ে বহু কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রবণতাটা হচ্ছে বড় শিল্পগুলো অনেক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের দিক দিয়ে। অথচ ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো কিছু স্থবির ও কিছু অবনতির দিকে যাচ্ছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এই পরিস্থিতি নিয়ে আমরা যদি একটি রেখাচিত্র তৈরি করি, দেখতে পাব এটি ইংরেজি বর্ণ ‘কে’-এর আকার নিচ্ছে। অর্থাৎ স্পষ্টভাবে একটি রেখা ওপরের দিকে চলে যাচ্ছে, যেটি বড় শিল্প এবং আরেকটি রেখা নিচের দিকে নেমে আসছে, যেটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। এটিকে অর্থনীতিতে ‘কে-শেপ রিকভারি’ তথা অসম অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বলা হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার পর অনেক দেশের অর্থনীতিতে এই প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু অর্থনীতির জন্য এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

আমরা বারবার বলছি, আমাদের ব্যাংকগুলো গতানুগতিক পথে হাঁটছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংকের কর্মতৎপরতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। না হলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত পদক্ষেপ ও নীতি সহায়তা দরকার। তাদের পরীবেক্ষণ বা নজরদারি বাড়াতেই হবে। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি হচ্ছে, তহবিল তছরুপ হচ্ছে। অনেকে খেলাপি হচ্ছে।

আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত গতানুগতিকভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। অথচ এর সামষ্টিক নীতিগুলো হওয়া উচিত যাতে ব্যাংকিং খাত তৎপর হতে বাধ্য হয়। মুদ্রানীতি এমন হবে যে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য যেন খুব বেশি না হয়। অন্যথায় কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনা সুবিধা পাবে না। তৃতীয়ত, সরকারের রাজস্বনীতির পরিবর্তন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। এটি গতানুগতি বা রুটিনমাফিক হওয়া উচিত নয়।

আরেকটি বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) উল্লেখ রয়েছে। এবারের পাঁচসালা পরিকল্পনার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সকলের সঙ্গে সমৃদ্ধির পথে’ (প্রমোটিং প্রসপারিটি অ্যান্ড ফস্টারিং ইনক্লুসিভনেস)। এখানে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তার অর্থ হচ্ছে সব ধরনের লোকের অর্থায়নের সুযোগ অবারিত করা, সমান সুযোগ দেওয়া। এখানে মনোপলির সুযোগ থাকবে না, বরং স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে না পারলে শুধু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নয়, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্যটিই আমরা অর্জন করতে পারব না।

আবার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য আমাদের এককেন্দ্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমাদের স্থানীয় সরকারগুলো কাগজে-কলমে যতটা শত্তিশালী, বাস্তবে ততটা নয়। স্থানীয় সরকারগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে এটিও একটি বাধা।

ব্যাংকের ভূমিকার বিষয়ে ফিরে যাই। আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বা সুষম উন্নয়নের কথা বলি, তা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত ঋণের সুষম বণ্টনে ব্যাংকগুলোকে আরো সক্রিয় করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে বলতে হবে যে প্যাকেজের ভেতরে হোক বা বাইরে হোক, আমরা ব্যাংকিংয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে বেশি নজর দেব। এখানে ঝুঁকির কথা বলা হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে ক্ষুদ্রঋণের আদায়ের হার ৯০ শতাংশের বেশি। এখন যাঁরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসতে চান, তাঁদের অনেকেই করোনা সংক্রমণ কমে আসার অপেক্ষায় আছেন।

আমি মনে করি, করোনা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার দরকার কী? ব্যাংকগুলো যদি মনে করে তাঁদের ব্যবসার সম্ভাবনা ভালো এবং উদ্যোগী উদ্যোক্তা হন, তাহলে ব্যাংকগুলোকে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। ঝুঁকিটা এখানে বড় নয়। ধরুন, একটি ব্যাংক ১০ জনকে ২০ লাখ করে দুই কোটি টাকা দিল। তাঁদের মধ্যে একজন যদি ডিফল্টার হন, তার পরও ব্যাংকের রিকভারি রেট ভালো থাকবে। কিন্তু একজনকে ২০ কোটি টাকা দিয়ে ফেরত না পেলে তাতে শতভাগ ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোকে গ্রামের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে হবে।

গ্রাম এখন আর চাষবাসে সীমাবদ্ধ নয়। গ্রামে আইটি সুবিধা ভালোভাবে পৌঁছে দিতে পারলে বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যের আউটসোর্সিংগুলো এখন গ্রামে করা সম্ভব। এতে নারীর অন্তর্ভুক্তিও বাড়বে। তৃতীয়ত, অর্থায়নে সরকারকে শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। প্রণোদনা প্যাকেজের প্রথম দিকে যদি ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য পিকেএসএফ, এনজিও ফাউন্ডেশন, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং পরীক্ষিত দক্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান—এসবের মাধ্যমে ঋণটা বিতরণ করা যেত, তাহলে আজকে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। এই সময়ে এর গুরুত্বটা আরো বেড়ে গেছে।

করণীয়টা শুধু সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্থানীয় ব্যাবসায়িক সংগঠন বা চেম্বারেরও ভূমিকা রয়েছে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে চেম্বারগুলোর মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে। শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সংগঠন নয়, জেলা পর্যায়ের সংগঠনগুলোর সঙ্গে ব্যাংকগুলো যোগাযোগ করে অর্থায়নের কাজটা এগিয়ে নিতে পারে। চেম্বারগুলো প্রত্যয়ন করবে, ‘এই ব্যক্তি বা তার প্রতিষ্ঠান আমাদের সদস্য। আমরা যাচাই করে দেখেছি, আপনারা তাকে টাকা দিতে পারেন।’ এটি একটি ভালো উপায় হতে পারে। মোটকথা, গতানুগতিকার বাইরে ব্যাংকগুলোকে অর্থায়নে সৃজনশীলতা দেখাতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কথা শুধু কাগজে-কলমে বললে হবে না, এর বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখকঃ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button