বিশেষ কলাম

ব্যাংক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে দরকার জোরালো প্রচেষ্টা

ড. শাহ মো. আহসান হাবীবঃ কভিড-১৯ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সর্বস্তরে একটি সমন্বিত ঝুঁকির পরিবেশ তৈরি করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এ মহামারীর ঢেউ বারবার আছড়ে পড়ার কারণে পৃথিবীর সর্বত্র এবং সর্বক্ষেত্রে একটি অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওমিক্রন এক্ষেত্রে অতিসাম্প্রতিক অনিশ্চয়তার ঢেউ। আশার কথা হলো, এরই মধ্যে কভিড-১৯-এর টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং মানবদেহে এর সফল প্রয়োগও সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ভাইরাসটির আরো বিস্তার, গতি-প্রকৃতি এবং এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন সম্ভাব্য জটিলতা, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক খাতে এর সম্ভাব্য প্রভাব ও বিপর্যয় সম্পর্কে একটি সম্ভাব্য মূল্যায়ন বা ধারণাও আমাদের এরই মধ্যে হয়েছে বা আমরা করার ক্ষেত্রে সামর্থ্য অর্জন করে চলেছি।

কভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে যে বাধাবিপত্তি ও বিপর্যয় তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে সব ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব আর্থিক খাতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ব্যাংক খাত বা সর্বোপরি আর্থিক খাত কভিড-১৯-এর প্রথম ঢেউয়ের সময়ই ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং এরপর অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও সেই বিপর্যয়ের ধাক্কা এখনো পুরোপুরি সামলে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে টিকিয়ে রাখা এবং যত দ্রুত সম্ভব একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন ইতিবাচক কৌশল ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নতুন সার্কুলার জারি

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি অর্থনীতির জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে কভিড-১৯ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ সারা পৃথিবীর সামনে অত্যন্ত দৃশ্যমান ও কার্যকর ছিল। আমাদের অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রায় সব ধরনের আর্থিক সহায়তার জন্য অনেকটা এককভাবেই আমরা ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর এ কারণেই মহামারীর প্রথম ঢেউয়ের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখার জন্য যেসব এবং যে মাত্রায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তাতে দেশের ব্যাংকগুলোকে বেশ দায়িত্বশীলতা ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। সব ধরনের ঋণের সঙ্গে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের যে সংশ্লিষ্টতা, তা ব্যাংক কার্যক্রমের তাত্ত্বিক পরিভাষা থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সামগ্রিকভাবে অর্থায়ন পরিস্থিতি এবং এ খাত থেকে যে পরিমাণ প্রত্যাশা—এ দুয়ের মধ্যকার ব্যবধান ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কভিড-১৯-এর কারণে বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে আপত্কালীন কৌশল হিসেবে সারা বিশ্বের নীতিনির্ধারকরা প্রায় একই কৌশল অবলম্বন করেছেন আর তা হলো ব্যাংকে নগদ টাকার জোগান দিয়ে ব্যাংক খাতে অধিকতর তারল্য নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করে অর্থনীতির গতি বজায় রাখা। এ-সম্পর্কিত বেশকিছু কৌশলের সফল প্রয়োগও আমরা এরই মধ্যে দেখেছি। আর্থিক খাত পুনরুদ্ধারের জন্য নীতিনির্ধারকদের গৃহীত উদ্যোগগুলোকে সহায়তার জন্য ব্যাংকগুলো এখন প্রণোদনা প্যাকেজের দ্বিতীয় দফা বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করছে। আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের মূল লক্ষ্য হলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহককে প্রণোদনার আর্থিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের চিহ্নিত করে তাদের কাছে পৌঁছানো বেশ কঠিন এবং সময়সাধ্য বিষয়। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের গতানুগতিক ধরন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত তারল্য সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রাখে।

এছাড়া ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে শ্লথগতি, উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নমুখী চাহিদা ও বাজারধসের কারণে ঋণ চাহিদার নিম্নমুখী প্রবণতা সব ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। উদ্বৃত্ত তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশল ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, যা ব্যাংকগুলোকে বিশেষ করে মূল্যবৃদ্ধির গতি রাশ টেনে ধরতে সহায়তা করেছে। পরবর্তী পর্যায়ে আবার ঋণের চাহিদা বেড়ে ব্যাংক তারল্যে চাপ বাড়াতে শুরু করে। সেক্ষেত্রে আবার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি, আর্থিক অবস্থা দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ প্রচেষ্টা ইত্যাদি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে নৈতিক বিপদও যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্ত হলো ওমিক্রন সংশয়।

একথা সর্বজনবিদিত যে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ব্যাংক সাধারণ জনগণের আমানত ও সঞ্চয়ের জিম্মাদার। সাধারণত ব্যাংক একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামোর আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। মহামারীর কারণে উদ্ভূত বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গ্রহণযোগ্য এবং সহজ শর্তে দ্রুত ঋণ প্রদানের বিষয়টি কেউই অস্বীকার করছেন না। একক সংখ্যার সুদহার নির্ধারণ করে নীতিনির্ধারকরা সেই পদক্ষেপই গ্রহণ করেছেন। তবে এটাও ঠিক যে আমানতকৃত অর্থের বিপরীতে আমানতকারী যা প্রাপ্য হবেন, তা যেন যৌক্তিক হয়, অর্থাৎ তা যেন মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম না হয়।

সর্বোপরি ব্যাংকে জমা অর্থের বিনিময়ে নেতিবাচক সুদহার কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। মহামারীর সময় ব্যাংক আমানতের অত্যন্ত নিম্নমুখী সুদহার দেশের অসংখ্য ক্ষুদ্র আমানতকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমানতের সুদহার-সংক্রান্ত হস্তক্ষেপ একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে এ পর্যায়ে ভাবনার ব্যাপার হলো ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান! ঋণ-আমানত সুদহারের ব্যবধানের সঙ্গে ব্যাংক খাতের দক্ষতা সম্পর্কিত। প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের ব্যাংক খাত কি এ সুদ আয় দিয়ে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? আশা করছি তা হোক। অন্যথায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় নীতিনির্ধারকদের আবার এ-সংক্রান্ত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।

কভিড-১৯-এর কারণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে জটিল এ পরিস্থিতিতে উচ্চমাত্রার মূলধন বা ‘ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও’ বজায় রাখা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ব্যাংকের দিক দিয়ে দেখতে গেলে উচ্চমাত্রার মূলধন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য নির্দেশ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন ক্যাপিটাল বা মূলধন যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, কোনো কোনো ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতিও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ক্যাপিটাল বা মূলধনের দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে—এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও শ্রীলংকার চেয়েও আমরা পিছিয়ে আছি।

অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কর্মযজ্ঞের মাঝে শ্রেণীকৃত ঋণের যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে অদূরভবিষ্যতে শ্রেণীকৃত বা মন্দ ঋণ এবং এর বিপরীতে সংরক্ষিত জমা কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত অর্থনৈতিক ও আর্থিক বাজার উন্নয়নে এখন নীতিনির্ধারকদের যে বিশেষ কার্যক্রম রয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হলে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে এবং এ সময়ে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ সমস্যা সফলভাবে সামলাতে প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত ক্যাপিটাল বা মূলধনের।

আমরা এখন পর্যন্ত বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারিনি, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ‘এন্টারপ্রাইজ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ হচ্ছে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও কার্যকরী পন্থা, যা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। এ ব্যাপারে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। ‘সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’র অংশ হিসেবে একটি চৌকস দল নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্বকে অবগতকরণ এবং এসবের ভিত্তিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবে। পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করবে। কভিড-১৯-এর প্রথম ঢেউয়ের পর বেশকিছু ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীল অবস্থা আনার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম চলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে প্রয়োজন বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ। কোনো সন্দেহ নেই যে ডিজিটাল প্লাটফর্ম নিশ্চিত করা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার একটি প্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

এ রকম নাজুক একটি সময়ে এ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহজ নয়। এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। আর সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইবার ঝুঁকি ও পরিচালনগত ঝুঁকি, যা মোকাবেলা না করলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ করতে হবে নতুন পরিস্থিতিতে কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী জনবল তৈরিতেও। এ অবস্থায় সম্ভাব্য ঝুঁকি ও আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও অংশীদারি পক্ষগুলোর কাছে স্বচ্ছ থাকা জরুরি। ব্যাংক খাতে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত ক্যাপিটাল বা মূলধনের পরিমাণ নিরূপণ এবং যথেষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ করে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিকল্প নেই।

লেখকঃ ড. শাহ মো. আহসান হাবীব: অধ্যাপক ও পরিচালক (প্রশিক্ষণ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button