মানি লন্ডারিং

মানিলন্ডারিং ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

দিনু প্রামানিকঃ মানিলন্ডারিং ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ- সমাজের অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা অবৈভাবে অর্জিত বা আহরিত অর্থ মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে বৈধ করার অপপ্রয়াস পায়। মানিলন্ডারিং আওতায় তারা নানান ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে। বর্তমান ভোক্তা বাজারের একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যখন কোন ব্যবসায়ীকে আলু ক্রয় করার জন্য এবং আলুজাত পণ্য গুদামজাত করার জন্য আলুর পিক সিজনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদান করে অথবা ব্যবসায়ী নিজ অর্থায়নে বিনিয়োগ করে। ব্যবসায়ী ঋণের সুদসহ, আলু কেনা, গুদামজাতকরণ ও পরিবহনসহ হয়ত একুশ টাকা কেজি দরে খরচ হয় এবং তা একচ্ছত্র বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আলুর দাম বিয়াল্লিশ টাকা দরে বিক্রি করা হয় তখন ঐ ব্যবসা ফটকা বা অবৈধ ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং তা এক ধরনের মানিলন্ডারিং।

এভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোক্তা পণ্যের বাজার তথা পেঁয়াজ, ডাল, ডিম, মুরগি বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। একই সাথে বিলাস বা ফ্যাশন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এমনকি ভ্যান- রিকশা ভাড়া বা দিন মজুরির দামও বেড়ে যায়। জীবনযাত্রার মান একটার সাথে অন্যটা ওতপোতভাবে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে সরকার পার্শ্ববর্তী বা অন্য কোনো দেশ হতে খাদ্য সাময়িক সংকট কাটাতে আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এ নেগেটিভ বা ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বৈদেশিক রিজার্ভ এ প্রভাব পড়ে এবং দেশের অর্থনীতির শক্ত অবস্থানের ধাক্কা লাগে। এগুলো মানিলন্ডারিং এর ফলে ঘটে। অর্থাৎ মানিলন্ডারিং একটার পর আরেকটা অপরাধের সংঘটনে ঊৎসাহিত করে, ফলে জীবনযাত্রার মান যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠে তেমন অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়। এটি যেমন ক্ষতির কারণ তেমনই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। শুধু জাতীয় অর্থনীতির জন্যও না, বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর বটে।

আরও দেখুন:
মানিলন্ডারিং এর সা‌থে সম্পৃক্ত অপরাধসমূহ

মানিলন্ডারিং কি, কীভাবে মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয় এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব কি! অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের অবৈধ ঊৎস গোপনকরনের ঊদেশ্য রূপান্তর বা স্থানান্তরের যে প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে উক্ত অর্থ বৈধ করা হয় তাই মানিলন্ডারিং। সহজ কথায়, কালো টাকাকে সাদা করার পথই হলো মানিলন্ডারিং। সাধারণত তিনটি উপায়ে মানিলন্ডারিং হয়ে থাকে। ©প্লেসমেন্ট ©লেয়ারিং; ও ©ইন্টিগ্রেশন বা মিশ্রণ। প্রথম ধাপে অবৈধ অর্থ প্রবেশ করানো হয় এবং দ্বিতীয় ধাপে অর্থকে বিভিন্নভাবে খেলানো হয়। প্রথম দুই’টা ধাপ পার হলেই তৃতীয় ধাপে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ জাতীয় অর্থনীতি’তে অনুপ্রবেশ ঘটে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

প্রশ্ন হলো অবৈধ অর্থ কীভাবে অর্জিত হয়। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ ( ২০১২ সনের ৫ নং আইন) এর ২ (শ) নং ধারায় “সম্পৃক্ত অপরাধ (Predicate Offence)” অর্থ নিম্নে উল্লিখিত অপরাধ, যা দেশে বা দেশের বাইরে সংঘটনের মাধ্যমে অর্জিত কোন অর্থ বা সম্পদ লন্ডারিং করা বা করার চেষ্টা করা, যথা- দুর্নীতি ও ঘুষ, মুদ্রা জালকরণ, দলিল দস্তাবেজ জালকরণ, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, অবৈধ মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটকিয়ে রাখা ও পণবন্দি করা, খুন, মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি, নারী ও শিশু পাচার, চোরাকারবার, দেশী ও বিদেশি মুদ্রা পাচার, চুরি বা ডাকাতি বা দস্যুতা বা জলদস্যুতা বা বিমান দস্যুতা, মানব পাচার, যৌতুক, চোরাচালানি ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ, কর সংক্রান্ত অপরাধ, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থ যোগান, ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন, পরিবেশগত অপরাধ, যৌন নিপীড়ন (Sexual Exploitation), পুঁজিবাজার সম্পর্কিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে তা কাজে লাগিয়ে শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে বাজার সুবিধা গ্রহণ ও ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার লক্ষ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা (Insider Trading & Market Manipulation), সংঘবদ্ধ অপরাধ (Organized Crime) বা সংঘবদ্ধ অপরাধী দলে অংশগ্রহণ, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায় এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরকারের অনুমোদনক্রমে গেজেট, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষিত অন্য যে কোন সম্পৃক্ত অপরাধ।

মানিলন্ডারিং দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থার গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। এটি শুধু ক্ষতিসাধন করে না বরং অবৈধ ব্যবসায়ী যেমন- মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানি, সন্ত্রাসী চক্র, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও অন্যান্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সম্প্রসারণে অর্থ যোগান দেয়। এখানে অর্থ যোগানদাতা মাধ্যমও সম অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু মানিলন্ডারিং সম্পন্ন অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ সেহেতু এটা দ্বারা সরকারের রাজস্ব কোন আয় হয় না বরং দেশের রাজস্ব হ্রাস করে। যা উদাহরণে পরিষ্কার করা হয়েছে। মানিলন্ডারিং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটায় ফলে একটি দেশের সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। যার প্রতিফলনে আর্থ সামাজিক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা অপরাধী চক্রের হাতে চলে যায়। এতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পরে এবং ঘুষ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে যা দুর্নীতিকে আরো উৎসাহিত করে; অতএব এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড কোন জাতির জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে দেশের অর্থ যেমন বিদেশে পাচার হয় তেমনি উপার্জিত অর্থ হুন্ডি ব্যবসায় ব্যবহৃত হয় এবং দেশে বৈধ রেমিট্যান্স ব্যাহত হয়। এতে দেশ বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বঞ্চিত হয় এবং রিজার্ভ এর পরিমাণ হ্রাস পায়। মানিলন্ডারিং এর সাথে জড়িত অপরাধীচক্র আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে আমদানি- রপ্তানি ব্যবসার সুযোগ গ্রহণ করে দেশের ক্ষতিসাধন করার পাঁয়তারা করে ফলে দেশের শুল্ক ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় ও বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়। বিদেশে পাচারসহ অবৈধ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়। অর্জিত অবৈধ অর্থ শেয়ার বাজার এবং জমি বা ফ্ল্যাট কেনা বেচায় অনুপ্রবেশ করে কৃত্রিম উপায়ে শেয়ার বাজার ও জমি কেনা বেচার বাজার চাঙ্গা করে এবং দালাল ফড়িয়ার দাপট বেড়ে যায়। এতে করে সাধারণ মানুষের সীমিত আয়ের অর্থ মানি মার্কেটে বিনিয়োগ না হয়ে বরং ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগের অপচেষ্টা বেড়ে যায়।

সাধারণ মানুষের ক্যাপিটাল মার্কেট সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কোন কোন সময়ে তারা সর্বস্বান্ত বা নিঃস্ব হয়ে যায়। এটাও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বৈধ রূপ লাভ করায় বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়; যার কারণে ভোক্তা সাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। মানিলন্ডারিং যেমন ব্যাংকিং ব্যবসায় ক্ষতি সাধন করে তেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ হয়ে যায়। দেশের সঠিক জি.ডি.পি. নির্ধারণে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। যা সারা বিশ্বে এক দুষ্টক্ষত হিসেবে আবির্ভূত হয়। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তখন রাষ্ট্রের হাত থেকে অপরাধীচক্রের হাতে চলে যায়।

১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত হয় ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে শুরু হয় ইন্টারনেটভিত্তিক তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময় তথ্য প্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হয় এবং সারা বিশ্বের গতি বেড়ে যায় এবং ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল জগতের। মানিলন্ডারিং এর সাথে জড়িত অপরাধীচক্র এখানে নতুন নতুন ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে অর্থনীতিকে একটি চ্যালেঞ্জ এর মুখে ঠেলে দিতে পারে। বর্তমানে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব’কে উপেক্ষা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে, ভার্চুয়াল জগতের আরও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে। যেখানে মানুষের আয়ত্তে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট, যা সম্পূর্ণ রূপেই মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলছে ব্যাপক তোলপাড়।

প্রযুক্তিনির্ভর এ ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। যেখানে বড় ভূমিকা রাখবে ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)। অটোমেশনের এ যুগে মানিলন্ডারিং এর সাথে জড়িত অপরাধীচক্র আরো ভয়াবহ হয়ে যে উঠবে না; তা আমরা কেমনে অস্বীকার করব। অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য কতটা প্রস্তুত আমরা! আর এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের কর্মকর্তাদের’কে উন্নত করতে হবে। উন্নত করতে হবে ই-গভর্ন্যান্স, সার্ভিস ডেলিভারি, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিমেনটেশন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিকেন্দ্রীকরণ, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা এবং এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও প্রশাসনিক নীতি কৌশল নিয়ে ক্লাউড সার্ভার, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান এর মাধ্যমে।

পরিশেষে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ করি। অর্থনীতিকে সম্মৃদ্ধশালী করি। সুখী- সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ি।

লেখকঃ দিনু প্রামানিক, ব্যাংকার ও লেখক এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপক ও শাখা প্রধান, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, রাজশাহী শাখা, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button