মানি লন্ডারিং

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংকারদের দায়িত্ব: ৪র্থ পর্ব

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ CDD, EDD, KYC: কেওয়াইসি এর অর্থ হল “নো ইয়োর কাস্টমার” অর্থাৎ “আপনার গ্রাহককে জানুন” এবং এই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয় কোন আর্থিক সংস্থায় অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে গ্রাহক সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার জন্য। কেওয়াইসি–এর মাধ্যমে একজন গ্রাহকের পরিচয় ও ঠিকানা প্রতিষ্ঠিত করা হয় ও নির্ধারিত সচিত্র পরিচয়পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণ ও ব্যক্তিগত যাচাই ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক সমর্থনকারী নথির দ্বারা।

সংক্ষেপে Know Your Customer KYC (কেওয়াইসি) হলো ব্যাংক ও ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট খুলতে বা লেনদেন করতে, বিমা চালু বা ফান্ডের লগ্নির আগে গ্রাহকের পরিচয় প্রমাণ করতে যে নথি লাগে তাকেই বলে কেওয়াইসি।

কেন এই ব্যবস্থা
কালো টাকা লেনদেন ও সন্ত্রাসবাদী কাজে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার অপব্যবহার রুখতে কেওয়াইসি পদ্ধতি চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকের পরিচয়, ঠিকানা, অর্থের উৎস জেনে নেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তা যাচাইয়ের পরে অ্যাকাউন্ট খোলা বা লেনদেনের অনুমতি দেওয়া হয়।

কেওয়াইসি-র মূলতঃ তিনটি আবশ্যকীয় তথ্য—
• পরিচয়ের প্রমাণ। অর্থাৎ গ্রাহক যে নামে অ্যাকাউন্ট খুলছেন বা লেনদেন করছেন, তিনিই সেই ব্যক্তি কি না, তা নিশ্চিত করা হয়।
• বাসস্থানের প্রমাণ। যেখানে নিজের/ ভাড়া বাড়ি বলে জানাচ্ছেন, সেখানে আদৌ তিনি থাকেন কি না, সেটা দেখা হয়।
• গ্রাহকের পেশা, আয়ের উৎস ও পরিমাণ অর্থাৎ গ্রাহকের অর্থপ্রাপ্তি কোথা থেকে হয় এবং তার পরিমাণ কত তার ঘোষণা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

পরিচয় এবং ঠিকানার জন্য আলাদা নথি জমা দিতে হয়। সেগুলি হল (একটির অভাবে আরেকটি)—
• পাসপোর্ট;
• জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ড;
• ভোটার আইডি কার্ড;
• জন্ম নিবন্ধন পত্র;
• TIN সনদ;
• ভ্যাট রেজিস্ট্রেশান নম্বর;
• ড্রাইভিং লাইসেন্স।

আরও দেখুন:
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের কার্যকারিতা ও ব্যাংকারদের দায়িত্ব – তৃতীয় পর্ব

ব্যাংকগুলো নিজেদের অনলাইন কানেকটিভিটি ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনের সাথে সংযুক্ত হওয়া সার্ভার থেকে এখন জাতীয় পরিচয় পত্র ভেরিফাই করতে পারে। প্রয়োজনে এরকম সনদ হিসাব নথিতে রাখতে পারে।

বাসস্থানের জন্য দরকার
• টেলিফোন বিল।
• অন্য কোনও ব্যাংকে লেনদেনের প্রমাণপত্র।
• বিদ্যুতের বিল।
• রেশন কার্ড।

যখন face to face interview-তে কোন ব্যাংক কর্মী গ্রাহক সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না সেক্ষেত্রে তিনি বাসস্থান ঠিকানায় physical verification করতে পারেন।

ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ভোটার কার্ডের মতো নথিতে গ্রাহকের ঠিকানা থাকে। কিন্তু বহু সময়ে দেখা যায় গ্রাহক সেখানে থাকেন না। তাই ওই নথি ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে জমা দিলেও বহু ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বর্তমান ঠিকানায় গ্রাহকের নামে থাকা বিদ্যুৎ বা টেলিফোন বিল জমা দিতে বলে।

সাধারণত ঝুঁকির ভিত্তিতে গ্রাহকদের তিন ভাগে ভাগ করে ব্যাংকগুলি—
• কম ঝুঁকি। এই সব গ্রাহকদের ৫ বছর অন্তর হালনাগাদ KYC জমা দিতে বলা হয়।
• বেশি ঝুঁকি। ১ বছর অন্তর নতুন করে KYC চাইতে পারে ব্যাংক।
• তবে প্রয়োজনে সময়সীমার আগেই ফের নথি চাওয়া হতে পারে।

ঝুঁকি মাপার মাপকাঠি
একাধিক মাপকাঠির ভিত্তিতে গ্রাহকের ঝুঁকি মাপা হয়। যার মধ্যে থাকে—
• গ্রাহকের পরিচয়।
• তাঁর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান।
• তিনি কী ধরণের কাজ করেন।
• তিনি কোথায় বসবাস করেন।
• পুরো কেওয়াইসি তথ্য জমা না-দিলে অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না।

Customer Due Diligence (CDD) গ্রাহক সম্পর্কিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
নির্ভরযোগ্য ও স্বাধীন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত ও দলিলাদির ভিত্তিতে গ্রাহকের পরিচিত যাচাইকরণ ও সনাক্তকরণ সহ হিসাবের লেনদেন নিয়মিত ভাবে মনিটরিং করাকে বুঝবে।

CDD করতে হবে-
• গ্রাহকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন।
• আর্থিক লেন্দেনের সময়।
• হিসাবধারী নয় এমন গ্রাহকের অনুরোধে অর্থ স্থানান্তরকালে।
• Walk in Customer-দের যে কোন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে।
• অপর্যাপ্ত ও বেঠিক দলিলাদি সংগৃহিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হলে।

কোনো লেনদেন মানিলন্ডারিং/ সন্ত্রাসী কার্যে জড়িত–
• তবে তথ্যের গোপনীয়তা ফাঁস (Tipping-Off) হবার সম্ভাবনা রয়েছে, এক্ষেত্রে CDD সম্পাদন না করেই সন্দেহজনক লেনদেন/ কার্যক্রম রিপোর্ট করতে হবে;
• হিসাবের প্রকৃত সুবিধাভোগী। (Beneficial Owner) সনাক্তকরণ পূর্বক ব্যাংকের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে পরিচিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং পরিচিতির সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে:
– যদি কোনো গ্রাহক অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে হিসাব পরিচালনার করে, সে ক্ষেত্রে গ্রাহক ছাড়া ও উক্ত ব্যক্তির পরিচিতি;
– যদি কোন ব্যক্তি কোন গ্রাহককে নিয়ন্ত্রণ/ প্রভাবিত করে সে ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির;
– কোম্পানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করি শেয়ার হোল্ডার অথবা ২০% তদূর্ধ্ব একক শেয়ার হোল্ডারকে প্রকৃত সুবিধাভোগী বিবেচনা করা।

গ্রাহক সম্পর্কিত সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা (Simplified Customer Due Diligence SCDD)
• Walk in Customer কর্তৃক অনুর্ধ ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রেরণকারী/ আবেদনকারী ও প্রাপক/ বেনেফিসিয়ারের নাম ও ঠিকানা এবং প্রেরণকারী/ আবেদনকারীর টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করতে হবে।
• লেনদেনের পরিমান ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) এর অধিক বা ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) এর নিচে হলে বর্ণিত তথ্যাদির পাশাপাশি প্রেরণকারী বা আবেদনকরি বা জমাকারী বা উত্তোলন কারীর ছবিযুক্ত আইডি সংগ্রহ করতে হবে।
• স্কুলের ছাত্রের হিসাব, কৃষকের হিসাব এবং অন্যান্য No Frill Account এর ক্ষেত্রে গ্রাহক সম্পর্কিত সহজতর সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

CDD সম্পর্কিত অন্যান্য নির্দেশনা
• BFIU কর্তৃক জারিকৃত হিসাব খোলার ফর্মের আলোকে প্রণীত নিজস্ব হিসাব খোলার ফর্ম।
• একই গ্রাহকের একাধিক হিসাব পরিচালিত হলে মনিটরিং এর সবিধার্থে। Unique Customer Identification code (UCIC) বরাদ্দ করবে।
• Transaction Profile সংগ্রহ করবে ও ৬ মাসের মধ্যে যথার্থতা নিরূপণকরত: সংশোধন করবে।
• KYC হালনাগাদ করুন:
– নিম্ন ঝুঁকির ক্ষেত্রে ৫ বছর;
– উচ্চ ঝুঁকির ক্ষেত্রে ১ বছর;
– গ্রাহক পরিচয়মূলক তথ্য পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে;
– প্রয়োজন অনুভূত হলে যে কোনো সময়।

CDD সম্পাদন করা সম্ভব না হলে ব্যাংকের করণীয়
• হিসাব খুলবে না বন্ধ করে দিবে।
• গ্রাহককে নোটিশ দিতে হবে:
– উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোন গ্রহণ;
– হিসাব বন্ধকরণের কারণ ব্যাখ্যা পূর্বক গ্রাহককে নোটিশ প্রদান।
• প্রয়োজনে STR করতে হবে।
• হিসাব না খোলা বা বন্ধ করা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ পূর্বক মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ ডিভিশন/ বিভাগে প্রেরণ করা।

Enhanced Due Diligence (EDD) গ্রাহক সম্পর্কিত অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
ব্যাংক কর্তৃক যে সমস্ত হিসাব উচ্চ ঝুকি (High Risk) সম্পন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে:
• স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য কোন উৎস (Independent and reliable sources) থেকে গ্রাহক পরিচিত সম্পর্কিত অতিরিক্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হবে;
• হিসাব খোলার উদ্দেশ্য, হিসাবের অর্থ বা সম্পদের উৎস জানার জন্য অধিকতর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
• ব্যাংকের উপযুক্ত উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে);
• হিসাবের লেনদেন নিয়মিত ভাবে মনিটর করা।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button