ইসলামী ব্যাংকিং

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উদ্ভব ও কর্মপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গে

মোহাইমিন পাটোয়ারীঃ ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা তথা ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন ইত্যাদি পরিচালিত হয়ে আসছে ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই। তবে কোনো খলিফা বা মুসলিম অর্থমন্ত্রী এ রকম প্রতিষ্ঠানের প্রচলন করেননি। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই ‘ব্যাংক’-কে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদরা ব্যাপক গবেষণা ও যুক্তি-তর্ক শুরু করেন। কিন্তু এ উদ্যোগ মুসলিম সমাজে প্রবেশ করাতে লেগে গিয়েছে ৬০০ বছর! অর্থাৎ ব্যাংককে ‘ইসলামী রূপে উপস্থাপন করার ইতিহাস মাত্র ৫০-৬০ বছরের। ৬০০ বছর মুসলিম সমাজ সতর্কতার সঙ্গেই পশ্চিমা ব্যাংক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ দিকে এসে আধুনিক অর্থনীতিতে মুসলিমদের জমানো টাকা কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে দুর্বার চিন্তা শুরু হয়।

প্রথমে অর্থ জমানোর বেশকিছু ‘আধুনিক’ প্রয়োজন, যেমন হজের টাকা জমানোর মতো প্রয়োজন সামনে রেখে শুরু হয় ‘ইসলামী’ ঘরানার সঞ্চয় পদ্ধতি। ১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ায় ‘পিলগ্রিমস সেভিংস করপোরেশন’ নামে হজের জন্য সঞ্চয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে সুদমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। এ করপোরেশন মুসলিমদের কিস্তিতে টাকা জমানোর সুযোগ দিত এবং কোনো ধরনের সুদ দিত না। সে সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই সব ব্যাংক তার ‘আমানত’কারীদের সুদ দিত। সে হিসাবে ‘পিলগ্রিমস সেভিংস করপোরেশন’ নতুন কোনো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারেনি।

আরও দেখুন:
ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস

তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রাথমিক কিন্তু শক্তিশালী এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল মিসরের ‘মিট ঘামর’ এলাকায় ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে। তবে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেরণার মূলে ছিল জার্মান সেভিংস ব্যাংক। জার্মান সেভিংস ব্যাংকের সাফল্য দেখে তার আদলে মিসরের মিট ঘামার এলাকার গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন ড. আহমদ আল নাজ্জার। কিন্তু তত্কালীন মিট ঘামরের মানুষগুলো ছিল ধর্মভীরু মুসলিম। তাই তারা তাদের টাকা-পয়সা ব্যাংকে জমা রাখত না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ অবস্থায় এই ব্যাংকের উদ্যোক্তার চ্যালেঞ্জ ছিল দুটো—মানুষকে টাকা জমানোর মর্ম বোঝানো ও ইসলামী মূল্যবোধ ধরে রাখা। এজন্য এ প্রকল্প ছিল সবার কাছে খুবই আকর্ষণীয়। মিট ঘামরের ওই ব্যাংকে তিন ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা হতো—সেভিংস অ্যাকাউন্ট, ইনভেস্টমেন্ট অ্যাকাউন্ট ও জাকাত অ্যাকাউন্ট।

১. যারা টাকা জমা রাখত সেভিংস অ্যাকাউন্টে, তাদের কোনো ধরনের সুদ বা মুনাফা দেয়া হতো না, কিন্তু তারা যখন চাইবে তখন টাকা তুলতে পারবে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তবে তারা চাইলে ছোট ও স্বল্পমেয়াদি সুদবিহীন ঋণ নিতে পারত ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য। ২. ইনভেস্টমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া অর্থ তোলার ব্যাপারে একটু কড়া নিয়ম ছিল, চাইলেই তোলা যেত না এবং সেই টাকা শরিয়ার অংশীদারিত্ব ভিত্তিতে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হতো। ৩. আর জাকাত অ্যাকাউন্টের অর্থ শরিয়া নিয়ম অনুযায়ী গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হতো।

প্রথম চালু করা এ রকম ব্যাংকিং চার বছরে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সাফল্য পায়। তাদের সেভিংস ২৫ হাজার মিসরীয় পাউন্ড থেকে মাত্র চার বছরের মধ্যেই বেড়ে ৭৫ হাজারে মিসরীয় পাউন্ডে উন্নীত হয়। একই সময়ে ইনভেস্টমেন্ট অ্যাকাউন্টগুলোয় জমা অর্থের পরিমাণ ৩৫ হাজার মিসরীয় পাউন্ড থেকে বেড়ে ৭৫ হাজারে উন্নীত হয়। তারা অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছিল। ফলে প্রথম তিন বছরে ৬০ শতাংশ ঋণের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল তারা। কোনো দেউলিয়া বা ঋণখেলাপিও তৈরি হয়নি।

ড. আহমদ আল নাজ্জারের তৈরি করা এ ‘মিট ঘামর ব্যাংক’ রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মিট ঘামর ব্যাংক এ ধারণা দিয়ে যায় যে প্রচলিত ব্যাংক ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ ধরে রেখে হয়তো চালানো সম্ভব। মিট ঘামরের সেই প্রতিষ্ঠানটি বেশিদিন না টিকলেও তার আদলে ব্যাংক চালু করার ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বে আলোচনা হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ কর্মসূচি ‘Sturactural Adjustment Programme’-এর আওতায় বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশের সরকার ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন শামি’য়াল দারভিশ, আব্বাস মীরাখান ও মহসীন খানের মতো মানুষ, যারা সবাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।

১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী অর্থ সংস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পাকিস্তানের লাহোর সম্মেলনে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে এবং সেই বছরই জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চার্টার গৃহীত হয়। বাংলাদেশ সরকার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সেই চার্টারে স্বাক্ষর করে।

১৯৭৫ সালে সৌদি আরবে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকটি (আইডিবি) যাত্রা করে এবং এই আইডিবির হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কুয়েত, সেনেগাল, বাহরাইন, পাকিস্তান, ইরান, সুইজারল্যান্ড, আম্মান, জর্ডান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হয়।

১৯৮২ সালের নভেম্বরে আইডিবির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নিবন্ধিত হয়। মূলত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘ইসলামী’ ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।

এই দ্রুত বর্ধনশীল খাতকে সংগঠিত করার জন্য ১৯৯০ সালে অ্যাকাউন্টিং ও অডিটিং সংস্থা (AAOIFI) খোলা হয়। ১৯৯৬ সালে সিটি ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করে এবং অন্য ব্যাংকগুলো শিগগিরই এ পথ অনুসরণ করে।

ইসলামী ব্যাংকগুলো কীভাবে কাজ করে?
ইসলামে কোনো একটি বস্তু ঋণ দিয়ে সেই একই বস্তুর অধিক পরিমাণে ফেরত নেয়ার নাম সুদ। সময়ের বিলম্বের কারণে হোক কিংবা লোভের কারণে—যে কারণেই ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত ফেরত নেয়া হোক না কেন, তা সুদ বলে গণ্য। কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্যে একটি পণ্য বা সেবা লাভে লেনদেন করলে তা বৈধ, যেমন কাজের বিনিময়ে টাকা, টাকার বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি। এর সবগুলোকে মোটাদাগে আমরা বলতে পারি ‘ব্যবসা’।

ব্যবসার একটা মৌলিক দিক হলো, এর লাভ-লোকসান অনেকটাই অনির্দিষ্ট এবং বাকিতে বিক্রি করাটাও সম্পূর্ণ বৈধ। ঠিক এ দুটি বিষয়কেই কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং খাতে ঋণ আদান-প্রদানের লাভজনক কৌশলই ইসলামী ব্যাংকের সর্বব্যাপী মুরাবাহা পদ্ধতি। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক—

আপনি একটি গাড়ি কিনতে যদি সাধারণ ব্যাংকের কাছে ঋণ চান, ব্যাংক আপনাকে ২০ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে তার সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেবে, ‘আপনি আমাদের আগামী পাঁচ বছরে ১০ শতাংশ সরল সুদে মোট ৩০ লাখ টাকা কিস্তিতে ফেরত দেবেন। অর্থাৎ প্রতি বছর ৬ লাখ টাকা।’

ঠিক একই উদ্দেশ্যে আপনি যখন ইসলামী ধারার ব্যাংকে যাবেন তখন তারা আপনাকে জিজ্ঞাস করবে, ‘কী জন্য আপনার টাকা লাগবে?’ আপনি বলবেন, ‘২০ লাখ টাকার একটা গাড়ি কিনব তাই।’ তারা তখন আপনাকে বলবে, ‘আচ্ছা আমরা আপনাকে ২০ লাখ টাকার গাড়ি কিনে দিচ্ছি। তবে আমরা যে দামেই কিনি না কেন, আপনার কাছে বাকিতে বিক্রি করব ৩০ লাখ টাকায়।’ তারপর তারা আপনাকে শর্ত জুড়ে দেবে, ‘আপনি এ টাকা প্রতি বছরে ৬ লাখ করে মোট পাঁচ বছরে ফেরত দেবেন।’

এ পদ্ধতিটাই ‘মুরাবাহা’ নামে চলছে। সুচিন্তিত পাঠক মনে মনে ভাবতে পারেন সামান্য কিছু নিয়মকানুনের কারসাজি ছাড়া এ দুয়ের পার্থক্য কোথায়? এক্ষেত্রে আসলেই তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধুই ‘পদ্ধতিগত’ পার্থক্য আর সামান্য ঝুঁকি বহন। ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্যান্য ব্যাংক ২০ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে ৩০ লাখ ফেরত চায়, আর এই অতিরিক্তটা সুদ। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো ২০ লাখ টাকার জিনিস ৩০ লাখ টাকায় বাকিতে বিক্রি করে কিস্তিতে এ টাকা ফেরত চায়, তাই অতিরিক্ত অর্থটা নেয়া শরিয়া অনুমোদিত। উভয়েই সমান লাভ করে কিন্তু একজন লাভ করে সুদে, অন্যজন লাভ করে ব্যবসা করে। তাই একটি হালাল, আরেকটি হারাম।

আরেকটি ছোটগল্পের মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। মনে করি, একজন স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তার নাম সিন্দাবাদ। সিন্দাবাদ স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি সিন্দাবাদের মতো জাহাজে করে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যবসা করবেন। কিন্তু জাহাজ কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। তার পরেও সিন্দাবাদ হাল ছাড়ার পাত্র নন। স্বপ্ন পূরণ করা তার চাই-ই চাই। উপায়ন্তর না দেখে সিন্দাবাদ টাকা ধার নিতে কেহেরমানের কাছে গেলেন, যার ব্যাগ ভরা থাকে টাকায় আর মন ভরা থাকে লোভে।

কেহেরমান সাহেব সিন্দাবাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের কথা শুনে খুব খুশি হলেন এবং সাহায্য করতে রাজি হলেন। তবে বিনা লাভে নয়। এদিকে কেহেরমান সাহেব যেহেতু মুসলিম, তিনি ইসলামী আইনে টাকা ধার দিয়ে সুদ চাইতে পারেন না। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে কেহেরমান সাহেব মোক্ষম একটি বুদ্ধি বের করলেন। সিন্দাবাদকে হাতে হাতে ১ কোটি টাকা ধরিয়ে না দিয়ে পরিচিত কোনো ব্যক্তিকে (অথবা খোদ সিন্দাবাদকেই) হুকুম দিলেন ১ কোটি টাকার একটি জাহাজ কেহেরমান সাহেবের নামে কিনে নিতে। জাহাজ কেনা হলো। এর মালিক হচ্ছেন কেহেরমান সাহেব।

এবার কেহেরমান জাহাজটি সিন্দাবাদের কাছে বিক্রি করলেন ২ কোটি টাকায়। শর্ত হচ্ছে সিন্দাবাদকে সাত বছরের কিস্তিতে এ টাকা পরিশোধ করতে হবে। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সিন্দাবাদ কেন ১ কোটি টাকার জাহাজ ২ কোটি টাকায় কিনবে?

কিনবে এজন্য যে তার হাতে জাহাজ কেনার মতো টাকা নেই। তার ঋণের প্রয়োজন। ঋণ দেবেন কেহেরমান সাহেব। কিন্তু যেহেতু কেহেরমান মুসলিম, তিনি ব্যবসায়ীর রূপ ধরে নিলেন, যাতে লাভটাকে আর সুদ বলা না যায়। এভাবে ব্যবসার নামে যা হয়ে গেল তা হচ্ছে সুদকে ‘টেকনিক্যালি’ হালালকরণ।

এ উদাহরণে সিন্দাবাদের জাহাজ যদি ডুবে যায়, তাতে কেহেরমানের কিছু যায় আসে না, কারণ তিনি তার জিনিস বিক্রি করে দিয়েছেন, কেহেরমান ব্যবসার অংশীদার নন, তিনি কেবল জাহাজ বিক্রেতা। বিক্রেতা লাভ-লোকসানের কোনো অংশ নেন না, কেহেরমানও নেবেন না। আবার জাহাজ চালিয়ে সিন্দাবাদ যদি কোনো সুবিধা করতে না পারেন তাতেও কেহেরমানের কিছু যায় আসে না। প্রয়োজনে সিন্দাবাদকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও পাওনা টাকা দিতে হবে। সিন্দাবাদ যদি ঋণ নেয়ার পরে কোনো কারণে কিস্তি দিতে সাত বছরের জায়গায় আট বছর লাগিয়ে ফেলেন তাহলে বাড়তি জরিমানা দিতে হবে। গল্পের কেহেরমানের সঙ্গে বাস্তবের ইসলামী ব্যাংকগুলোর কোনো তফাত নেই।

লক্ষ করুন, সিন্দাবাদ কেহেরমানের কাছে না গিয়ে যদি সাধারণ মহাজনের কাছে যেত তাহলে কী হতো? মহাজন সিন্দাবাদকে ১ কোটি টাকা দিয়ে ৭ বছরে ২ কোটি টাকা ফেরত চাইত।

এবার সিন্দাবাদের দিক থেকে চিন্তা করি। কেউ লাভ-লোকসানের অংশ নিচ্ছেন না। ঋণ দিতে না পারলেও কেউ বিনা সুদে সময় বাড়িয়ে দিচ্ছেন না। টাকা আদায়ের ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে কম জুলুম করছেন না। সব মিলিয়ে মহাজন ও সিন্দাবাদের মাঝে বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক পার্থক্য নেই।

বরং প্রচলিত ব্যাংকে সুদের হার নির্দিষ্ট থাকায় লাভ কম দেখিয়ে সুদ কমানোর সুযোগ নেই। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোয় যেহেতু আগে সুদের হার বলা নেই, ফলে লাভ কম দেখিয়ে সুদ কমানোর সুযোগ আছে এবং গ্রাহকদের এ ব্যাপারে অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া হালাল হওয়ার শর্তে গ্রাহকরা লাভ কিছু কম নিয়েও সন্তুষ্ট থাকেন। এমন মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সবাই। তাই সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোয় সুদের হার সবচেয়ে কম কিন্তু গ্রাহকদের ডিপজিটের ঝোঁক সবচেয়ে বেশি!! সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংক সুদের চেয়েও লাভজনক এবং মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয়।

মোহাইমিন পাটোয়ারী: অর্থনীতিতে ডাবল মাস্টার্স, নরওয়ে স্কুল অব ইকোনমিক্স ও মানহাইম ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button