ব্যাংকার

ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচনে বেতন কর্তনের পক্ষে যারা তাদের জন্য

ব্যয় সঙ্কোচন একটি সহজ, সস্থা ও পুরনো পদ্ধতি, এমনকি এই শব্দটা আধুনিকায়ন করে পরিমিত ব্যয় বলা হয়। বাংলাদেশের হিংসাত্নক প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং মার্কেটে এই ব্যয় সঙ্কোচন নীতি অচল। আর বেতন কর্তন করে ব্যয় সঙ্কোচন হচ্ছে আত্নঘাতী, যদি ঘুরে দাঁড়াতে হয়।

ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচন
ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচন নিয়ে ইদানিং অনেক মন্তব্য ও লেখালেখি চোখে পরে। তার মধ্যে ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচনে ব্যংকের কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন নিয়েও মন্তব্য শুনা যাচ্ছে। সাথে সাথে উন্নত দেশের ব্যয় সঙ্কোচন নিয়ে কর্মিদের ছাটাই ও কর্মিদের বেতন কর্তন নিয়ে, আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে কর্মিদের বেতন কর্তন এর পক্ষে সাফাই করা হচ্ছে। অথচ উন্নত দেশের ব্যাংকিং ও আমাদের দেশে ব্যংকিং পদ্ধতির অনেক আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে।

কিন্তু উন্নত দেশে এরকম অনুন্নত তথ্য ব্যবস্থার অভাবে ঋন ঝুকির অনিশ্চয়তায় থাকতে হয় না। যার কারনে নন পারফরমিং লোন এর হার খুব কম বা নাই। তাছাড়া কাগজপত্র ভুয়া দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে ঋন নেয়ার নজির উন্নত দেশে একদম-ই নেই। যার ফলে ব্যাংকিং প্রতিষ্টান খুব সহজেই ব্যাবসায়িক অনিশ্চয়তায় থাকে না। তাই উন্নত দেশের সাথে ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচন নিয়ে তুলনা না দেয়াই ভালো। আমাদের দেশে লাভ যতই হোক কর্মিদের প্রণোদনা দেয়া কিছুটা নিদিষ্ট গন্ডির মধ্য সিমাবদ্ধ।

এবার বেতন কর্তন প্রসঙ্গে
বেতন কর্তন সবথেকে বেশি প্রভাব পরে শাখা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মিদের। কার বেতন কর্তন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, আসুন জেনে নেই। ব্যাংকিং বাইরে থেকে সাধারণ মনে হলেও এটা খুব টেকনিক্যাল কাজ। ব্যাংকের মূল কাজ হচ্ছে, উদ্বৃত্ত অংশের জমানো টাকা সংগ্রহ করে, নিরপদ পরিমাণ ব্যাংকে জমা করে (তারল্য রেখে), বাকি টাকা ঋন হিসেবে গ্রাহকদের ঋন দেয়া এবং সেই ঋনের টাকা রিকোভার করা। এই পুরো কাজটার মৌলিক কাজ ও তদারকি করেন শাখা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। বর্তমান কঠিন প্রতিযোগিতামূলক বাঁজারে কঠোর পরিশ্রম করে ব্যবসা সফল করে তারাই। করোনা পরবর্তি ধকল কাটাতে কর্মিদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে চায় সবাই। আর কর্মিদের সেরা পছন্দের কর্মিদের বেতন কর্তন করে সেরাটা কি ভাবে বের করা সম্ভব।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ব্যাংকের মাঠ বা ব্রাঞ্চ পর্যায়ের ভেরিফিকেশন
ব্যাংকের মাঠ বা ব্রাঞ্চ পর্যায়ের সকল ভেরিফিকেশন তো মাঠ বা ব্রাঞ্চ পর্যায়ের কর্মিরাই করে। আর বেতন কমিয়ে কর্মিদের থেকে সততা আর সচ্ছতা কি ভাবে আশা করা যায়! বেতন কমানো মাত্র পুরো মৌলিক কাজ ও তদারকিতেই ব্যঘাত ঘটবে। তাতে ব্যাংকের পুরো পোর্টফোলিওতেই আঘাত আসবে এমনকি পুরো পোর্টফোলিটাই রিস্কে ফেলে দেয়ার মত। অনেকেই মনে করেন, ব্যবসার দক্ষতা হচ্ছে ব্যবসা ও ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে আয় করা। আর আমাদের সহজ প্রচলন হচ্ছে ব্যয় কমিয়ে আয় দেখানো, সেটাও কর্মিদের প্রণোদনা, ইনসেন্টিভ, লভ্যাংশ, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কম দিয়ে লাভ দেখানো।

এবার ব্যাংকিং ব্যবসা নিয়ে কিছু বলা যায়
মাঝে মধ্যেই আমরা পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দেখি, এই ব্যাংকের সাফল্যর ১৫ বছর, ওই ব্যাংকের সাফল্যর ২০ বছর। এই সাফল্য মানে তো সবাই বুঝিঃ- ঠিক ওই ১৫ বা ২০ বছর সরাসরি লাভ করেছে ব্যাংকিং প্রতিষ্টান। যেহেতু এই সাফল্যর সুফল সরাসরি ভোগ করেছে মালিকপক্ষ। কিছুদিন, দুই-এক বছর লাভ না হলে বা কম লাভ হলেও প্রতিষ্টান চালিয়ে নেয়ার মানসিকতা থাকা উচিত। এই ব্যবসা নূন্যতম ৫০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। তাই এত বড় ব্যবসাতে উন্নত মানসিকতা ও ব্যবসার সাধারণ নৈতিকতা বহন করলে কর্মির বেতন কর্তন পর্যন্ত যেতে হয়না। আর এটাই ব্যাংক ব্যবসা। কখনোই কোন বেসরকারি ব্যাংক এখনও খুব ক্ষতির মুখ দেখেইনি, তাই এই ব্যবসা মানেই লাভ, এমন হিসেবটা থেকে বের হতে হবে।

ব্যাংকিং ব্যবসায় অপারেশনাল খরচ
ইদানিং ব্যাংকিং ব্যবসায় অপারেশনাল খরচ নিয়ে যাদের বেশি কথা বলতে শুনা যায়, তাদের অনেকেই দেখি নন-ব্যাংকার এমনকি ব্যাংকের বেসিক অপারেশন সম্পর্কে ধারনা কম। আমি এমন একজন পেয়েছিলাম যে খুব অভিজ্ঞ মতামত দিচ্ছিলেন, পরে আমি শুধু ক্রোস চেক এর প্রকারভেদ জিজ্ঞেস করেছিলাম- সে সদুত্তর দেয় নি। অবশ্য তাকে আমি বুঝাতে যাই নি অত্যবশকীয় খরচ, হিংসাত্নক ব্যাংকিং বাজার, গ্রাহকের চারিত্রিক পরিবর্তন, ব্যাংকের প্রতিযোগীতা ও কিছু কিছু চাকচিক্যতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

এবার আসি ব্যাংকারদের আয় বা বেতন বেশি নিয়ে
যে কোন সরকারি–বেসরকারি চাকরির বাজারের মত, ব্যাংকিং ব্যবসা ও পেশা একটা নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত পেশা। যেটা আবার বছরের পর বছর লাভজনক। তাই দেশ সেরা প্রথম শ্রেণীর মেধাবীরা এখানে মেধা বিক্রি করতে আসে। আর তারা তাদের মেধা, সততা আর পরিশ্রম দিয়ে গ্রাহক, মালিক পক্ষ্য তথা দেশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

তাই যারা ব্যাংকারদের আয় বা বেতন বেশি, বেতন বেশি মতামত দেয়া হচ্ছে, তাদের জানা দরকার, যে মেধাবী ব্যাংকার ধানমন্ডি বা মিরপুর থেকে গুলশান বা মতিঝিল গিয়ে সকাল ৮ (আঁট) টা থেকে রাত ৮ (আঁট) পর্যন্ত মেধা বিক্রি করে মাসে ১ লাখ টাকা বেতন পাচ্ছে, সে যদি ধানমন্ডি বা মিরপুর থেকে গুলশান বা মতিঝিল গিয়ে সকাল ৮ (আঁট) টা থেকে রাত ৮ (আঁট) টা পর্যন্ত পানের দোকান দিয়ে পান বিক্রি করে, তাতেও ১ লাখ টাকার বেশি আয় করতে পারবে-বলছিলেন একজন তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকে কর্মরত একজন ব্যাংকার। যারা একটা ধারাবাহিক আয় করে ব্যয় করে অভ্যাস্ত, তাদের বেতন কমালে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পরবে।

খরচ কমানোর অনেক দিক আছে
খরচ কমানোর অনেক দিক আছে যা কমাতে পারলেই পরিমিত ব্যয় এর পর্যায়ে যেতে পারে। ব্যাংকের দক্ষদের নিয়ে পরিচালন ব্যয় কমানোর ও অপটিমাম ক্যাপাসিটি মডেলিংসহ অনেকগুলো মডেল নিয়ে ব্যাংকিং বিষেশজ্ঞদের মতামত ইতিমধ্যেই আমরা পেয়েছি যা ব্যাপকভাবে সুপরিচিত। কিন্তু কোথাও ব্যাংকের কর্মিদের বেতন কর্তন নিয়ে কথা বলেনি। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেনঃ- কোনভাবেই কর্মিদের মূল বেতন এ হাত দেয়া উচিত না, এমনকি ব্যাংক অবসায়ন পর্যায়ে গেলেও না। সর্বোচ্চ কর্মিদের দেয়া লভ্যাংশ, বার্ষিক বেতন বাড়ানো ও প্রোমোশন এর ব্যাপারে ভাবা যেতে পারে।

গ্রাহকের চরিত্রগত পার্থক্য
ইদানীং গ্রাহকের চরিত্রগত ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করার মত। শুধু গ্রাহক চরিত্র নিয়ে কিছু আলোচনা করলেই বুঝা যাবে। আমাদের দেশে গ্রাহকের একটা বড় অংশের চরিত্রে না থাকে সন্তোষজনক লেনদেনের ইতিহাস, কমিটমেন্ট রাখার প্রবণতা, সঠিক তথ্য প্রকাশ করার প্রবণতা, ঋন নেয়ার সঠিক উদ্দেশ্য ও সঠিক জামানত। শুধু ব্যাংকিং লগ্নি নয়, যারা হায়ার পারচেজ এ গাড়ি ও হাউজ আপ্লায়েন্স বিক্রি করে তাদের রিকোভারি স্টেটমেন্ট দেখলেই বুঝা যায়। এমনকি ১০ টাকা ধার দেয়া মোবাইল কোম্পানির রিকোভারি স্টেটমেন্ট দেখলে আমাদের দেশে টাকা নিলে, তা ফেরত দেয়ার জাতীয় মানসিকতা ধারনা পাওয়া যায়।

করোনা পরবর্তী নতুন পৃথিবী
করোনা পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে নতুন নতুন সেক্টর ও সম্ভাবনা আসবে। সকল ব্যাংক তাদের কর্মিদের নিয়ে এক টিম হয়ে কাজ করে, কর্মিদের থেকে সময়ের সেরাটা নিয়ে সকল ব্যাংকিং ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াবে। অনেকে মনে করেন, আমাদের যে ব্যাংকগুলো সেক্টর ওয়াইজ ফোকাস ছিল যেমন, কিছু কিছু ব্যাংক এসএমই ফোকাস, কিছু কিছু ব্যাংক রিটেইল ফোকাস, কিছু কিছু ব্যাংক কর্পোরেট ফোকাস, ইসলামী বা ইসলামী ওইয়িন্ডো ফোকাস, কিছু কিছু ব্যাংক মিক্সড। তাই এই ব্যাংকগুলোকে সেক্টর ওয়াইজ আগাতে হবে, নইলে দক্ষতা ও পথ হারাতে পারে।

পরিমিত ব্যয়ের সাথে ইনভেস্টমেন্ট নজরদারি বাড়াতে হবে
পরিমিত ব্যয়ের সাথে সাথে বাছাইকৃত কর্মিদেরদের নিয়ে বড় বড় ইনভেস্টমেন্ট আছে এমন সব প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়োগের মত করে নজরদারি অনেক বাড়াতে হবে। ব্যাংকের আরএমদের কাজে লাগিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ব্যাংকের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে লগ্নি ফেরত আনতে সর্বোচ্চ মনোযোগ নিয়োগে থাকতে হবে। অনেকে এও মনে করেন যে, প্রত্যেক কর্মির পিছনে আয় ও ব্যয় হিসেব করে, কাজের পরিধি বের করে, কাজ অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে (সেটা দিগুণ হলেও ক্ষতি নেই)।

কর্মীদের কাজ বাড়িয়ে দেয়া
এমনকি কাজ বাড়িয়ে দেয়াটা হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার। নতুন নতুন সৃষ্টিশীল ও নিরাপদ লগ্নির পথ খুজে সজাগ থেকে ব্যবসা করতে হবে। লগ্নি ফেরত এনে, আয় বাড়িয়ে পরিমিত ব্যয় ঠিক রেখে ব্যবসা সফল হওয়াটাই হচ্ছে বর্তমান ম্যানেজমেন্ট এর চ্যালেঞ্জ। রিচার্ড ব্রানসন (ভার্জিন গ্রুপ) মতেঃ গ্রাহকরা প্রথমে আসে না, কর্মিরা প্রথমে আসে, আপনি যদি কর্মির যত্ন নেন, কর্মিরা আপনার গ্রাহকের যত্ন নিবে। তাই বেতন কর্তন নয়, মেরুদন্ড সম্পূর্ন সৃষ্টিশীল দক্ষ ম্যানেজমেন্টই পারবে এই করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঘুরে দাড়াতে।

সর্বোপরি, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আমাদের দেশে অর্থনীতিতে, আমাদের দেহে রক্তের প্রবাহের মতো, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ভালো থাকলে আমাদের অর্থনীতি ভালো থাকবে। আমরা আশাকরি ও দোয়া করি, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভালো থাকুন, কর্মি, গ্রাহক, অর্থনীতিতে তথা দেশ পুনরুগঠন এ গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করুক। সুস্থ হোক আমার দেশ, ভালো থাকুক আমার অর্থনীতি।

লেখকঃ সৈয়দ মহিউদ্দিন, ব্যাংকার (লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button