ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায় নৈতিকতা
ব্যাংক ব্যবসায়ে নৈতিকতা অন্তর্ভুক্ত করাই হলো নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় তথা এথিক্যাল ব্যাংকিং। এটি সামাজিক, নাগরিক, টেকসই ও বিকল্প ব্যাংক ব্যবসায় হিসেবেও পরিচিত। এ ধরনের ব্যাংক কার্যক্রমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও পরিবেশগত প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়।
নৈতিক ব্যাংকিংকে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ব্যাংক ব্যবসায় হিসেবে অভিহিত করা যায়। এর মূল বক্তব্যকে তিনটি ‘পি’ আদ্যাক্ষরযুক্ত শব্দ- people (মানুষ), planet (পৃথিবী) ও profit (মুনাফা) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। পরিবেশের ক্ষেত্রে টেকসই কার্যক্রম গ্রহণ করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখা এবং এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন করা নৈতিক ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য। অন্য দিকে উচ্চবিত্ত গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে ঋণসুবিধা সীমিত রাখা, সহায়ক জামানতবিহীন সাধারণ মানুষ এবং গরিবের জন্য ঋণের সুযোগ না রাখা, অতি মুনাফা অর্জনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংককে বিপদে ফেলা কিংবা ব্যক্তি, পরিবেশ, সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন প্রকল্পে ঋণ দেয়াকে ব্যাংক সেবার ক্ষেত্রে অনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচনা করা হয়।
বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটোত্তর বাজার পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা এবং বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় ও ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি একটা আকর্ষণীয় গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়। সম্প্রতি ড. তরিকুল্লাহ খান ও আমিরা বিনতে রফিক নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় ও ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায়ের তুলনা করে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেখানে তারা নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায়ের মডেল হিসেবে নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক ট্রিওডোস ব্যাংক (Triodos Bank) এবং ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায়ের আদর্শ মডেল হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে তুলনা করেন। তারা ব্যাংক দুটোর ব্যালান্সশিট ডিসক্লোজারের উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে তাদের ব্যবসায়িক নীতি ও অনুশীলনের মধ্যে মিল-অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তাদের বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ক্ষুদ্র্র অর্থায়ন, লিঙ্গ ভারসাম্য, এসএমই অর্থায়ন ও সবুজ ব্যাংক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড অনেক এগিয়ে রয়েছে।
ট্রিওডোস ব্যাংক নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক একটি ব্যাংক। বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও স্পেনে এর শাখা রয়েছে। এটি নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায়ের পথিকৃতের দাবিদার। এ ব্যাংক এমন সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে, যেগুলো সাংস্কৃতিক মূল্য যোগ করে এবং মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের উপকারে আসে। এসব বিনিয়োগ খাতের মধ্যে রয়েছে সৌরশক্তি, জৈবচাষ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। ‘ট্রিওডোস’ নামটি গ্রিক শব্দ ‘ট্রাই-হোডোস’ (tri hodos) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘তিনটি পথপদ্ধতি’ (মানুষ, পৃথিবী ও মুনাফা)। এ ব্যাংকে প্রচলিত সঞ্চয়ী হিসাবের পাশাপাশি নৈতিক তহবিল এথিক্যাল ফান্ড ও ভেনচার ক্যাপিটাল হিসাবও খোলা যায়। ট্রিওডোস হলো যুক্তরাজ্যের একমাত্র ব্যাংক, যা ব্যাংকের সব ঋণগ্রহীতার বার্ষিক তালিকা প্রকাশ করে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ট্রিওডোস একটি নৈতিকতানির্ভর ব্যাংক, যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে না; বরং নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে সতর্কতার সাথে এমন ক্ষেত্রে ঋণ দেয়, যা টেকসই ও উন্নত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর, যা একটি উন্নত, কল্যাণকর ও টেকসই সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারে।
অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড শুধু আর্থিক সেবাই দেয় না; বরং দেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে। এই ব্যাংক কল্যাণমুখী ব্যাংক ব্যবসায়ের ধারা প্রবর্তন করার পাশাপাশি প্রান্তিক জনগণকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কর্মসূচি চালু করেছে। এ উদ্দেশ্যে ইসলামি ব্যাংকের কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-স্বল্পোন্নত অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে সর্বোৎকৃষ্ট সেবা দেয়া, সব কর্মকাণ্ডে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সিএসআর নিশ্চিত করা, গ্রিন ব্যাংকিং ও পরিবেশগত ভারসাম্যের উৎকর্ষ সাধন, চাহিদাভিত্তিক খুচরা, এসএমই ও ক্ষুদ্র অর্থায়ন সম্প্রসারণ, ব্যাংকের কর্মীদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং শরিয়াহ ও বিধিবদ্ধ নিয়মনীতির পরিপালন নিশ্চিত করা।
ইসলামি ব্যাংক ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে কাজ করে। এ ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ গ্রাহক এবং শেয়ার হোল্ডারদের একটি বড় অংশ অমুসলিম এবং পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের গ্রাহকদের বেশির ভাগই নারী ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অমুসলিম।
আইবিবিএল দেশের আর্থসামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সদাসচেষ্ট। ব্যাংকটি করপোরেট কর, আবগারি শুল্ক, মূসক প্রভৃতি সময়মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে যাচ্ছে এবং ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ ও করপোরেট খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে কয়েক বছর ধরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সূচনালগ্ন থেকেই পরিবেশবান্ধব সবুজ ব্যাংক ব্যবসায় করে আসছে। এ ব্যাংক তার অন্তর্নিহিত মূলনীতি হিসেবে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ‘পিপল বা মানুষ, প্লানেট বা পৃথিবী ও প্রফিট বা মুনাফা-নীতির ভিত্তিতে এ ব্যাংক করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার কর্মসূচি পালন করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে এ ব্যাংক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, খেলাধুলা ও পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকের কার্যক্রম আরো বাড়ানোর প্রত্যাশায় ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করতে ইসলামি ব্যাংক পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচি চালু করেছে, যা দেশের প্রান্তিকপর্যায়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শরিয়াহভিত্তিক এবং দেশের ব্যাংক খাতের মার্কেট লিডার হিসেবে আইবিবিএল একটি সুদক্ষ ও প্রগতিশীল মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। মাকাসিদে শরিয়াহ বা শরিয়াহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের আলোকে যুগোপযোগী আধুনিক ব্যাংকিং পণ্য ও সেবার উদ্ভাবন এবং ইসলামি ব্যাংকিং প্রজ্ঞার উৎকর্ষ সাধনে এ ব্যাংক সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংক সর্বদা শুদ্ধতা, নৈতিকতা ও শরিয়াহ পরিপালনে উন্নত মান বজায় রাখতে এবং স্বচ্ছতা, করপোরেট সুশাসন অর্জনে বদ্ধপরিকর। গ্রাহক, কর্মী ও নিয়ন্ত্রক বা স্টেক হোল্ডারদের স্বার্থ-সংরক্ষণ ও দেশের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশে এটি অগ্রসরমান।
ইসলামি ব্যাংকের করপোরেট কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- ব্যাংকের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি। এ কমিটির প্রতিনিধি ব্যাংকের বিভিন্ন সভা যেমন- পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি, বার্ষিক ব্যবসায় উন্নয়ন সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগদান করে এবং শরিয়াহসংক্রান্ত পর্যালোচনা ও অভিমত দিয়ে থাকে। ব্যাংকের বিনিয়োগসহ সব কার্যক্রমে শরিয়াহ পরিপালন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন এ কমিটিই চূড়ান্ত করে থাকে।
পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায়ের সাথে ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায়ের তুলনা করা হলেও ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায় প্রচলিত নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় থেকে আরো বেশি নৈতিক। কেননা, প্রচলিত নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় সুদকে অনৈতিক গণ্য করে তা পরিহার করা হয় না। অথচ ইসলাম, ইহুদি, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ, হিন্দু প্রভৃতি ধর্মে সুদকে অনৈতিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি সুদ যে মানবিক বিষয় নয়; বরং শোষণের হাতিয়ার তা বিভিন্ন দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও মনীষীর বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, অ্যাডাম স্মিথ, কার্ল মার্কস ও কিনসের মতো বিখ্যাত পণ্ডিতেরা গণসুদকে সমাজ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করেছেন।
প্রচলিত নৈতিক ব্যাংক ব্যবসায় ঋণগ্রহীতা ও দাতার পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে সুদ নির্ধারিত হয়। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকে তা করা হয় না। কাজেই ইসলামি ব্যাংকিংয়ে প্রচলিত নৈতিক ব্যাংক ব্যবস্থায় অনুশীলিত টাকার কৃত্রিম লেনদেনের পরিবর্তে মানুষের চিরায়ত সহজ ও স্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের সহজাত প্রক্রিয়া তথা পণ্য কেনাবেচা, ইজারা বা ভাড়া ও অংশীদারি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায় কেবল সেসব প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করা হয় যেগুলো নৈতিক আর্থিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। যেসব প্রতিষ্ঠান অ্যালকোহল, তামাক, জুয়া ও পর্নোগ্রাফির মতো পণ্য উৎপাদন করে ইসলামি ব্যাংক সেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে না।
ইসলামি ব্যাংকিং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নীতি ও কর্মধারায় কল্যাণধর্মী ও বণ্টনমূলক নীতি অনুসরণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। এ ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বার্থের ওপর সামাজিক ও সামষ্টিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা গুটিকয়েক মানুষের লোভের চাহিদা পূরণে কাজ না করে সমাজের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণকে অগ্রাধিকার দেয়।
ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায় একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, আমানতকারীদের আমানতের সর্বোত্তম ব্যবহার ও ঝুঁকি বিশ্লেষণপূর্বক বিনিয়োগ এবং এর মাধ্যমে অর্জিত আয়ের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ আমানতকারীদের লভ্যাংশ আকারে দেয়, যা প্রতি বছরই লাভের অঙ্কের সাথে পরিবর্তিত হয়। তথাপি এটি শরিয়াহ পরিপালন, ইসলামি নীতি ও মূল্যবোধ এবং সামাজিক ও পরিবেশগত কল্যাণকে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সমাজের প্রতি ইতিবাচক ও নৈতিক অবদান রাখছে।
কার্টেসিঃ মুহাম্মাদ শামসুল হুদা ও রহমাতুল্লাহ খন্দকার