ইসলামী ব্যাংকিং

শরিয়াহ ব্যবস্থায় ঝুঁকছে ব্যাংকগুলাে

ব্যবসা, বিনিয়ােগ, আমানত, রেমিট্যান্স, মুনাফা ও সম্পদে প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং। বর্তমানে ব্যাংক খাতের আমানত ও ঋণের হিসাবে এক-চতুর্থাংশই ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলাের দখলে রয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংকের চেয়ে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি ক্রমেই আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের। তাই প্রচলিত ব্যাংক থেকে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিকে রূপান্তরিত হয়েছে আরও দু’টি ব্যাংক। অপেক্ষায় রয়েছে আরও পাঁচ ব্যাংক।

সুদ ব্যবস্থার চেয়ে শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ে মুনাফা বেশি ও ঝুঁকি কম বলে সবাই আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ইসলামী শরিয়াহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে ইসলাম প্রিয়। এজন্য দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তারা ইসলামী ব্যাংকিং চান। শুরুতে সমস্যা হলেও ইসলামের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কারণে এক পর্যায়ে সবাই পরিপূর্ণভাবে শরিয়াহ পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।

শুধু এ দুটি সূচকই নয়, ব্যাংক খাতের মানদণ্ডের সব সূচকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অবস্থান অনেক সুদৃঢ় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ খাতের ব্যাংকগুলাের কোনােটির মূলধন ঘাটতিতে নেই। শুধু অতীত বােঝা টেনে বেড়ানাের কারণে একটি ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় রয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাংকটিও বর্তমানে পরিচালন মুনাফায় রয়েছে। অতীত বােঝা বাদ দিয়ে এটিও লাভজনক খাতে চলে এসেছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি সুদভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং করার অনুমােদন পেয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক। এখন থেকে এ দুটি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং চালু করবে। এর মধ্যে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নতুন নামে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করবে। বর্তমানে আটটি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন দুটি নিয়ে সংখ্যা দশে উন্নীত হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে আইএফআইসি, যমুনা ব্যাংক, এনসিসি ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। এসব ব্যাংকও পূর্ণাঙ্গ রূপে ইসলামী ব্যাংকিং করতে চায়। কিন্তু কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও অনুমােদন দেয়নি।

সূত্র মতে, স্টান্ডার্ড ব্যাংকই ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তর হতে চার বছরের মতাে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী বা শরিয়াহ ব্যাংকিং শুরু হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের হাত ধরে। ১৯৮৩ সাল থেকে দেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে এটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে অনেক ব্যাংকই ইসলামী ব্যাংকিং চালু করে। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত সােনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডাে রয়েছে।

বর্তমানে আটটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে। এর পূর্ব পর্যন্ত প্রচলিত ব্যাংকিং বিধি ও ব্যাংক কোম্পানি আইন মেনে চলেই ব্যাংকিং পরিচালনা করতাে। বর্তমানেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলাে শরিয়াহ বাের্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যদিও এই শরিয়াহ বাের্ডের সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ মানতে ব্যাংকগুলাের কোনাে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যাংকগুলাে নিজ প্রয়ােজনেই শরিয়াহ মেনে চলে। বর্তমানে ইসলামী ধারার কোনাে ব্যাংক হারাম খাত হিসেবে বিবেচিত; যেমন মদ, বিয়ার ও তামাক খাতে বিনিয়ােগ করে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আটটি ব্যাংক। এগুলাে হচ্ছে- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সােস্যাল ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।

এছাড়া ৯টি প্রচলিত (কনভেনশনাল) ব্যাংকের ১৯টির ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও আটটির ৬১টি ইসলামিক উইন্ডাে রয়েছে। এর বাইরে দেশের সব ব্যাংক ও শাখা প্রচলিত সুদি ব্যবস্থার ধারায় প্রচলিত রয়েছে। এসব মিলিয়ে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের শাখা হচ্ছে এক হাজার ৩০১টি। এর মধ্যে শহরেই রয়েছে ৭৭১টি। বর্তমানে ব্যাংকগুলাের মােট শাখা হচ্ছে দশ হাজারের বেশি। এ হিসাবে অর্থাৎ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলাের যেখানে চার ভাগের এক ভাগ দখলে রয়েছে, সেখানে অন্য সব ব্যাংক মিলে তিন ভাগ।

প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে সুদভিত্তিক হওয়ার পেছনে সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সুদ নির্ধারিত। ব্যাংক কম ব্যবসা করলেও নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয় আমানতকারীদের। আবার বেশি ব্যবসা করলেও একই সুদহার পেয়ে থাকেন আমানতকারীরা। এতে কোনাে কারণে ব্যাংকের ব্যবসা কোনাে বছরে খারাপ হলেও একই সুদ দিতে হয় আমানতকারীদের। এতে ব্যাংকের আর্থিক মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে উচ্চ সুদে অর্থ ধার করে। এভাবে পুঞ্জীভূত সুদ বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে ব্যাংকটি দুর্বল হয়ে পড়ে।

কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমানতকারীদের সঙ্গে মুনাফা বণ্টন করা হয়। বছর শেষে মুনাফার ওপর ভর করেই আমানতকারীরা মুনাফার অংশ পেয়ে থাকেন। এজন্য ব্যাংকাররা সচেষ্ট থাকেন, যাতে বিনিয়ােগ সঠিক জায়গায় হয়। এতে ব্যাংক ও আমানতকারীরা তুলনামূলক নিরাপদ জায়গায় থাকেন। আবার ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত জীবনে শরিয়াহ মেনে চলেন। ঋণ বিতরণেও সে দিকটি বিবেচনায় নেন। এতে দেখা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে শরিয়াহ পরিপালনকারী তুলনামূলক অনেক কম খেলাপি হন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার ১১০ কোটি। যেখানে দেশের ব্যাংকগুলােয় মােট আমানতের পরিমাণ ১০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ হিসাবে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ে আমানত মােট আমানতের প্রায় ২৪ ভাগ। শুধু শাখায় নয়, ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বিনিয়ােগের পরিমাণও বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতের মােট ঋণের স্থিতি ছিল ১০ লাখ ১৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের বিনিয়ােগ দুই লাখ ৫০ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা মােট বিনিয়ােগের প্রায় ২৫ শতাংশ।

রেমিট্যান্স আহরণেও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলাে বড় ভূমিকা রাখছে। এ ধারার ব্যাংকগুলাের মাধ্যমে ৩১ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে। কৃষি ঋণের ক্ষেত্রেও ভালাে ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলাে সুদভিত্তিক ব্যবস্থা আর্থিক খাতে বড় সংকট তৈরি করে। সারা দুনিয়ায় এই চিত্র দেখা গেছে। এমনকি অমুসলিম দেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং।

এর পেছনে রয়েছে ইসলামের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য। ইসলামী ব্যাংক ও ব্যাংকারদের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কারণেই এতে আকৃষ্ট হচ্ছে সবাই। বর্তমানে দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলাে যতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারছে না, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশ। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলাের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকিং বাড়াচ্ছে পূবালী ব্যাংক। এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন সম্প্রতি এম আযিযুল ইসলাম। তিনি ইসলামী ব্যাংকার হিসেবে একটি পরিচিত নাম।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তাকে আনাই হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং শক্তিশালী করতে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে উদ্যোক্তাদের আগ্রহের কারণ হিসেবে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৯০ ভাগ ব্যাংক গ্রাহক মুসলমান। মুসলিম দেশগুলােয় ইসলামিক ব্যাংকের ব্যাপক চাহিদা আছে। কুরআনের নিয়ম মেনে যারা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও লেনদেন করতে চান, তারা সাধারণত ইসলামিক ব্যাংকগুলােয় লেনদেন করেন। এ কারণেই দেশের ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের পরিধি দিন দিন বাড়ছে।

বাস্তবভিত্তিক ব্যাংকিং এবং যথাযথ নিয়ম মেনে ঝুঁকি মােকাবিলা করার কারণে টেকসই ব্যাংকিং হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বলে মনে করছেন ইসলামী ধারার ব্যাংক পরিচালনাকারীরা। তারা বলছেন, এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী ব্যাংকগুলাের সাফল্য দেখে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।

এ খাতের বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এজন্য ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা প্রয়ােজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমাও দেয়া হয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলাের পক্ষ থেকে, যা এখন হিমাগারে পড়ে রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক লাভ-লােকসানের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে। এটি ইসলামের সৌন্দর্য। কিন্তু ভুল ব্যক্তির হাতে এটি পরিচালিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমানতকারীরা।

এজন্য ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রয়ােজনেই এখন একটি পৃথক আইন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলে ইসলামী ব্যাংক খাতের; বিশেষ করে আমানতকারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। অসৎ উদ্দেশ্যে এ খাতে আসার প্রবণতা বন্ধ হবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

লেখকঃ হাসনাইন জাবেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button