ব্যাংক হিসাব

ব্যাংক একাউন্ট খোলার শরয়ী বিধান

বর্তমানে শিল্প বিপ্লবের এ যুগে ব্যাংক হিসাব খোলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিসাব খোলা জরুরী। এছাড়াও ব্যাংক হিসাব খোলার দ্বারা সম্পদ হেফাজত, টাকা-পয়সা হারানোর ঝুঁকি এড়ানো, সহজে বিল ও পেমেন্ট (payment) আদান-প্রদানসহ আরো বিভিন্ন ধরনের সুবিধা লাভ করা যায়। আর ব্যাংকের অনলাইন (online) সার্ভিস তো বর্তমানে সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বিশেষভাবে এটিএম বুথ (ATM booth) সার্ভিস মানুষের জীবনকে অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। যার কারণে দিন দিন ব্যাংকের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর প্রয়োজনও যথেষ্ট পরিমাণে অনুভূত হচ্ছে। তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাংক এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ।

এখন প্রশ্ন হলো, ব্যাংক হিসাব খোলা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি না? এর জবাব জানতে হলে আমাদের প্রথমত ব্যাংক হিসাবের পরিচয় এবং তার লেন-দেনের ধরণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। তবেই এর হুকুম বোঝা সহজ হবে।

ব্যাংকে সাধারণত চার ধরনের হিসাব খোলা যায়-
১. কারেন্ট বা চলতি হিসাব (Current Account)
২. সেভিংস বা সঞ্চয়ী হিসাব (Savings Account)
৩. ফিক্সড বা স্থায়ী ডিপোজিট (Fixed Deposit) ও
৪. লকার সেবা (Locker Service)।

১. কারেন্ট বা চলতি হিসাব (Current Account)
এই হিসাবের ধরণ হলো, একাউন্ট হোল্ডার (হিসাবধারী) যে কোনো সময় যে কোনো পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারে। আর ব্যাংকও ঐ পরিমাণ টাকা তাকে দিতে বাধ্য। এর জন্য একাউন্ট হোল্ডারকে আগাম কোনো নোটিশ ব্যাংককে দিতে হয় না। বরং একাউন্ট হোল্ডার তার ইচ্ছামত প্রয়োজন পরিমাণ টাকা যে কোনো সময় উত্তোলন করতে পারে। কারেন্ট একাউন্টে ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহককে কোনো সুদ বা লাভ দেওয়া হয় না। বরং ব্যাংক একাউন্ট হোল্ডার থেকে তার অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট হারে বার্ষিক সার্ভিস চার্জ (Service Charge) নিয়ে থাকে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এই একাউন্টের টাকাগুলো আলাদা রাখা হয় না। বরং অন্যান্য একাউন্টের টাকার সাথে মিশিয়ে রাখা হয়। আর ব্যাংকের এ স্বাধীনতা থাকে যে, সে উক্ত টাকাকে তার প্রয়োজন মাফিক খরচ করতে পারে। তবে একাউন্ট হোল্ডার চাওয়া মাত্র তাকে ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতি হলো, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংক ব্যাংক মজুদ রেখে দেয়। যাতে কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদের সার্বক্ষণিক চাহিদা মেটাতে পারে।

২. সেভিংস বা সঞ্চয়ী হিসাব (Savings Account)
এই একাউন্ট হতে টাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। গ্রাহক যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারে না। বরং তার জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে। যেমন একদিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা উত্তোলন করা যায় না, মোটা অংকের টাকা উত্তোলন করতে হলে ব্যাংককে আগাম নোটিশ প্রদান করতে হয়, একসাথে সব টাকা উত্তোলন করা যায় না ইত্যাদি। তবে এই একাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। অর্থাৎ এতদিনের পূর্বে টাকা উত্তোলন করা যাবে না এমন কোনো শর্তারোপ করা হয় না। বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংক যে কোনো সময় উত্তোলন করা যায়। বর্তমানে তো বেসরকারী ব্যাংকে এব্যাপারে যথেষ্ট শিথিলতা প্রত্যক্ষ করা যায়। বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে যেমনিভাবে আগাম নোটিশ ব্যতীত মোটা অংক উত্তোলন করা যায় তেমনিভাবে পুরো টাকাও একসাথে উত্তোলন করা যায়।

সেভিংস একাউন্টের আওতায় আরো বেশ কিছু একাউন্ট রয়েছে। যেমন স্যালারি একাউন্ট, পেনশন একাউন্ট ইত্যাদি। মূলত ঐগুলো সেভিংস একাউন্টের আওতায় পড়ে। এই একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক তাদের সঞ্চিত অর্থের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা বা সুদ দিয়ে থাকে।

৩. ফিক্সড বা স্থায়ী ডিপোজিট (Fixed Deposit)
এই একাউন্টে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য টাকা জমা রাখা হয়। ঐ সময়ের পূর্বে গ্রাহক টাকা উত্তোলন করতে পারে না। এই একাউন্টেও ব্যাংক জমাকৃত অর্থের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা বা সুদ দেয়। তবে এই সুদ সেভিংস একাউন্টের সুদের চেয়ে সাধারণত বেশি হয়ে থাকে।

৪. লকার সেবা (Locker Service)
মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র, গয়না, মোটা অংকের টাকা ও দামী জিনিসপত্র নিরাপদে রাখার জন্য ব্যাংকে লকার ভাড়া পাওয়া যায়। ব্যাংক তার গ্রাহকদের নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে এই লকার সুবিধা প্রদান করে থাকে। মানুষ আস্থার সাথে নিজেদের মূল্যবান জিনিস উক্ত লকারে জমা রাখে এবং প্রয়োজনের সময় তুলে নেয়। ব্যাংক তা হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। লকারে জমাকৃত জিনিস হারানো গেলে বা নষ্ট হলে ব্যাংক তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কর্মঘন্টাগুলোতে ব্যাংকের উক্ত লকার সুবিধা পাওয়া যায়।

যে ব্যাংকে লকার খুলতে ইচ্ছুক সেই ব্যাংকে নিজের একটি একক বা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। একক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে নমিনির নাম দিতে হয়। আর জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে নমিনির প্রয়োজন হয় না। কারণ তাতে একজনের অবর্তমানে অন্যজন অংশীদারিত্ব পায়। উক্ত অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে হওয়া আবশ্যক। তার তিন কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এবং ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিতে হয়।

ব্যাংকে ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থান
ব্যাংক একাউন্টের পদ্ধতি ও নিয়মাবলি সম্পর্কে মানুষজন কমবেশি অবগত থাকলেও এগুলোর শরয়ী বিধান অনেকেরই জানা নেই। তাই আমাদের ব্যাংক একাউন্টের শরয়ী হুকুম ভালোভাবে জেনে নেয়া দরকার। আর এর শরয়ী বিধান জানতে হলে প্রথমে ব্যাংকে ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থান জানা প্রয়োজন। অর্থাৎ আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, গ্রাহক ব্যাংকে যে টাকা গচ্ছিত রাখছে তা কিসের ভিত্তিতে? আমানতের ভিত্তিতে নাকি ঋণের ভিত্তিতে? নাকি এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো সূরত রয়েছে?

সুদী ব্যাংকের তিনও প্রকার একাউন্টেই গ্রাহক এই নিশ্চয়তা লাভ করে যে, সে জমাকৃত টাকা সর্বাবস্থায় ফেরত পাবে। যদি উক্ত টাকা ব্যাংক থেকে হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তবে সর্বাবস্থায় একাউন্ট হোল্ডারকে তার টাকা ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য থাকে। গ্রাহকের বরাবর ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা দেয়া থাকে। যদি ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা না থাকে অথবা গ্রাহক জানতে পারে যে, তার টাকা খোয়া যাওয়ার আশংকা রয়েছে তবে জনসাধারণ ব্যাংকে টাকা রাখা বন্ধ করে দিবে।

মোটকথা, ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পক্ষের কাছে এটা স্বতসিদ্ধ যে, গ্রাহক সর্বাবস্থায় তার গচ্ছিত টাকা ফেরত পাবে। আর একেই ঋণ বলে। মানুষ এর নাম যাই দিক না কেন তা ঋণ হিসেবেই ধর্তব্য হবে। কেননা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নামের কোনো প্রভাব থাকে না। বরং তার ব্যবহারিক দিক ও অর্থই ধর্তব্য হয়। তাছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার দ্বারা গ্রাহকের উদ্দেশ্য থাকে মূল টাকা ফেরত পাবার নিশ্চয়তার সাথে সাথে অতিরিক্ত মুনাফা (সুদ) অর্জন।

যাইহোক, সুদী ব্যাংকের যে কোনো প্রকার একাউন্টে টাকা ডিপোজিট করার ক্ষেত্রে একাউন্ট হোল্ডার ও ব্যাংকের মাঝে যে চুক্তি সম্পন্ন হয় তা শরীয়তের পরিভাষায় ঋণচুক্তি বলেই গণ্য হয়। একাউন্ট হোল্ডার হলো ঋণদাতা, আর ব্যাংক হলো ঋণগ্রহীতা।

হিসাব খোলার শরয়ী বিধান
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা সুদী ব্যাংকের একাউন্টের প্রকারভেদ এবং উক্ত একাউন্টসমূহে ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারলাম। নিম্নে একাউন্ট খোলা এবং তাতে টাকা রাখার শরয়ী হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১। কারেন্ট একাউন্ট (Current Account) খোলা এবং তাতে টাকা রাখার শরয়ী হুকুম
সুদী ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট খোলা শর্তসাপেক্ষে জায়েয। যদি একাউন্ট হোল্ডারের সুদী কারবারে সহযোগিতার নিয়ত না থাকে; বরং শুধুমাত্র টাকা হেফাজত বা অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা লাভ করা উদ্দেশ্য হয় তবে তার জন্য এ একাউন্ট খোলা বৈধ। অবশ্য নির্ভরযোগ্য কোনো ইসলামী ব্যাংক থাকলে সেক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট খোলা মাকরূহ। আর যদি সুদী কারাবারে সহযোগিতার নিয়ত থাকে তবে তার জন্য কারেন্ট একাউন্ট খোলাও হারাম। [জাওয়াহিরুল ফিকহ ২/৪৫৩; ফিকহুল বুয়ূ ২/১০৬৩; ফিকহী মাকালাত ৩/৩৯]

এখানে একটি আপত্তি আসে যে, এই একাউন্টের টাকায় যদিও সুদ আসে না তথাপি একাউন্ট হোল্ডারের তো জানা আছে যে, ব্যাংক তার টাকা সুদী কারবারে ব্যবহার করবে। তাহলে জেনে শুনে ব্যাংককে সুদী কারবারে সহযোগিতা করা কিভাবে জায়েয হতে পারে? শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাক্বী উছমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম উক্ত আপত্তির কয়েকটি জবাব দিয়েছেন-

ক. ব্যাংক কারেন্ট একাউন্টের সকল টাকা নিজের ব্যবহারে আনে না। বরং তাতে সঞ্চিত অর্থের একটা বড় অংশ মজুদ রেখে দেয়। যাতে করে কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদের সার্বক্ষণিক টাকা উত্তোলনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। কাজেই কোনো একাউন্ট হোল্ডার একথা সুনিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, তার টাকাই সুদী কারাবারে ব্যবহৃত হচ্ছে। বরং উভয়টির সম্ভাবনা রয়েছে।

খ. সুদী ব্যাংকের টাকা ইনভেস্ট বা অর্থায়ন করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যার সবগুলো হারাম নয়। বরং অনেক জায়েয ক্ষেত্রও রয়েছে। কাজেই কোনো হিসাবধারী একথা নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, তার জমাকৃত অর্থ কোনো নাজায়েয কারবারে খাটানো হয়েছে।

গ. সুদবিহীন ঋণ বা কর্জ প্রদান একটি শরীয়তসম্মত লেনদেন। আর মুদ্রার হুকুম হলো তা সহীহ লেনদেনসমূহে নির্দিষ্ট করার দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না। তাছাড়া গ্রাহক যখন ব্যাংককে ঋণ দেয় তখন উক্ত টাকা ঐ ব্যক্তির মালিকানা থেকে বের হয়ে ব্যাংকের মালিকানায় প্রবেশ করে। অতঃপর ব্যাংক ঐ টাকার দ্বারা যে কারবার করে তা উক্ত ব্যক্তির কারবার হিসেবে ধর্তব্য হবে না। বরং ব্যাংকের নিজস্ব কারবার হিসেবে পরিগণিত হবে। কাজেই ব্যাংকের কারবারকে উক্ত ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা ঠিক হবে না।

ঘ. কাউকে গোনাহের কাজে সাহায্য করা বা তার কারণ হওয়া যদিও হারাম তবে ওলামায়ে কেরাম এর কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। কেননা যদি সর্বপ্রকার কারণ নিষিদ্ধ করা হয় তবে মানুষের জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। যেমন কেউ চাউল কিনতে এলে দোকানদার একথা চিন্তা করল যে, সে এই চাউলের ভাত খেয়ে চুরি করতে পারে। এমনটি হলে তো তার পক্ষে চাউল বিক্রি করা সম্ভব হবে না। বরং দুনিয়ার কোনো কাজই জায়েয থাকবে না। কাজেই গোনাহের কারণকে নিকটবর্তী ও দূরবর্তীতে বিভক্ত করতে হবে। আর সুদী কারবারে সহযোগিতার নিয়ত ব্যতীত কারেন্ট একাউন্টে টাকা রাখা সরাসরি সুদী কারবারে সহযোগিতার মতো নয়। বিশেষ করে যখন পূর্বে উল্লেখিত সম্ভাবনাগুলো রয়েছে। [ফিকহুল বুয়ূ ২/১০৬১-১০৬৩; ফিকহী মাকালাত ৩/৩২-৩৮]

সারকথা, সুদী কারবারে সহযোগিতার নিয়ত ব্যতীত প্রয়োজনবশত সুদী ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট খোলা ও তাতে টাকা রাখা জায়েয। প্রয়োজন না হলে মাকরূহে তানযীহী। আর সুদী কারবারে সহযোগিতার নিয়ত থাকলে কারেন্ট একাউন্ট খোলা ও তাতে টাকা রাখা হারাম।

উল্লেখ্য, কারেন্ট একাউন্টেও ইদানিং সামান্য পরিমাণ সুদের মিশ্রণ দেওয়া হয়। এ ধরনের কারেন্ট একাউন্টকে SND কারেন্ট একাউন্ট বলে। এমন কারেন্ট একাউন্টও খোলা যাবে না। কেবল সাধারণ কারেন্ট একাউন্ট, যাতে কোনো প্রকার সুদ দেয়া হয় না তা-ই খোলা যাবে।

২। সেভিংস একাউন্ট ও ফিক্সড ডিপোজিট এর শরয়ী হুকুম
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুদী ব্যাংকের সেভিংস একাউন্ট ও ফিক্সড ডিপোজিটে গ্রাহক কর্তৃক জমাকৃত অর্থ মূলত ঋণ বা কর্জ। এ দুই একাউন্টের নিয়মাবলিতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও উভয় একাউন্ট হোল্ডারগণ কমবেশি সুদ পেয়ে থাকে। কাজেই একাউন্ট হোল্ডার তার সঞ্চয়কৃত অর্থের চেয়ে যা-ই বেশি নিবে তা স্পষ্ট সুদ হবে, যা জায়েয হবার কোনো সুরত নেই। তাই কোনো মুসলমানের জন্য কোনোভাবেই সুদী ব্যাংকে এই দুই একাউন্ট খোলা এবং তাতে অর্থ জমা রাখা জায়েয হবে না। [ফিকহুল বুয়ূ ২/১০৬৩]

আর উক্ত দুই প্রকার একাউন্ট হতে প্রাপ্ত সুদ গ্রহণ করা যেমন হারাম তেমনিভাবে একাউন্ট খোলাও হারাম। কেননা একাউন্ট খোলার অর্থই হলো, সে সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। আর সুদ গ্রহণ না করলেও সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া ভিন্ন একটি গুনাহ। কিন্তু অনেকে মনে করে, সুদী ব্যাংকে সেভিংস একাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট করে প্রাপ্ত সুদের টাকা নিজে ব্যবহার না করে সদকা করে দিবে। আর এর দ্বারাই সে সুদের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে এবং গরীবেরও কিছু উপকার হবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এভাবে সুদের অর্থ সদকা করার দ্বারা উক্ত সুদী একাউন্ট করা বৈধ হয়ে যাবে না। এটা মূলত পরবর্তীতে তাওবা করার নিয়তে গুনাহ করার মত বা একজনের উপর জুলুম করে অন্য কারো উপর অনুগ্রহ করার মত। অথচ উভয়টি জঘন্যতম গুনাহ। চোর অন্যের সম্পদ চুরি করে কোনো নেক কাজে ব্যয় করলে তো সে তার কৃত চুরির গোনাহ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে না।

হাদীস শরীফে সুদদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের উপর লানত এসেছে। ইরশাদ হয়েছে-
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ
অর্থাৎ ‘সুদ যে খায় এবং দেয় তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লানত দিয়েছেন।’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪১৭৬]

উক্ত হাদীসে এটা বলা হয়নি যে, ইচ্ছাকৃত সুদ নিয়ে সদকা করে দিলে সুদগ্রহীতা তা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। বিশেষ করে সুদের মত একটি ভয়াবহ গোনাহ যার ভয়াবহতা আল্লাহ্‌ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ۚ وَ اِنۡ تُبۡتُمۡ فَلَکُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِکُمۡ ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
অর্থাৎ সুদের ভয়াবহতা জানার পরেও যদি তোমরা তা ছেড়ে না দাও তবে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হও।’ [সূরা বাকারাহ: ২৭৯]

কত বড় মারাত্মক কথা যে, আল্লাহ তাআলা খালেক হয়ে সামান্য মাখলূকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। যাবতীয় হারাম ও কবীরা গোনাহের মধ্যে মাত্র এই এক সুদের বিরুদ্ধেই আল্লাহ্‌ তাআলা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এখান থেকে সুদের ভয়াবহতা পরিষ্কারভাবে বুঝে আসে। কাজেই সুদের মত ভয়াবহ ও জঘন্য হারাম জিনিস গ্রহণ করে সদকা করা কখনই অনুমোদিত হতে পারে না।

হ্যাঁ, সদকা করার হুকুম তাকে দেওয়া হয় যার মালিকানায় কোনোভাবে সুদ এসে গেছে। এ অবস্থায় তার দায়মুক্তির জন্য তাকে সদকা করার কথা বলা হয়। কিন্তু বুঝে শুনে ইচ্ছাকৃত সুদ গ্রহণ করে সদকা করা কখনোই জায়েয নয়।

অনেকে মনে করে, সেভিংস একাউন্টে টাকা দীর্ঘদিন ফেলে রাখলেই কেবল সুদ আসে। একাউন্টে টাকা জমা হবার ২/৪ দিনের মধ্যে তুলে ফেললে বা হঠাৎ লেনদেন করলে সুদও জমা হবে না এবং এতে কোনো গুনাহও হবে না। উক্ত ধারণাটিও সঠিক নয়। কেননা ব্যাংকে সেভিংস একাউন্ট খুলতে হলে একাউন্টে সর্বদা একটা সর্বনিম্ন পরিমাণ (Minimum balance) টাকা জমা রাখতে হয়। যা উত্তোলনযোগ্য নয়। ঐ ন্যূনতম টাকার উপরে ব্যাংক বাৎসরিক সুদ দিয়ে থাকে।

মোটকথা, সুদী ব্যাংকের সেভিং একাউন্ট এবং সব ধরনের ফিক্সড ডিপোজিট সুদী। চাই তা ডিপিএস/DPS (ডিপোজিট পেনশন স্কীম) হোক বা FDR এফডিআর হোক সবই সুদী একাউন্ট। এ সকল একাউন্ট খোলার অর্থই হলো সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া, যা সম্পূর্ণ হারাম। তাই পরবর্তীতে সুদ গ্রহণ না করলেও এধরনের একাউন্ট করলে সুদী চুক্তির গুনাহ হবে। পরে সুদ গ্রহণ করলে তার গুনাহ ভিন্ন হবে। সুতরাং সরকারী হোক বা বেসরকারি কোনো সুদী ব্যাংকে সেভিং একাউন্ট ও ফিক্সড ডিপোজিট করা জায়েয হবে না। অনেকে মনে করেন, সরকারী হলে সেটা সুদী হয় না। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

তবে সুদী ব্যাংকে একটা সেভিং একাউন্ট করতে মানুষ বাধ্য হয়। তা হলো, স্যালারি একাউন্ট। সরকারি ও বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরাসরি হাতে হাতে দেওয়া হয় না। বরং ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সেজন্য কোনো ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামে পৃথক পৃথক একাউন্ট খোলা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসের ত্রিশ তারিখে প্রত্যেকের একাউন্টে তার বেতন-ভাতা জমা দিয়ে দেয়। আর পরবর্তী মাসের এক তারিখে ব্যাংকে গেলেই সবাই নিজ নিজ বেতন উঠাতে পারে। এই একাউন্টের নাম হচ্ছে, স্যালারি একাউন্ট। এটা শুধু স্যালারি উঠানোর জন্য।

এই একাউন্টটা খোলা হয় সাধারণত সুদী ব্যাংকে। আর একাউন্টটি হয় সেভিং একাউন্ট। কারেন্ট একাউন্ট নয়। কেননা যাদের জন্য এই একাউন্ট তারা সকলে চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী নয়। কিন্তু এখানে চাকুরীজীবীর কিছুই করার থাকে না। কোনো চাকুরীজীবী এতে আপত্তি করলেও তার জন্য প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট করতে দিবে না। তারা সবার জন্য কোনো সুদী ব্যাংকে গ্রুপ একাউন্ট করে রাখে। এখানে যেহেতু চাকুরীজীবী বাধ্য। একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে তার কোনো ইখতিয়ার নেই। তাই উক্ত সেভিং একাউন্ট তথা স্যালারি একাউন্ট খোলার গুনাহ চাকুরীজীবীর উপর আরোপ হবে না। এর সকল দায় ও গুনাহ প্রতিষ্ঠানের হবে।

তবে উক্ত একাউন্টে টাকা জমা রেখে দিলেই সুদ আসবে। এজন্য চাকুরীজীবীর দায়িত্ব হলো, একাউন্টে টাকা জমা হওয়ার পর প্রথম দিনেই টাকা উঠিয়ে ফেলা। যদি তার অন্য কোনো বৈধ একাউন্ট থাকে তবে সেখানেও টাকা ট্রান্সফার বা স্থানান্তর করে ফেলতে পারে। কোনো অবস্থায় স্যালারি একাউন্টে টাকা রেখে দিবে না। একাউন্টটা সুদী একাউন্ট ছিল। কিন্তু টাকা উঠিয়ে ফেলার দরুন সুদ আসার সুযোগই হয়নি। স্যালারি একাউন্ট নিয়ে অনেকে পেরেশানি ও জটিলতায় পড়ে। এভাবে করলে তো আর কোনো জটিলতা থাকে না। অর্থাৎ সেখানে কোনো টাকাই জমা রাখবে না। একদম শুরুতেই সব টাকা উঠিয়ে ফেলবে বা সুদবিহীন একাউন্টে সকল টাকা ট্রান্সফার করে ফেলবে।

এখানে কেউ বলতে পারে যে, স্যালারি একাউন্টে টাকা জমা রেখে দিলে অসুবিধা কী! সুদ আসলে তা সদকা করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। না, এমনটা করা যাবে না। সুদ আসার সুযোগই দেয়া যাবে না। সুদ সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দেয়াও নিষেধ। এজন্য শুরুতেই একাউন্ট থেকে সব টাকা সরিয়ে ফেলতে হবে। এটা করা হলে স্যালারি একাউন্টের কারণে চাকুরীজীবী গুনাহগার হবে না। কেননা সে একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে বাধ্য ছিল। কিন্তু সেখানে টাকা রেখে দেওয়ার জন্য তো বাধ্য নয়। সে ইচ্ছাকৃত টাকা রেখে দেওয়ার কারণে সুদ জমা হলো। আর সুদ জমা হওয়ার সুযোগ দেওয়ার কারণে সে গুনাহগার হবে। ঐ সুদের টাকা নিজে ভোগ না করে সদকা করে দিলেও সুদ জমতে দেওয়ার কারণে গুনাহ হবে।

৩. লকার (Locker) সার্ভিস গ্রহণের হুকুম
ব্যাংকের লকার সার্ভিস গ্রহণ মূলত ব্যাংকের সাথে একাউন্ট হোল্ডারের ইজারা তথা ভাড়া চুক্তি। একাউন্ট হোল্ডার নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে ব্যাংকের ভল্ট বা সিন্দুক ভাড়া নেয় এবং নিজের জিনিসপত্র সেখানে রাখে। তার জিনিসপত্রের সাথে ব্যাংকের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা সে ব্যাপারে অজ্ঞাত থাকে।

ফলে এতে ব্যাংকের সাথে ভল্টের ভাড়া ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক লেনদেন হয় না। তাই সুদ আদান-প্রদানের কোনো সুযোগ এখানে নেই। অতএব ব্যাংকের লকার সার্ভিস গ্রহণ করা বৈধ ও শরীয়তসম্মত।

উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হলো, সুদী ব্যাংকে প্রয়োজনের খাতিরে কারেন্ট একাউন্ট খোলা সুদী কারবারে সহযোগিতা করার নিয়ত না থাকলে জায়েয। তদ্রূপ লকারের সুবিধা গ্রহণ করাও বৈধ। তবে গ্রহণযোগ্য ইসলামী ব্যাংক থাকাবস্থায় সুদী ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট খোলা মাকরূহ। আর সেভিংস একাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট করা সর্বাবস্থায় নাজায়েয। [বুহুসুন ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরাহ ১/৩৫০-৩৬১; ফিকহুল বুয়ূ ২/১০৬১-১০৬৩]

কারো সুদী একাউন্ট থাকলে করণীয়
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অজ্ঞতাবশত যারা সুদী একাউন্ট করে ফেলেছেন তারা এখন কী করবেন? এবং এ যাবতকাল একাউন্টে যে সুদ জমা হয়েছে তার বিষয়ে কী করণীয়? এ ব্যাপারে কথা হলো, প্রথমে উক্ত সুদী একাউন্টটি অবিলম্বে ক্লোজড করে দিতে হবে বা সম্ভব হলে সেটিকে কারেন্ট একাউন্টে রূপান্তর করে নিতে হবে। আর এযাবৎ জমাকৃত টাকার অতিরিক্ত মুনাফা, ইন্টারেস্ট কিংবা সুদ নামে যত টাকা জমা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত গরীবদের দান করে দিতে হবে। কোনো টাকা নিজে ব্যবহার করা যাবে না। আর বিগত দিনে এ ধরনের একাউন্ট করার জন্য খাঁটি মনে আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করতে হবে।

ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট খোলার বিধান
এ তো গেল সাধারণ সুদী ব্যাংকগুলোর হুকুম। এখানে প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় চলে আসে তা হলো, আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর হুকুম কী? তাতে একাউন্ট খোলার বিধান কী? এবং উক্ত ইসলামী ব্যাংকগুলো কর্তৃক প্রদেয় মুনাফার হুকুমই বা কি?

আসলে ব্যাংককে ইসলামী রূপ দেওয়া অত্যন্ত নেক ও মহৎ একটি উদ্যোগ। আমরা অবশ্যই তাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাই যদি তারা সঠিক মাসায়েল জেনে তদানুযায়ী ব্যাংক পরিচালনা করেন। এজন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো ব্যাংকের সর্বপ্রকার লেনদেন মুহাক্কিক মুফতিয়ানে কেরামের নেগরানিতে হওয়া এবং প্রত্যেক ব্রাঞ্চে কমপক্ষে একজন বিজ্ঞ মুফতী নিয়োগ দেওয়া, যিনি সর্বপ্রকার লেনদেন তদারকি করবেন।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হওয়ার দাবীদার ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিপূর্ণ ইসলামী বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। বড় বড় ইসলামী ব্যক্তিবর্গ শরীয়াহ কাউন্সিল বা উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে থাকলেও ব্যাংকের লেনদেন তদারকিতে তাদের কোনো কার্যকারী ভূমিকা থাকে না। বরং তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শুধুমাত্র ব্যাংকের AGM এ পুতুল সদৃশ তাদেরকে রাখা হয়। অথচ শুধু এতটুকু দ্বারাই কোনো ব্যাংকের ইসলামীকরণ হতে পারে না।

ইসলামী ব্যাংকগুলো মূলত নিম্নোক্ত কয়েকটি পদ্ধতিতে অর্থায়ন করতে পারে-
১। মুশারাকা
২। মুদারাবা
৩। মুরাবাহা
৪। ইজারা (Lease)
৫। সালাম
৬। ইস্তেসনা।

উপরোক্ত প্রতিটি লেনদেনের নির্দিষ্ট শরঈ রূপরেখা ও বিস্তারিত বিধান রয়েছে। যেগুলো সম্পর্কে কেবল বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম অবগত। এগুলো পরিচালনার জন্য শুধু ভাসা ভাসা জ্ঞান থাকা যথেষ্ট নয়। কেননা লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্যের মাসায়েল অন্যান্য মাসায়েল থেকে কিছুটা জটিল হয়ে থাকে। উপরোক্ত অধিকাংশ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকওয়ালারা খাতা কলমে ইসলামী ব্যাংকিং দেখালেও বাস্তবে তারা সেভাবে করে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপর্যাপ্ত জনবলের অজুহাতে গলদ তরীকায় জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে বাইয়ে মুরাবাহার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তারা পণ্য বিক্রির বদলে গ্রাহকের সাথে সরাসরি টাকা আদান-প্রদান করে থাকে, যা স্পষ্ট সুদ। এছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা শরীয়তের লেনদেন সম্পর্কিত শর্তাবলী রক্ষা করতে পারে না।

প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকের স্বতসিদ্ধ একটি অবৈধ কারবার হলো, মুরাবাহা মুআজ্জাল (বাকিতে কিস্তির ভিত্তিতে বিক্রি)। এক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো একটি কিস্তি (Installment) দিতে অপারগ হয় বা দেরি করে তবে ঐ পরিমাণের বিপরীতে সময়ের অনুপাতে চার্জ বা মুনাফার নামে অতিরিক্ত একটি অংক ধার্য করে দেয়। অথচ পণ্য বিক্রির চুক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণ দামের উপর পূর্বেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন সময়ের বিপরীতে যে পরিমাণ অতিরিক্ত ধার্য করা হলো তা নিঃসন্দেহে সুদ। আমাদের জানা মতে কোনো ইসলামী ব্যাংকই এক্ষেত্রে ছাড় দেয় না। যাই হোক, এখানে তাদের প্রতিটি লেনদেনের স্বরূপ উদ্ঘাটন উদ্দেশ্য নয়। বরং তাদের লেনদেনের বাস্তবতা বুঝানো উদ্দেশ্য।

সারকথা, আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর কারবার পর্যবেক্ষণ করে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তারা নিজেদের বিনিয়োগ পদ্ধতি ও লেনদেনে যথাযথভাবে শরীয়ার অনুসরণ করে না। এই ব্যাংকগুলো সম্পর্কে এ অভিযোগটি অনেকেরই রয়েছে। তাই যতদিন পর্যন্ত এসকল ব্যাংক তাদের সার্বিক কার্যক্রমে যথাযথ ইসলামী শরীয়া অনুসরণের বিষয়টি বাস্তবিকভাবে নিশ্চিত না করবে ততদিন ইসলামী নামের এসব ব্যাংকের একাউন্ট থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ভোগ করা একাউন্টধারীর জন্য কিছুতেই নিরাপদ হবে না। উক্ত মুনাফাও গরীব মিসকীনকে সদকা করে দেওয়া উচিত হবে। আর তাকওয়ার উপর চলতে চায় এমন ব্যক্তিদের এসব ব্যাংকে চাকুরি করা থেকেও বেঁচে থাকা উচিত।

তবে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোতে কারেন্ট একাউন্ট খোলা জায়েয। আর প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সেভিং একাউন্ট ও ফিক্সড ডিপোজিটও খোলা যাবে। কেননা এক্ষেত্রে তাদের সাথে কৃত চুক্তিটি অবৈধ নয়। কেননা তারা মানুষের কাছ থেকে মুদারাবার ভিত্তিতে টাকা গ্রহণ করে, যা শরীয়তসম্মত। যদিও তাদের দেয়া মুনাফা ভোগ করা যাবে না; সদকা করে দিতে হবে।

লেখকঃ মুফতি ইমদাদুল্লাহ্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button