বিশেষ কলাম

এভাবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে থাকলে একসময় দেশে যা ঘটবে

মীর মোঃ তাসনীম আলমঃ ইসলামি ধারার ৫টি ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ঋণ সুবিধা থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রচলিত ব্যাংক গুলো রেপো, রিভার্স রেপো, কল মানি ইত্যাদি মাধ্যমে অন্যান্য ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পেলেও শরিয়ত ধারার ব্যাংকগুলোর সেই সুযোগ নেই। সেই সুযোগের প্রয়োজনও কখনো পড়েনি, কারণ ইসলামি ব্যাংকগুলোই এতদিন জরুরী প্রয়োজনে অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে তারল্য সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করেছে।

সুতরাং, সরকার তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে এবং এটা সরকার দিতে বাধ্য। ব্যাংকের লাইসেন্স সরকার দেয় এবং ডমিনো ইফেক্টের কারণে কোন ব্যাংককেই সরকার দেউলিয়া হতে দিবেনা। ডমিনো ইফেক্ট মানে, দেশের ৬১টা ব্যাংকের মধ্যে একটি ব্যাংকও দেউলিয়া হলে সাধারণ মানুষ বাকি ব্যাংকগুলো থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলবে, তাদের জমানো টাকা উত্তোলন শুরু করবে যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিবে। ব্যাংক আমাদের থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ৬ টাকা লাভ দেয়, সেটা আবার ৯ টাকার বিনিময়ে ধার দেয়। মাঝখানে ৩ টাকা তাদের লাভ থাকে। আমরা আমাদের টাকা উত্তোলন শুরু করলে ব্যাংক সবার টাকা দিতে পারবেনা, কারণ সে আমার টাকা আরেকজনকে ধার দিয়েছে। আরেকজন সেই টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করছে, অর্থনীতি সচল রেখেছে।

কী হবে যদি টাকা উত্তোলন আমরা অব্যাহত রাখি? ব্যাংক কি টাকা দিতে না পেরে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করবে? উত্তর হল ‘না’। কোন দেশই তাদের ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করতে দিতে চাবেনা।

তারল্য সংকট থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমান পরিস্থিতির মত বিশেষ ঋণ সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা সরবরাহ করবে। সেই টাকা ব্যাংক শোধ করতে না পারলে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে পুনরায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো টাকা ধার নিবে। এভাবে চলতে থাকবে যতদিন সংকট থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার এত টাকা পাবে কোথায়? সরকার টাকা পায় সাধারণত ট্যাক্স থেকে অথবা অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ এবং সাহায্য থেকে। আমাদের খরচের জায়গা্র অভাব নেই, প্রতিবছর বিশাল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যায় বাজেটে। সুতরাং ব্যাংকসমূহের এই অতিরিক্ত তারল্য চাহিদা বাংলাদেশ ব্যাংক যোগান দিবে Quantitative Easing বা টাকা ছাপিয়ে। টাকা ছাপানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেষ হাতিয়ার। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ছাপানো বা সীমিত পর্যায়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা উন্নয়নশীল দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে অতিরিক্ত টাকা ছাপানো ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপায় থাকবেনা। দেখা দিবে চরম মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি। নিত্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আয়সীমার অতিরিক্ত বাড়তে থাকবে, দেশে দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এর মানে টাকা তুলে ফেললে আদতে কোন লাভ নাই। আপনি চাইলে সবসময়ই ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন। সবাই একসাথে টাকা তুলে ফেললে মুদ্রাস্ফীতির দরুন দেশের সবাই একসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে আপনাকে ব্যাংক কখনো বলবেনা যে টাকা নেই। টাকা কাগজ ছাড়া অথবা কম্পিউটারের ভেতর থাকা কিছু সংখ্যা ছাড়া কিছুই না। এর মূল্য নির্ধারিত হয় আমার-আপনার, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর। আপনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অর্থনৈতিক কিছু না করে বাসায় রেখে দিলে উৎপাদন কমবে। সেই টাকা না তুলে ব্যাংকে রেখে দিলে ব্যাংক কোন ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে এবং এতে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, ১৮ কোটি মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

টাকা ব্যাংকে রাখুন কারণ এটাই সবথেকে নিরাপদ। Self Fulfilling Prophecy- এর ধারণা অনুযায়ী সবাই মিলে যা ভাবে বা যা চায়, সেটাই হয়। ছোট্ট উদাহরণ হল, মার্কেটে কোন একটা কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাবে গুজব রটলে সেই শেয়ারের দাম আসলেই বেড়ে যায়। কারণ সবাই শেয়ারটার দাম বাড়ার আশায় কিনা শুরু করে। সবাই কিনতে থাকায় মার্কেটে সেই শেয়ারের ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই থাকেনা, দাম আসলেই বেড়ে যায়। কাল যদি গুজব উঠে যায় আলুর দাম বেড়ে যাবে, সবাই মিলে আলু কেনা শুরু করবে। মার্কেটে আলু কমে যাবে, আলুর দাম আসলেই বেড়ে যাবে। ব্যাংকে টাকা নাই, এটা প্রচার হওয়ার কারণে আমরা টাকা উত্তোলন শুরু করেছি। Self Fulfilling Prophecy- এর দরুণ টাকা আসলেও নাই হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সমস্যা হল এখানে টাকা জিনিসটা আমরা যেরকম ভাবি সেরকম না। টাকা শেষ হয়না, টাকার মূল্য কমে যায়। সুতরাং এই Prophecy অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা দেশের সব মানুষ, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষেরা যারা কোনদিন কোন ব্যাংকে প্রবেশও করেনি।

টাকার মূল্য কমে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং টাকা ব্যাংকেই রাখুন। আপনি টাকা তুললেও যা, না তুললেও তা। ব্যাংক আপনাকে সবসময়ই টাকা দিতে পারবে, কিন্তু সেই টাকার মূল্য হয়তো আর থাকবেনা। সময় থাকতে সাবধান হওয়া বাঞ্চনীয়।

লেখকঃ মীর মোঃ তাসনীম আলম, ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button