ব্যাংকার

নতুন জায়গায় বদলিঃ অনুজ ব্যাংকারদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ফেসবুকে পোস্ট থেকে কিছু বিদায় ও কিছু ওয়েলকামের ছবি দেখে বুঝতে পারলাম যে আমার প্রিয় ব্যাংকের ট্রান্সফার পোস্টিং হয়েছে। এটি ব্যাংকের একটি নৈমিত্তিক কাজ। ইসলামী ব্যাংক বরাবরই এক্ষেত্রে পাংচুয়াল। তিন বছর হলেই বদলির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম হুবহু অনুসরনে কোন বাঁধা প্রতিবন্ধকতাই এখানে নেই। কোন পদের জন্যই এই ব্যাংকে কাউকে অতি প্রয়োজনীয় বিবেচনা করা হয় না। ঠিক সময়ে বদলি হয় এবং যোগ্য একজন উত্তরসূরী দায়িত্বে আগুয়ান হন। মূলতঃ এভাবেই এখানে নেতৃত্ব তৈরী হয়।

আমার সাইত্রিশ বছরের চাকুরী জীবনে এমন বহু বদলির সম্মুখীন হয়েছি। শাখা পর্যায়ে ক্যারিয়ার শুরু।তারপর জোন হয়ে হেড অফিস। ব্যাংকের সব স্তরে এবং সব বিভাগেই কাজ করেছি। তবে মফস্বল শহরে বা কোন থানা সদরে কাজ করতে পারিনি। ঢাকা দিয়ে শুরু, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা হয়ে ফের ঢাকায়।মাঝখানে আড়াই বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনে। হেড হিসাবে আইটি, ইন্টারনাল কন্ট্রোল এন্ড কমপ্লায়েন্স ও অপারেশানে এবং চীফ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কর্মকর্তা হিসাবে বেশ কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেছি। ব্যাংকের সামগ্রিক মেয়াদ উত্তীর্ণ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও আমার কাঁধে ছিল ক’বছর।

সবসময় বদলি যে আকাংখিত শাখা বা বিভাগে হবে- এমনটি নয়। বদলি সবসময়ই কর্তৃপক্ষের সদয় ইচ্ছায় ঘটে। তবে পারফরমেন্সের বিষয়টি এইচআর-এর সামনে থাকে। অন্যান্য পরিবেশগত বিষয়ও বদলির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়। সেকারণেই বছরের শুরুতে সাধারণতঃ বদলির আদেশ আসে। মেনে নিতে হবে ম্যানেজমেন্ট ভালো মনে করেই আমাকে কোন বিশেষ স্থানের দায়িত্ব দিয়েছে। কাজেই কমপ্লায়েন্ট থাকাই উত্তম। আর বিশেষ কোন অসুবিধা হলে আগে বদলি আদেশ অনার করে তবে অসুবিধার বিষয়টি উত্থাপন করা উচিত। ম্যানেজমেন্টের কোন সিদ্ধান্তে অমত বা বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখালে শেষতঃ তার ফল ভাল হয়না।

বদলীজনিত কারণে স্টাফ অফিসারদের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনতে হয়। বাসা বদলি হয়, পরিবার শিফট হয়, সন্তানাদির স্কুল বদল হয়। কর্মস্থল এবং বসত স্হলে নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে মিশার সূযোগ হয়, নতুন বন্ধুত্ব ও নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হয়। ব্যাংকারদের জন্য বাড়তি নতুন গ্রাহকদের সাথে প্রথম দিন থেকেই লেনদেন করতে হয় যেন অভ্যস্ত ও দীর্ঘ দিনের পরিচিতের মত, এখানে নতুন আবহের ধীরতার সূযোগ নেই। আপনি নতুন বলে সেবামানে ঘাটতি কেউ ক্ষমা করবে না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

একটি নতুন জায়গায় চলে যাওয়া কিছুটা অস্বস্তিবোধ হতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি নতুন কর্মস্থলের কাউকে না জানেন বা এলাকা সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা থাকে। প্রথমে একটু বাস্তুচ্যুত বোধ হওয়া স্বাভাবিক, বিশেষ করে যখন আপনি একটি নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দু’ একদিন নিজেকে আলাদা মনে হলেও পরে সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়। যদি পূর্ব থেকেই পরিচিত, নতুন কর্মস্থলের এমন কারো সাহায্য পেয়ে যান তবে এ সমস্যাও থাকবেনা আশাকরি।

আপনার নতুন কম্যুনিটি সম্পর্কে আরও জানতে, এখানে আপনাকে মানিয়ে নিতে এবং বসতি স্থাপনে সহায়তা করার জন্য কয়েকটি স্মার্ট টিপস রয়েছে:

আপনার নতুন এলাকার অফিস কলিগদের সম্পর্কে জানুন
প্রথমেই এ কাজটি আপনার করা উচিত। হতে পারে এরা সবাই আপনার জন্য একদমই অচেনা আবার এর বিপরীতও হতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা হলো, ভাল কর্ম পরিবেশের জন্য সে কলিগরা আপনাকে সহযোগীতা দিবে, ভবিষ্যত ক্যারিয়ারে যারা আপনাকে সঙ্গ দিবে তাদের প্রত্যেক আচার আচরন, রেসপন্স প্রক্রিয়া এমনকি তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জানা থাকলে কাজ করতে সহজ হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি শাখায় একজন কর্মকর্তার অদ্ভুত আচরনে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম। পরে তাকে হেড অফিসে সরিয়ে আমাকে উত্তম কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়েছিল।

নতুন এলাকার ব্যবসা ও গ্রাহকদের সম্পর্কে জানুন
ব্যাংকের প্রতিটি শাখার গ্রাহকও আলাদা আলাদা। ডিপোজিট গ্রাহকদের তেমন চেনা-জানার সূযোগ কম। তবুও বড় ডিপোজিটরদের সাথে সাক্ষাতে তারা প্রীত বোধ করে। বিনিয়োগ গ্রাহকদের জানা আবশ্যিক। যদিও ইসলামী ব্যাংকের পদ্ধতিগত কারণে বছরে দু’বারের বেশী সাক্ষাত হয়না। একবার ডিসবার্সমেন্ট কালে, আবার বছর শেষে রিকোভারীর সময়। বরাবরই দেখেছি, শাখাগুলোতে বিনিয়োগ পণ্যের মুভমেন্ট সম্পর্কে শাখা অন্ধকারে থাকে। আর ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড গ্রাহকের তো খবরই নেই। বলা হয়ে থাকে যাদের বিনিয়োগ কিচেন অফ হয়েছে প্রায়ই তাদের কবর খুঁড়ে আনতে হয়। এগুলো সামান্য যত্নের সাথে নিয়মিত তদারকি হলে এবং শাখা পর্যায়ে চোখের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখলে মন্দ বিনিয়োগ কমে আসতে বাধ্য।

শক্তিশালী টীম ম্যানেজমেন্ট ও ইন্টারনাল লুকের দিকে নজর দিন
বহু শাখা এমন আছে যেখানে টীম ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো। সব কাজ সুশৃংখল ও পরিপাটি। প্রতিদিনের উপস্থিত গ্রাহক সেবার মান সন্তোষজনক ও অভিযোগবিহীন। রেকর্ড কিপিং ও ফাইল ব্যবস্থাপনা গোছানো। এমনকি টয়লেট অযুখানাও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এতে আপনাদের রুচিবোধের পরিচয় মেলে। কিন্ত এর বিপরীতও দৃশ্যমান। যুগ যুগের ভাঙ্গা আসবাব, কম্পিউটার সামগ্রী ও অকেজো বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে শাখার দামী জায়গা দখল করে আছে, কারো এগুলো সরানোরও গরজ অনুভব হয়না। বেসরকারী ব্যাংকে এমন চিত্র বড় বেমানান ও ইমেজ নষ্ট করে। আমি দেখেছি, বহু শাখার সাইনবোর্ডটিও রাতের বেলা জ্বলে না, সিঁড়ি ও করিডোর বাতির অভাবে অন্ধকার থাকে।

আপনার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করুন, তাদের খবর রাখুন
এখন দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ষাটের উপর এবং সমৃদ্ধ এলাকায় প্রত্যেকেই শাখা আছে। আপনার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করা তাদের বন্ধু তৈরি করুন। ব্যবসায় প্রতিযোগীতা অবশ্যম্ভাবী তবে তা হবে ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে। তাদের ব্যবসায়িক পজিশান জানার চেষ্টা করুন। এলাকার প্রশাসনিক ও সামাজিকভাবে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সখ্যতা গড়ুন। পাড়ার ক্লাব, সমিতি, এসোসিয়েশান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারী অফিস ভিজিট করুন এবং পরিচিত হোন। এতে আপনার অবস্থান দৃঢ় হবে এবং ব্যাংকের পরিচিতি প্রকাশ হবে। ঘরকুণী অফিসারদের দিয়ে ডেভেলপমেন্ট হয়না।

আপনার ডেক্স ও চেম্বারের দরজা বন্ধ করবেন না
গ্রাহকগণকে আপনার কাছে আসতে বারণ করবেন না। তারা আছে তাই আমরা আছি। এমনও দেখেছি যে ডেক্স অফিসার গোমড়ামুখে নির্লিপ্ত নীচের দিকে তাকিয়ে কাজ করছেন, তার আশেপাশে ভূমিকম্প হলেও টের পান না। এরা কাজ পাগল না বরং লোকের সংশ্রব পছন্দ করেন না। ম্যানেজার হলে তো আর কথাই নেই। স্টাফরা পর্যন্ত চেম্বারে যেতে ভয় পায়। এগুলো অলক্ষ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।গ্রাহকরা আপনার কাছে পৌছতে না পেরে হয়তো ব্যাংকই ছেড়ে দেয়, আপনি তা জানেনই না। শত শত লোকও যদি আপনার সেবা প্রত্যাশী হয়, রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। শেষ লাভটা আপনারই হবে। আপনার বিষয়ে এই গ্রাহকরাই বাজারে ভালো মন্তব্য করবে এবং আপনার জন্য দোয়া করবে।

আমি শুনেছি, অনেকেই বৃহস্পতিবার নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বিদায় নিয়েছেন। আপনাদের সকলের সুস্বাস্থ্য ও উন্নতি কামনা করছি। নতুন কর্মস্থল আপনারা উপভোগ করুন এবং ক্যারিয়ারে একটি মাইলফলক হিসাবে গ্রহন করুন।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button