বিশেষ কলাম

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে। গত তিন দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোনো সূচকের বিচারে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০-এর পর সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। দারিদ্র্যের হার অর্ধেক হয়ে গেছে। মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে, জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সক্ষম দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গ্রহণের হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য অনেক বেশি, যা নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বেশ কয়েকবার প্রসংশার সাথে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রতিবছর ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক’ প্রকাশ করে থাকে। ২০১৯ সালের জন্য প্রস্তুত করা সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৫৫.৬ এবং আগের বছরের তুলনায় সাত ধাপ বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম। ভারতের অবস্থান ১২৯তম, পাকিস্তানের ১৩১তম এবং নেপালের ১৩৬তম অবস্থান। এ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আইনের শাসন, সরকারি আয়-ব্যয়ের পরিমাণ, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নগত দক্ষতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভিত্তি করে নম্বর হিসেব করা হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম।

বিগত পাঁচ দশকে বিদেশি রাষ্ট্রের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ এখন অর্থনীতিতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও অর্থনৈতিক সূচকগুলো গর্ব করার মতো। কেবল পাকিস্তানকেই নয়, অর্থনীতি ও সামাজিক নানা সূচকে ভারতের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। মাত্র ৪ হাজর ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করা যুদ্ধবিধ্বস্ত, অভাব-অনটনে জর্জরিত সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের এখনকার জিডিপির আকার ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া বাংলাদেশ ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে পরিণত হয়েছে। শূন্যের ঘরে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুদিন আগে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছিল। একসময় ১২৯ মার্কিন ডলার আয় করা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২,৫৫৪ ডলার।

২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ বছর পর ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। এখন ৪১তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সব ঠিকঠাক থাকলে ২০৩৩ সালে অর্থনীতির দিক থেকে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকে অতিক্রম করবে বাংলাদেশ। ১৫ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। প্রতিবেদনটি বলছে, আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি আড়াইগুণেরও বেশি বাড়বে। ২০২০-২১ সালে স্থিরমূল্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হয়েছে। ১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে ১৯ শতাংশে নেমেছিল। ২০১৯ সালের জুনে দারিদ্র্য হার সাড়ে ২০ শতাংশে নেমেছিল। ২০১৮ সালের জুনে ছিল ২১.৮ শতাংশ। এ দিকে জুন ২০২০ শেষে অতি দারিদ্র্যের হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে। এক বছর আগে ছিল ১১.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬ সালের ব্যয় ও আয় জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এই অনুমিত হিসাব করেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, দিনে ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করতে পারলে ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র ধরা হয় না। বিবিএস এর মতে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ জন। ২০১৯ সালের জুন শেষে অতি গরিবের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের কিছু বেশিতে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। এর মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে সোয়া তিন কোটি মানুষ। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে হতদরিদ্রের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। তবে করোনাকালীন সময়ে দারিদ্র্যের অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দেশগুলোর অগ্রগতি যাচাই প্রতিবেদন “টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২০” এ বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৬৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশর অবস্থান পঞ্চম। এছাড়া, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সূচকভিত্তিক বাংলাদেশের অগ্রগতি মূল্যায়নে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। তবে অতি দারিদ্র্য নিরসনে সফল হলেও দারিদ্র্য নিরসনে সফলতার হার কম।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৭৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারীর মধ্যেও ২০২০-২১ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮.২ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ৭.২ শতাংশ করেছে সরকার। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮.১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৭.৮৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সিংহভাগই ছিল দরিদ্র। এখন তা কমে অর্ধেকে নেমেছে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ। জনসংখ্যার হিসাবে এই হার বেড়েছে, তবে অতিদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী তিন বছরে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৪৭ শতাংশ। এখন তা নেমে সাড়ে ৬ শতাংশে অবস্থান করছে। ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৩১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে দেশের ৭ কোটি মানুষের জন্য দেওয়া বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা, অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য দেওয়া বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ প্রায় ৩৭ হাজার টাকা।

তবে ৫০ বছরে বেড়েছে দেশের ঋণ। সরকারের তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ৯ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৮ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়াও এ ঋণ জিডিপির ৩৫ শতাংশের বেশি। তবে, বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস্য থেকে নেওয়া ঋণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যে কোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশের নিচেই রয়েছে।

স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১২৯ ডলার। এখন তা আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২,৫৫৪ ডলারে। সাফল্য আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারেও। বাংলাদেশে এখন এই হার মাত্র ১.৩ শতাংশ আর দক্ষিণ এশিয়ার গড় ১.৪ শতাংশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই গড় অনেক বেশি, ২.১ শতাংশ। স্বাধীনতার ঠিক পরেই দেশের মানুষ গড়ে বেঁচে থাকত ৪৬ বছর, এখন সেই গড় ৭২.৬ বছর। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার গড় হচ্ছে ৬৫ বছর। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এক হাজার নবজাতকের মধ্যে মারা যায় ৭০ জন, দক্ষিণ এশিয়ায় ৫২, আর বাংলাদেশে ৩৫ জন। বাংলাদেশেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি স্কুলে যায়। বাংলাদেশ কেবল পিছিয়ে আছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে।

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) সম্প্রতি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হয়, মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হয় এবং মাথাপিছু আয় সূচকে ১,২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হয়। মাথাপিছু আয় হিসাবটি জাতিসংঘ অ্যাটলাস পদ্ধতিতে করে থাকে। সেখানে মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে তিন বছরের গড় হিসাব করা হয়।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বলছে, ৬ শতাংশ হারে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি অর্জন গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করেছে। মূলত ৮০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো আয়, তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব বা এক জমিতে দুই ফসল দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। আবার সরকারও পিছিয়ে পড়া ও অতি দরিদ্রদের জন্য সামাজিক কর্মসূচি খাতে অব্যাহতভাবে বাজেট বাড়িয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষ এখন এই কর্মসূচির আওতায়। এ খাতে সরকার জিডিপি অংশ হিসেবে যে অর্থ ব্যয় করছে, তা বড় অর্থনীতির দেশ ভারতের সমপর্যায়ের। নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এর চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় করে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের জন্য নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইএমএফও বলছে, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান মূলত মেয়েদের লক্ষ্য করে ক্ষুদ্রঋণ দেয়। আরও রয়েছে ব্র্যাকের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করার কারণে মেয়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়ায় তাঁরা এখন অনেক বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছে। ফলে পরিবারের সদস্যসংখ্যা নির্ধারণে মেয়ের ভূমিকাও বেড়েছে। পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এঁরাই বাংলাদেশকে অনেকখানি এগিয়ে নিচ্ছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ঠিক করা হয়েছিল ১৯৯০ সালে। বাংলাদেশও ওই সময় থেকেই ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে।

বিগত পাঁচ দশকে দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্প কারখানা হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও চোখে পড়ার মতো। তিল তিল করে গড়ে ওঠা অর্থনীতিতেই এখন নিজের পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, কর্নফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে এবং এসবের কৃতিত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে অর্থনীতির এ অগ্রযাত্রা ও উন্নতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

আসলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে অর্থনীতি আরও এগোতে পারতো। ১৯৮০ সালে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮.১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু করোনার কারণে ২০২১-২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৭ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সন্তোষজনক হারে বেড়েছে, এছাড়া, দেশের অর্থনীতি ভালোভাবেই এগোচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ঠিক জায়গায় রয়েছে। ২০২৫ সালের আগেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করবে। অর্থনীতির সব সূচকেই এগোবে বাংলাদেশ। এখন উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, ৫০ বছরের তরতাজা যুবক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান সূর্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মুক্তির মূর্ত প্রতীক।

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button