মোবাইল ব্যাংকিং

মোবাইল ফোনে টাকার ব্যাংক

আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ১৬টি ব্যাংক এখন দেশজুড়ে এই সেবা দিচ্ছে। তবে এই সেবার বড় হিস্যাই ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেট এবং ডাক বিভাগের নগদ-এর। তাদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়েই এবারের আয়োজন।

ময়মনসিংহের ফজর আলী, পেশায় রিকশাচালক। দেড় দশক ধরে ঢাকায় রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর দুই মেয়ে ময়মনসিংহের স্কুলে পড়াশোনা করে, স্ত্রীও সেখানে থাকেন। আগে তিনি পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে কুরিয়ার সার্ভিসের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তা নিতেন।

তিন বছর ধরে টাকা পাঠাতে আর কারও সহায়তা নেন না। মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে নিজেই টাকা পাঠিয়ে দেন। এতে যেমন টাকা পাঠানোর ঝুঁকি কমে গেছে, একইভাবে তাৎক্ষণিক টাকাও পেয়ে যাচ্ছে তাঁর পরিবার।

ফজর আলীর মতো সব রিকশাচালক ও কম আয়ের মানুষের কাছে এমএফএস এখন যেন বড় আশীর্বাদ। সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ নিয়মিত এ সেবা ব্যবহার করছে। আর এ সেবার জন্য নিবন্ধিত গ্রাহক এখন প্রায় ৮ কোটি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, ইউক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ ১৬টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে।

এ বাজারের ৭০ শতাংশ বিকাশের নিয়ন্ত্রণে, ২২ শতাংশ রকেটের ও বাকিটা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর। এরপরও এ সেবার মাশুল এখনো অনেক বেশি। এক হাজার টাকা তুলতে গ্রাহকদের খরচ করতে হয় সাড়ে ১৮ টাকা। এরপরও দৈনিক ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে এ সেবার মাধ্যমে। আর দিনে লেনদেনের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। এতেই বোঝা যায়, এ সেবার পরিধি কেমন।

তবে ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাজারটি এখনো প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠেনি। একটি প্রতিষ্ঠানই বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, আরও একটি বাকিটা। আবার এসব সেবা সেভাবে দেখভালও হচ্ছে না। এর ফলে সেবার মান ও খরচ কমছে না। তাই বাজারটি কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক করা যায়, তা নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে।

এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যে মাশুল আদায় হয়, তার ৬০ শতাংশের বেশি এজেন্টদের দেওয়া হয়। এরপর নেটওয়ার্ক খরচ দিতে হয়। বাকিটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতে খরচ হয়। দিন শেষে মুনাফা হয় খুব কম। তবে দিন শেষে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি জমা থাকছে। এসব অর্থের সুদ থেকেই মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদিকে এমএফএস চালুর ফলে শুধু কম আয়ের মানুষের সুবিধা হয়েছে, বিষয়টা তেমন না। বড় করপোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিকেরাও এর সুবিধা পেয়েছেন। এখন দেশের সব বড় ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য বিক্রির টাকা এ সেবার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে, যাকে কালেকশন সেবা বলছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো।

আবার অনেক বড় শিল্প গ্রুপ তাদের শ্রমিকের বেতনও দিচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে। শুধু তা–ই নয়, সরকারি ভাতা, বৃত্তি, কেনাকাটা, পরিষেবা বিল পরিশোধ—সবই করা যাচ্ছে। আবার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও আদায় এবং বিদেশি সংস্থার তহবিল বিতরণও হয়ে থাকে।

জানা গেছে, হা-মীম গ্রুপের ৪০ হাজার, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের ৩৮ হাজার, বেক্সিমকো গ্রুপের ৩১ হাজার, ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের ১২ হাজার ও এবিএ গ্রুপের সাড়ে ১১ হাজার কর্মীর বেতন হয় বিকাশের মাধ্যমে। আবার ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠান নেসলে বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ, স্কয়ার ফুডসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির টাকা সংগ্রহ হয় বিকাশের মাধ্যমে। আবার ব্র্যাক, ব্যুরো বাংলাদেশসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও কিস্তি সংগ্রহ হয় বিকাশের মাধ্যমে। দিন দিন সেবার আওতা বেড়ে চলেছে।

আবার রকেটের মাধ্যমে ট্রান্সকম বেভারেজ, বার্জার পেইন্ট, বাটা সু, ম্যারিকো বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির টাকা জমা হয়। নোমান, ফকির, অ্যাপেক্স, মোহাম্মদী, এসিআই, প্রাণ–আরএফএলসহ আরও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের কর্মীর বেতন যায় রকেটের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সেবার গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯৬ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক ৩ কোটি ৪৭ লাখ। আর দেশজুড়ে এ সেবা দিতে এজেন্ট রয়েছেন ৯ লাখ ৭১ হাজার। ডিসেম্বরে দৈনিক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, নভেম্বরে যা ছিল ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা জমা করা যায়। মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। আর এক দিনে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো যায়।

সেবা দিচ্ছে ১৬ ব্যাংক
বাংলাদেশে এখন ১৬টি ব্যাংক মোবাইলে আর্থিক সেবা দিচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্​–বাংলার রকেট, ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইউক্যাশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের টেলিক্যাশ, ওয়ান ব্যাংকের ওকে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাই ক্যাশ, প্রাইম ব্যাংকের প্রাইম ক্যাশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের স্পট ক্যাশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের মোবাইল মানি, মেঘনা ব্যাংকের ট্যাপ এন পে।

এ ছাড়া রুপালি, ফার্স্ট সিকিউরিটি, বাংলাদেশ কমার্স, এনসিসি ও যমুনা ব্যাংক দিচ্ছে শিওর ক্যাশ সেবা। এর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের সেবা বন্ধের পথে। আরও কয়েকটি ব্যাংক এমএফএস সেবা চালু করার পর আবার বন্ধও করে দিয়েছে।

সোর্সঃ প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button