ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা: কার কথা থাকবে?
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ স্বীকার করতেই হবে যে ব্যাংক খাত দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা অন্যতম একটি প্রমিনেন্ট খাত এবং সেবাধর্ম প্রতিষ্ঠান হলো শ্রম ও মেধানির্ভর। ঝুঁকি থাকায় যোগদান করেও অনেক মেধাবীরাই শেষতক থাকেনা, নানা অজুহাতে ব্যাংক পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় যোগ দেন। চাকুরী ক্ষেত্রে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় রিফ্রেশার গ্রহন করে। বর্তমানে সরকারী ব্যাংক শাখার বাইরেও ষাটের অধিক প্রাইভেট ব্যাংকের প্রতিবছর নিয়োগ হয় এবং জানামত বাছাইকৃত ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকে জব নেয়। বহুবছর ধরেই যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রিকায় বেসরকারী ব্যাংকগুলোর অভিন্ন পদসোপান ও বেতন কাঠামো নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। অবশেষে এন্ট্রি লেভেলের অফিসারদের অভিন্ন বেতনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা এলো।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দেওয়া সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) দুটি সংগঠন। তাঁরা জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হলে প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ বেড়ে যাবে। এতে মুনাফা কমে যাবে। আর মুনাফা কমলে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এ জন্য বেঁধে দেওয়া বেতন-ভাতা কার্যকরে বাড়তি এক বছর সময় চেয়েছে ব্যাংকগুলো।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকারদের বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে সময় চায় ব্যাংকগুলো
গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী মার্চ থেকে কার্যকর করতে বলা হয় এ–সংক্রান্ত নির্দেশনায়। এ অবস্থায় গতকাল বুধবার দুপুরে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ও প্রধান নির্বাহী বা এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারা এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেন। গভর্নর ফজলে কবির ও দুই ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএবি ও এবিবির নেতারা বৈঠকে নতুন বেতন-ভাতা কার্যকর হলে ব্যাংক খাত ও অর্থনীতিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন কার্যকর করতে হলে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ বেড়ে যাবে। মুনাফা কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে শেয়ারের দামে ও সরকারের রাজস্ব আয়ে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে নতুন কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হবে। বেতন-ভাতা বেড়ে গেলে অন্য খাতের কর্মীরাও ব্যাংকের চাকরির জন্য ছোটাছুটি শুরু করবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বিএবি ও এবিবি নেতাদের কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। তবে বেতন-ভাতা কার্যকরের সময় পিছিয়ে দিতে পারে বলে জানা গেছে। বেতন-ভাতা নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয় বৈঠকে। এতে সরকারি ও বেসরকারি অন্য খাতের বেতন কাঠামো, জীবনযাত্রার ব্যয়, ব্যাংকের অস্বাভাবিক মুনাফাসহ আরও নানা বিষয় তুলে ধরা হয়।
তবে, আমি কোন সুত্রে দেখিনি যে দুটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কেউই বাংলাদেশ ব্যাংকের এধরনের হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি, এমনকি নির্দেশ পালন করতে অপারগও বলেননি। হতে পারে, তারা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝেছেন তবে তাদের বক্তব্য হলো আরো একবছর এজন্য সময় দরকার। কিন্ত কেন? বাজেটে এমন খরচের সংস্থান রাখা হয়নি। তদুপরি এখন ব্যাংকের আয় পর্যাপ্ত নয়। কথাগুলো শুধু বলার জন্যই বলা বটে।
গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো আয় করেছে ১৬৯২৫ কোটি। প্রত্যেক বছরই ব্যাংকগুলোর মধ্যে বছরশেষে মুনাফার প্রতিয়োগীতা থাকে। তাতে অধিকাংশ ব্যাংকেই পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ভাল মুনাফা করে। জানা মতে,মুনাফা থেকে কর্মকর্তা কর্মচারীদের চার পাঁচ কিংবা আরো বেশী উৎসাহ বোনাস দেয়া হত। গত কয়েক বছর স্ফীত মুনাফা হলেও বোনাস সংখ্যা কমে গিয়েছে। এখন এক বোনাসে ব্যাংকারদের সন্তষ্ট থাকতে হচ্ছে। বেতন-ভাতা দু’বছর/তিন বছর পর পর রিভিউ হবার স্থলে গত দু’বছর বেতন বাড়েনি সংগত কারণেই। এ নিয়ে ব্যাংকারদেরও তেমন অভিযোগ নেই।
ব্যাংকগুলো আগের মত আয় করতে পারছেনা মানে ৠণের সুদ কমে গিয়েছে। তাতে কি ব্যাংকের আয় কমেছে নাকি ডিপোজিটরের আয় কমেছে? ব্যাংকের আয় সুদ নেয়া দেয়ার গ্যাপ থেকে আসে। সে স্প্রেড তো ঠিকই আছে। ব্যাংকের আয় কমলে তার প্রতিফলন বৎসরান্তের লাভে পড়েছে কি? বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের আয় বাড়াতে আপাতঃ ক্লাসিফাইড লোনগুলিকেও আনক্লাসিফাইড রেখে আয় প্রদর্শনের সূযোগ করে দিয়েছে।
আরও দেখুন:
◾ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকারদের বেতন ও ছাঁটাই ইস্যুতে অনড়
তবু ব্যাংকার ও মালিকগণের অনুযোগ মনোযোগের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুনেছেন। নিশ্চয়ই শীঘ্র তারা কিছু জানাবেন। ব্যাংকের বেতন ভাতা নিয়ে বেশ কয়েক বছর কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমার মতে কোন একটি বিশেষ ক্যাটাগরীর অফিসারদের বেতন সীমা স্থির করে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়না। পর্যায়ক্রমে উচ্চ স্তরেও এর প্রতিফলন ঘটে। ফলে, এটি খন্ডিতভাবে কেবল এন্ট্রি লেভেলেরই ইস্যু নয়, রীতিমত স্কেল পুনর্গঠন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এন্ট্রি লেভেলের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়েছে, বাকীগুলোর কি হবে? সেখানে কি বেতন একইরকম থাকবে নাকি পর্যায়ক্রমে পরবর্তী ধাপগুলোতেও এর প্রতিফলন ঘটবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আর পুরো পে স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ করতে হলে প্রক্রিয়াগত কারণেই আগামী জুনের আগে ভর্ধিত বেতন কার্যকর হবে বলে মনে হয়না।
লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।