বিশেষ কলাম

১৮০ বছরের জ্ঞানের প্রদীপ ও বটবৃক্ষ ঢাকা কলেজ

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ ঢাকা কলেজ এ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী একটি শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘নিজেকে জানো’ সক্রেটিসের এ মহান বাণীর মূলমন্ত্র ধারণ করে দীর্ঘ ১৮০ বছরের পথচলায় সময়ের সাথে শিক্ষার আলো বিতরণের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবেই দেশ বিদেশে পরিচিত দেড়শ বছরেরও বেশি পুরোনো এই বিদ্যাপীঠ। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কলেজটি হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শিক্ষা বিস্তারের মূল কেন্দ্রবিন্দু। শুধু ঢাকা নগরীই নয়, এই উপমহাদেশের জ্ঞান বিতরণের প্রদীপ ও প্রবীণ এক বৃক্ষের নাম ‘ঢাকা কলেজ’। ঢাকা কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নিজেকে সত্যিই ধন্য ও গৌরবান্বিত বোধ করছি।

বাঙালি নবজাগরণের উষালগ্নে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই সময় এই কলেজে আরবি, হিন্দুস্তানি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখানো হতো। এখানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রাধাকান্ত দেব ইংরেজি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগ নেন। এ উদ্দেশ্য ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে, বদ্দিনাথের বাসায় এ বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় পূর্ববর্তী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজ স্থাপনের পিছনে কিছু ঐতিহাসিক প্রয়োজন বিশেষভাবে কাজ করেছিল। কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থাকার সময় ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। এই আদালতে চাকরি বা আইনগত সুবিধা লাভের জন্য স্থানীয় বাঙালি হিন্দুরা ইংরেজি ভাষা শেখা শুরু করে এবং মূলত এ উদ্দেশ্যই ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এই কলেজটি উদ্বোধন হয়েছিল।

প্রথম দিকে, এই কলেজে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই পড়ার সুযোগ পেতেন। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটি কলেজ থাকা উচিৎ, এই বিবেচনায় সে সময়ের অনেক বুদ্ধিজীবী নতুন কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীতা অনুভব করেছিলেন। তবে কোনো নতুন কলেজ স্থাপনের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা দিতে তৎকালীন সরকার রাজি ছিল না। ফলে বিকল্প হিসাবে হিন্দু কলেজকেই সর্ব-সম্প্রদায়ের কলেজে পরিণত করার উদ্যোগ নেয় হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার গভর্নর লর্ড ডালহৌসির ইচ্ছানুসারে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুন থেকে হিন্দু কলেজকে প্রেসিডেন্সি কলেজে রুপান্তর করে কার্যক্রম শুরু হয় এবং সবশেষ ২০১০ সালে এটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও পূর্ব বাংলার হিন্দু মুসলমানদের জন্য কোন কলেজ তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইংরেজরা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হলে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং প্রকৃত পক্ষেই তারা এ অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয়। ইংরেজরা এসময় নিজেদের শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এ মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকেরা তাদের রাজত্বের অধিবাসীদের জন্য কোনো শিক্ষানীতি প্রনয়ণ বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিলো। অবশেষে ১৮৩০-এর দশকে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে এবং সে নীতিমালায় যে শিক্ষানীতির প্রচলন হয়েছিলো, তা মূলত পাশ্চাত্য বা ইংরেজি শিক্ষা নামে পরিচিতি পায়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতার জন্য একটি পেশাজীবি তৈরি করা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ আধুনিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সে সময়ে ঢাকাতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠলেও শিক্ষা প্রসারের চেয়ে ধর্ম প্রচার সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে উল্লেখ করার মতো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখানে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তী কালে, ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলো, যেখানে বলা হয়েছিলো: সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের নিকট এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হলে ঢাকার সেসময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার (Dr. James Tailer) জানান যে, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের আর্থিক এবং সামাজিক বিদ্যমান আছে। মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিলো ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।

এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতে একদিকে যেমন বদলে যেতে থাকে সমাজের সামগ্রিক চিত্র, তেমনি বিদ্যার্থীদের মানস সম্মুখে পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শনকে উন্মোচিত করে। শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার এ ইতিবাচক পরিবর্তনে সে সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কতগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ব্যয়ের কথা উল্লেখ এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা তার যথাযথ অনুমোদনসাপেক্ষে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়, যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলের নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। বলা বাহুল্য, এ কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির চিত্র। কলকাতার হিন্দু কলেজের মতো ঢাকা কলেজ হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। সে সময় কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত ব্যবস্থাপনার ভিত্তি। সে অর্থে আয়ারল্যান্ডই ঢাকা কলেজের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। তিনি কলেজের শিক্ষাদান ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা আধুনিক বাংলার ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তেমনি ঢাকা কলেজের জন্যও এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কেননা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয় এবং সে সময় থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলেও গুরুত্বের সঙ্গে এর কাঠামোগত বা অন্য পরিবর্তন সমূহের কথা ভাবা হয়নি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সে সময়ের সরকার মূলত কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে এর একটি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এমনকি এই কলেজে কোনো নতুন অধ্যাপকও নিয়োগ দেয়া হয়নি। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত অধ্যাপক ব্রেনান্ডকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয় এবং তিনি নিয়োগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে কলেজের উন্নতিকল্পে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেন। বলাবাহুল্য, ব্রেনান্ডকে পেয়ে ঢাকা কলেজ এক ক্রান্তিলগ্ন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ একটি বড় সম্মান লাভ করে: সেবছর থেকে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান ক্লাশ খোলা হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটা ছিলো একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন কেননা, এর মাধ্যমে পূর্ববাংলার তরুণদের মধ্যে আধুনিক যুগের হাতিয়ার, বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান ক্লাশগুলো খোলার পর ঢাকা কলেজে ছাত্র ভর্তির হিড়িক পড়ে যায়। একই সঙ্গে এ কলেজের অবকাঠামোগত পরিবর্তনও হয়। এরপরও নানা ঘাতপ্রতিঘাত থাকলেও, ঢাকা কলেজ শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলো, যার সোনালী ফসল ছিলো ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি।

শুরুতে কলেজটি পূর্বের স্থাপিত ঢাকা গর্ভনমেন্ট কলেজিয়েট স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত করে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তোলা হলেও অতি শিগগিরই এটির জন্য একটি পৃথক ভবন প্রয়োজন হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে কার্জন হল ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা কলেজ তার সর্বস্ব হারিয়ে ভবঘুরে মতো ঠাঁই নেয় পুরাতন হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে)। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র সেনারা হাইকোর্ট ভবন দখল করে তাঁবু হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবনে) কিছু দিন অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালায়। এর অল্পদিন পরেই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরচে ধরা পুরাতন দালানে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ তার আপন গৃহের সন্ধান পায়। স্থায়ী ঠিকানা হয় মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ঢাকা-১২০৫-এ। সে সময়ে ঢাকা কলেজের আয়তন ছিলো ২৪ একর। তবে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের সময় ছয় একর জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় ঢাকা কলেজকে। বর্তমানে ঢাকা কলেজের মোট জমির পরিমাণ ১৮ একর।

১৯৩৯-৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তথা শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিলো অগ্রভাগে। ১৮৪১ সালে পথচলা শুরুর পর ১৮৫৯-৬০ সালে কলেজের ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫২ জন। ১৯১৭-১৮ সালে তা ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। ২৪০ জন শিক্ষক এবং ১৯০ এর মতো কর্মচারী রয়েছেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজের পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে লাইব্রেরিতে সজ্জিত পাঠকক্ষসহ ৫০ হাজার বই রয়েছে। ঢাকা কলেজের ভিতরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ মায়াবী ও চোখ জুড়ানো ভালবাসায় ভরপুর। দক্ষিণে দেয়াল ঘেরা নিউমার্কেট, উত্তরে গভঃ ল্যাবরেটরী স্কুল, নায়েম ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও পশ্চিমে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (সাবেক বিডিআর) এর বিশাল পুকুর সত্যিই মনোমুগ্ধকর একটি জায়গা। সব মিলিয়ে ঢাকা কলেজ যেন রাজধানীর বুকে এক চিলতে ভালোবাসার পরশ দিয়ে কাছে ডেকে নেয়।

তবে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজে কোন ছাত্রাবাস ছিল না। এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্ররা তাই নানাবিধ কষ্টের মধ্যেই তাদের জীবন অতিবাহিত করে। যদিও ১৮৭৪ সালে ঢাকায় একটি ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে ১৮৮০ সালে ঢাকা কলেজের জন্য বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। এরপর হোস্টেলের ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ১৮৮৩-৮৪ সালে বোর্ডারের সংখ্যা ৯০-এ দাঁড়ায়। ১৯০৪ সালের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে বহু ছাত্র উপকৃত হন। হোস্টেলের নাম রাখা হয় সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেল রূপান্তরিত হয়ে হয় ঢাকা হলে, যা বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল, যা বর্তমানে সলিমুল্লাহ হল।

বর্তমানে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসের সংখ্যা ৮টি। ‘দক্ষিণ ছাত্রাবাসের’ ২০৬ নম্বর রুম। এ রুমে থেকেই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন দেশ বরেণ্য খ্যাতিমান লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের আরেক খ্যাতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যাত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ থেকে ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এ লেখকের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’। ‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে। এ ছাত্রাবাসে শুধু সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের বসতি। পাশেই রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। এ ছাত্রাবাস একটা বিশেষ কারণে বিখ্যাত। এ ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় ২০৯ নম্বর কক্ষেই শিক্ষা জীবন কাটিয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম। তাদের মতো ঢাকা কলেজের অনেক মেধাবী ছাত্র উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো দেশ বিদেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, প্রশাসন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ নানা পেশায় সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে এক অর্থে ঢাকা কলেজ মেধাবীদের তীর্থস্থান ও লালনক্ষেত্র এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশ বিদেশে একটি ব্রান্ড হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।

এক সময়কার ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ছাত্রনেতা উপহার দেওয়া একটি ব্র্যান্ড ছিল ‘ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ’। একে মিনি ডাকসু নামেও অভিহিত করা হয়। ১৮৪১ সালে ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের ছাত্রসংসদের রয়েছে একটি অনন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনেক উজ্জ্বল নেতা কিংবা প্রয়াত অনেক জাতীয় নেতা ঢাকা কলেজ থেকে তাদের সোনালী রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন।

সময়ের পরিক্রমায় প্রায় ১৮০ বছর অতিক্রম করেছে ঢাকা কলেজ। শিক্ষা বিস্তারের এ পাঠপ্রদীপ জ্ঞানের আলো বিতরণে অনন্য এক বটবৃক্ষ ও উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশ ও দেশের বাইরে আপন মহিমায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মেধাবীদের পছন্দের তালিকায় এখনো শীর্ষে ঢাকা কলেজ। দেশের কল্যাণে কাজ করছেন এখান থেকে শিক্ষা নেয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ কলেজের ছাত্ররা পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত ও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ‘নিজেকে জানো’ এ স্লোগানকে ধারণ করে শুধু ১৮০ বছর নয়, বরং শতশত বছর ঢাকা কলেজ তার গর্ব ও মহিমা নিয়ে বাংলাদেশের বুকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিক এ আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

[বিঃদ্রঃ লেখক ঢাকা কলেজের এইচএসসি ১৯৯৫ ব্যাচের ছাত্র এবং ঢাকা বোর্ডের মানবিক শাখা থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকারী]

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button