বিশেষ কলাম

অর্থনৈতিক উন্নয়নে টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা

মো. জিল্লুর রহমানঃ উন্নয়ন একটি বহুমুখী ও ব্যাপক প্রক্রিয়া। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। যে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত, সেই দেশের অর্থনীতিও তত উন্নত ও মজবুত। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভিত্তি হলো পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রভৃতি দিক থেকে বিচার করলেই দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে মূলত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বোঝায়। ইদানীং পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হয়। পরিবহন ব্যবস্থায় স্থল, জল এবং আকাশ পরিবহনকে বিবেচনা করা হয়। আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ডাক ও তার বিভাগ, টেলিফোন, বেতার, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ভূ-উপগ্রহ ইত্যাদি গণ্য করা হয়। বর্তমানে একটি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি নানা বিষয় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাজার ব্যবস্থার উন্নতি, মানুষের কর্মসংস্থান, সম্পদের সুষম বণ্টনে সহযোগিতা ইত্যাদি।

মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষিজাত দ্রব্যাদি, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে পরিবহনের যে সুবিধা হয় তাতে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসায়ের প্রসার ঘটে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। এ কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা কর যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও অংশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের মধ্যকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়েছে এবং বর্তমানে জল, স্থল ও আকাশপথে বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখনও দেশের সর্বত্র সব ধরনের পরিবহন ব্যবস্থার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। তবে অতীতকালে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার খুব দুর্বল ছিল। তখন পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নদী ও সড়?ক পথ এবং প্রধান যানবাহন ছিল নৌকা, গরুর ও ঘোড়ার গাড়ি। পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে চলাচল করতে হতো। নদী পথে চলাচল করা ছিল সহজ ও দ্রুত। অতীতে বেশিরভাগ সময় নদী পথ ব্যবহার করা হতো।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

দেশের বিভিন্ন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা যাত্রী বহন ও পণ্যসামগ্রী পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করছে। দেশের সড়?ক ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিনির্ভর গ্রামভিত্তিক এদেশের কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য দ্রুত স্থানান্তর এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগের উপায় সহজ হয়েছে। কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, বনজ সম্পদের সংগ্রহ, কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, যাতায়াত ও যোগাযোগের ইত্যাদি ক্ষেত্রে সড়ক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। পল্লি বাংলার উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন এবং তার জন্য উন্নত সড়ক যোগাযোগের বিশেষ অবদান রয়েছে। সাম্প্রতিককালে যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং যাত্রী সাধারণ ও মাল পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা বাড?ানো হচ্ছে। স্থলপথে পরিবহনের দ্বিতীয় প্রধান মাধ্যম হল রেলপথ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ও মালামাল রেলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। রেলপথে ঝুঁকি কম থাকায় এটি মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আকার আয়তনে বেশি এবং ভারী জিনিস পরিবহনে রেলপথের প্রাধান্য বেশি।

নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে প্রাচীন বাংলায় পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। যাতায়াত ও যোগাযোগের সুবিধা, স্বল্প ব্যয়ে যোগাযোগ, উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগ, দুর্যোগে মোকাবিলা, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে নৌ-যোগাযোগ নানা সমস্যা বিরাজমান থাকায় এর সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যাপারে তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। নদীপথ ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে দেশে নৌ-চলাচল বাধা-বিঘেœর সম্মুখীন হচ্ছে এবং এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।

দেশের বিমান যোগাযোগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিমানের মাধ্যমে অতি দ্রুত দূর-দূরান্তে গমনাগমন করা যায়। দ্রুত পণ্যসমাগ্রী পরিবহন সম্ভব। এতে সময়ের অপচয় খুব কম হয়। পচনশীল পণ্যাদি সহজে পরিবহন করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী দ্রুত প্রেরণের ক্ষেত্রে বিমান যোগাযোগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে বিমানের যোগাযোগ পর্যাপ্ত না হলেও পরিচালন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও যাত্রী সাধারণকে উন্নত সেবার ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত বিমান সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ বিমান প্রতিযোগিতা করে চলছে। তবে বাংলাদেশ পরিবহন ব্যবস্থায় আকাশপথে তেমন অগ্রগতি করতে পারেনি, তারপরও দেশের কিছু স্থানে বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়েছে। আকাশপথে খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ এতে চলাচল করতে পারে না।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শহর ও গ্রামে যানবাহনের পরিমাণ অতি-মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে সড়কপথে কোলাহল ও যানজট লেগেই থাকে। ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও সেতু বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সড়কপথে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সরকার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধক ছিল যমুনা নদী। এ নদীর ওপর যখন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হলো, পাল্টে যেতে শুরু করল অর্থনীতির গতিপথ। সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ নানাভাবেই লাভবান হয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্য ফিরেছে অনেকের। দেশের জন্য এ এক ইতিবাচক পরিবর্তন। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণব্যয়ও উঠে এসেছে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২৫ বছরে সেতুতে বিনিয়োগের টাকা তুলে আনার। কিন্তু সেই টাকা উঠে এসেছে সাত বছর আগেই; যা জাতীয় অর্থনীতির সুবাতাসকেই নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ হওয়ার কারণে এ ধরনের বড় সেতু নির্মাণে দুটি লাভ হয়। সেতু নির্মাণে যে বিনিয়োগ করা হয় তা দ্রুত উঠে আসে, সঙ্গে মুনাফাও। সেতুর সঙ্গে যুক্ত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হয়। বঙ্গবন্ধুর সেতুর মাধ্যমে যেটার বাস্তবায়ন ঘটেছে।

ঠিক একইভাবে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। চলমান কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ উন্নয়নের এ ধারায় আরও যুক্ত হচ্ছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ মেঘা প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে এবং এগুলো দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সবার গুরুত্ব সমপর্যায়ের না হলেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এগুলোকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থার সমন্বয় সাধনের মধ্যে নিহিত আছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। তবে প্রত্যেক দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় কিছু না কিছু সমস্যা থাকে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কয়েকটি কারণে বাংলাদেশ পরিবহন ব্যবস্থায় পিছিয়ে আছে। রাস্তা ঘাটের গুণগত মান, যানজট ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, নিয়ন্ত্রক প্রশাসকের ভুল পদক্ষেপ, ঘুষ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আইনের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি। উপরের সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা আরও উন্নত রূপ লাভ করবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই উন্নতি লাভ করেছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে যেকোনো জিনিস সহজে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে স্থানান্তর করা যায়। যন্ত্রচালিত যানবাহনের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক হ্রাস পেয়েছে। দেশের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় এবং ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে এবং বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যে গতিতে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে তাতে ধারণা করা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ উন্নত ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার দেশে পরিণত হবে এবং তা দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

মো. জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button