বিশেষ কলাম

ইসলামী ব্যাংকের উত্থান-পতন: সরকার কি পারবে এই বোঝা বইতে?

ফয়েজ আহমেদ তৈয়বঃ “কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক” স্লোগান নিয়ে ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারী ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামী ব্যাংক দেশে রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রসার ও দারিদ্র্য বিমোচন খাতে আর্থিক সেবার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক অর্থনৈতিক সাময়িকী দ্য ব্যাংকার ২০১২ সাল থেকে টানা নয় বছর ইসলামী ব্যাংককে বিশ্বের শীর্ষ ১ হাজার ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যা ব্যাংকটির জন্য বিশেষ গৌরবময় অর্জন।

ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এর ৭০ শতাংশ মূলধন জোগান দিয়েছিল, কিন্তু ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের পরে, বিদেশী শেয়ার ৩২ শতাংশে নেমে আসে। এগারোটি মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, আল-রাজি গ্রুপ, ইত্যাদি। জেপি মরগানের একজন ক্লায়েন্টও আইবিবিএল-এর শেয়ারের মালিক ছিলেন।

আরও দেখুন:
◾ব্যাংকিং খাত: ইসলামী ব্যাংকের আস্থা নষ্ট করাই আসল উদ্দেশ্য!

২০১৭ সালে সালে প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব থেকে ব্যাংকটিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে আইবিবিএল-এর মালিকানার পরিবর্তন শুরু হয়। সরকার সমর্থক সুশীল ব্যক্তিবর্গ, বুদ্ধিজীবী এবং কতিপয় মিডিয়া সেসময় এই পরিবর্তনটিকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিল। কয়েক মাস ধরে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ধাপে ধাপে পরিবর্তনের পর, ৫ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির বোর্ড সভায় চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক আমলা আরাস্তু খান-কে নিয়োগ করা হয়। তিনি ব্যাংকটির অন্যতম পরিচালক এবং চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক জায়ান্ট এস আলম গ্রুপের বিজনেস কনসার্ন আরমাদা স্পিনিং মিলসের প্রতিনিধি। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র পরিচালক বোর্ডে যোগ দেন। এদের অধিকাংশই এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি। ব্যাংকটি একই বোর্ড সভায় একজন নতুন ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়। সেসময় সরকারসহ মিডিয়া এই রদবদলকে একটি “শান্তিপূর্ণ” পরিবর্তন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের পরিকল্পনা জানার পরেই বিদেশী উদ্যোক্তরা ব্যাংকটি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতের কাছে একটি চিঠিতে, আইডিবি প্রেসিডেন্ট বন্দর এম এইচ হাজ্জার বলেছিলেন যে, ব্যাংকটিতে সৌদি আরব ও কুয়েতের বিনিয়োগকারীগণ এবং আইডিবির ৫২ শতাংশ শেয়ার থাকা সত্ত্বেও, তারা ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। জেপি মরগান-এর একজন ক্লায়েন্টও তার ৪.১৬ শতাংশ শেয়ার কমিয়ে ১.৬৮ শতাংশ করেছে। যদিও বিদেশী মালিকদের ব্যাংকের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোর উপর স্পষ্ট প্রভাব ছিল, তবে ব্যাংকের মূল মালিকরা “কোণ ঠাসা” হয়ে পড়ায় তারা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেয় তাদের শেয়ার।

ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইট অনুসারে, ব্যাংকটির ৩৯৪টি শাখা, ২২৮টি উপ-শাখা এবং ২৮০০টি এজেন্ট আউটলেট রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিসেম্বর ২০২১ অনুযায়ী) তালিকাভুক্ত ৩৩,৬৮৬ জন শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। ব্যাংকটির ১৬.২ মিলিয়ন আমানতকারী গ্রাহক এবং ১.৮ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতা/বিনিয়োগগ্রহীতা রয়েছে। ২০২১ সালের শেষে, ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা সোনালী ব্যাংকের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি, পূবালী ব্যাংকের তিনগুণ এবং বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত। রেমিট্যান্স সংগ্রহেও শীর্ষে ছিল ব্যাংকটি। ২০২১ সালে, এটি প্রবাসীদের পাঠানো প্রায় ৫০,৫১৮ কোটি টাকার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যেখানে প্রায় ৬৪,৫৩০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে এবং প্রায় ৩০,১৭৮ কোটি টাকার পণ্য ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি হয়েছে।

যাই হোক, মালিকানা পরিবর্তনের পর অব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ব্যাংকটি বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ে। এস আলম গ্রুপ কর্তৃক নিযুক্ত চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন এবং তহবিলের অভাবে ব্যাংকটি তার ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০২২ সালে, ব্যাংকটি দ্বিতীয় বারের মতো গভীর সংকটে পড়ে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা রিপোর্ট করেছে যে অক্টোবরে, ইসলামী ব্যাংক এক ব্যক্তিকে তার ট্রেডিং কোম্পানি স্থাপনের মাত্র এক মাসের মধ্যে এবং ঋণের জন্য আবেদন করার ১০ দিনের মধ্যে ৯ শত কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত ঋণ অনুমোদন এবং বিতরণের এরকম আরো উদাহরণ রয়েছে। কোন ক্ষেত্রে কোন জামানত বা ক্রেডিট রিপোর্ট প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে, ঋণখেলাপিদের দেওয়া তথ্য, যেমন জাল ঠিকানা, যোগাযোগ নম্বর ইত্যাদির মধ্যে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংক গত ছয় বছরে গড়ে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী এস আলম গ্রুপ একাই ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে ঋণ কার্যক্রম নিরীক্ষণের জন্য ইসলামী ব্যাংকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিল, কিন্তু ২০২০ সালে কোনো কারণ না দেখিয়ে পর্যবেক্ষক প্রত্যাহার করে নেয়। বিপুল অনিয়মের কথা জেনেও নীরব ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অভিযোগ রয়েছে, যেসব কোম্পানি আমদানি অর্থায়নের জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে তারা তহবিলের সামান্য অংশই ব্যয় করেছে আমদানিতে। যদি তাই হয়, তাহলে বাকি ঋণ গেল কোথায়? অস্বাভাবিক গ্রাহকদের জন্য অস্বাভাবিক পরিমাণে ঋণ, অস্বাভাবিকভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঋণ অনুমোদন এবং জামানতের জন্য অনিয়মিত মওকুফের মানে হলো এই ব্যাংকটিকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। হাইজ্যাক করেছে হয় মালিক পক্ষ নতুবা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীগণ। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে যে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে পুনরায় ব্যাংকটির মালিকানা নিতে যাচ্ছে। এই ধরনের অস্বাভাবিক ঋণ কার্যক্রম এই ধরনের গুজবের অগ্নিশিখায় পাখা দিয়ে বাতাস করার সামিল। এটি কি আরেকটি “শান্তিপূর্ণ” পরিবর্তনের সংকেত দেয়?

রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দখলকারীরা কি বুঝতে পারে না যে, ইসলামী ব্যাংকের আমানত সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টের জমানো অর্থ এবং কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদের আমানত নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীরবতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণে নামে টাকা লুটপাট করছে। প্রশ্ন হলো: ব্যাংকের দেড় কোটি আমানতকারীর কী হবে?

একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও ঋণ কার্যক্রম সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত গাইডলাইনের আওতায় কাজ করার কথা। বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত নেয় এবং ঋণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে, অর্থাৎ বিনিয়োগ করে। তাদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী তহবিল, মূলধন আমানত এবং দৈনিক আমানতে কিছু সিকিউরিটি সংরক্ষণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যাসেল-৩ নির্দেশিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংকের বাধ্যতামূলক মূলধন সংরক্ষণ নেই।

বর্তমানে ব্যাংকগুলো একক আমানতের বিপরীতে একাধিক ঋণ চক্র তৈরি করতে ভগ্নাংশীয় রিজার্ভ সিস্টেম ব্যবহার করছে, এইভাবে নতুন সম্পদ তৈরি হয়, কিন্তু ঋণ সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। ভগ্নাংশ রিজার্ভ সিস্টেম ব্যাংক ঋণের উপর বিনিয়োগের উপর নির্ভরতার উপর নির্ভর করে। প্রদত্ত ঋণ বিনিয়োগ সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে এই অনুমানে, সঞ্চয় হিসেবে একটি ক্ষুদ্র অংশ রেখে আবার নতুন ঋণ করা হয়। এই চক্রটি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাজ করে যে সেই বিনিয়োগ সম্পদ থেকে ঋণ সঠিকভাবে ফেরত দেওয়া হবে।

ভগ্নাংশ রিজার্ভ সিস্টেম কাজ করে যেখানে ব্যাংক ঋণ বাস্তব বিনিয়োগে রূপান্তরিত হয়, যার অর্থ কিস্তির পরিশোধ বজায় রাখা এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়। নতুন অর্থের সৃষ্টি মুদ্রাস্ফীতির দিকে পরিচালিত করে না। কিন্তু বাংলাদেশে তা কাজ করছে না, কারণ ঋণের টাকা বিনিয়োগ না করে পাচার হচ্ছে! অর্থ পাচার এবং ঋণ খেলাপির কারণে আমানত এবং ঋণ চক্রের মধ্যে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। অন্য কথায়, বাংলাদেশে ঋণকে বিনিয়োগে রূপান্তর করার কোনো নিয়ন্ত্রক বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এখানে ভগ্নাংশ রিজার্ভ সিস্টেম প্রয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ।

যদি কোনো ব্যাংকের ঋণ খেলাপি, লুটপাট এবং লন্ডারিং চলতে থাকে, যেমনটি বাংলাদেশে ঘটছে, তাহলে ব্যাংকটিকে, তাত্ত্বিকভাবে, দেউলিয়া হয়ে যাওয়া উচিত, যদি না এটিকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয় – অর্থাৎ, এটিকে জনগণের অর্থ দিয়ে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা হয়। অতীতে, ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এবং ফারমার্স ব্যাংক এভাবেই রক্ষা করা হয়েছিল। ইসলামী ব্যাংকও কি একই পথে এগোচ্ছে? ইসলামী ব্যাংকের ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার আমানতের এক চতুর্থাংশ যদি খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে বেলআউট ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। খোদ চলমান আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া সরকার মহাশয় কি এমন বোঝা বইতে পারবেন?

ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব টেকসই উন্নয়নের উপর নিয়মিত লিখছেন। এছাড়া তিনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ, এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫০ বছর বইটি লিখেছেন। (সোর্স- দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button