ইসলামী অর্থনীতি

বর্তমান ব্যবস্থার অসামঞ্জস্যের প্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থনীতির আবশ্যকতা

ড. কবির হাসান, মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইনঃ বিশেষায়িত জ্ঞানের শাখা হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির বয়স কম হলেও কয়েক দশকের মধ্যেই এটি এখন একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান, যার পূর্বপরিচিতি মূলত ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিগত পাঁচ-ছয় দশকে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদদের নিরলস পরিশ্রমে ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপক উত্কর্ষ সাধনের ফলেই এটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞানের স্বীকৃতি পায়। মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসামঞ্জস্যের পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলামী অর্থনীতির গুরুত্ব ও বিকাশ ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদের দীর্ঘস্থায়িত্ব কিছু ইতিবাচক অবদান রাখলেও পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য ও অসমতা দূরীকরণে অর্থনীতির এ মতবাদের ব্যর্থতা স্পষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান অর্থনৈতিক সংকট সেই ব্যর্থতারই প্রতিফলন। তবে শুরুর দিকে পুঁজিবাদ খ্রিস্টবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল বলে সময় সময় প্রয়োজনের আলোকে খ্রিস্ট এথিকসের ভিত্তিতে তার মধ্যে পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের সুযোগ ছিল, যাতে তার নেতিবাচক প্রভাব সংযত ও নিয়ন্ত্রিত থাকত। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে ধর্মবিদ্বেষকে ভিত্তি করে মুক্তবুদ্ধি (এনলাইটমেন্ট) আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার উত্থান হয়, যেটি নৈতিকতাকে (মরালিটি) উপেক্ষা করে যুক্তি (রিজনিং) নির্ভর কর্মতত্পরতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজেকে স্রষ্টার সমান্তরালে নিয়ে আসে, যা ছিল একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ।

তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের প্রভাবে অর্থনীতিতে বস্তুবাদ (ম্যাটেরিয়ালিজম), ভোগবাদ, ব্যক্তিবাদ ও স্বার্থপরতার মতো বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবক হয়ে উঠল। স্বাভাবিকভাবেই যার ফলাফল হলো অপ্রয়োজনীয় ভোগবাদিতা। এ চিন্তা প্রত্যক্ষভাবে একটি সামাজিক ডারউইনিজমের জন্ম দিল। যার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির পছন্দ (ন্যাচারাল সিলেকশন) ও শক্তিমানদের বেঁচে থাকার মন্ত্র (সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট)। পুঁজিবাদও এ তত্ত্ব প্রমাণ করতে চায় যে অর্থনীতিতেও শুধু শক্তিমান বা যোগ্যরাই টিকে থাকবে; দুর্বল, অসহায় ও দরিদ্রদের অবস্থান এখানে খুবই সীমিত বা সংকীর্ণ। এবং পুঁজিবাদী নীতি নিজেকে ফিজিক্যাল লর সমকক্ষ হিসেবে আবির্ভূত করল, প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে যেভাবে সূর্য, পৃথিবী, নদ-নদী, বায়ুপ্রবাহ বা সমুদ্রের গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়, ঠিক একইভাবে প্রাকৃতিক নিয়মেই পুঁজিবাদ নিজেকে চলমান রাখবে। অথচ এটি একেবারেই একটি অযৌক্তিক ধারণা, কারণ অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রই হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনা। বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় অথচ সোলার সিস্টেম বা সৌরজগতের নিয়ম-নীতিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। পুঁজিবাদের অসারতা প্রমাণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির আরো একটি অসারতা হলো শুধু স্বার্থপরতাকেই উৎস বিবেচনা করা। যার কৌশলগত পরিভাষা ‘যৌক্তিক অর্থনৈতিক কর্তা’ (র্যাশনাল ইকোনমিক ম্যান) হিসেবে মানুষকে দাঁড় করানো। মূলত অর্থনীতির এ কৌশলের মাধ্যমে মানুষের চরম স্বার্থপরতাকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। যেটির মূল বক্তব্যই হলো মানুষ স্বার্থের জন্যই কাজ করে। এটি বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। যদি স্বার্থপরতাই অর্থনীতির বা অন্যান্য নীতির অন্যতম মূলনীতি হতো, তাহলে জগতে পরিবার বা সমাজের জন্য অহরহ ত্যাগের উদাহরণ খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

ইতিবাচকতার (পজিটিভিজম) নাম করে ‘মূল্যবোধহীনতা’ পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার আরেকটি অন্যতম হাতিয়ার। পুঁজিবাদের দৃষ্টিতে অর্থনীতিতে মূল্যবোধ সংযোগ মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটলে তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে বিজ্ঞানহীন হয়ে পড়বে। তাহলে প্রশ্ন তৈরি হয় দারিদ্র্য দূরীকরণে কেন নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় অথচ সেসব কোনো না কোনোভাবে মূল্যবোধের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

পুঁজিবাদ বাজার ব্যবস্থার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শুধু এ ব্যবস্থাই শতভাগ সফল এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। কারণ শুধু বাজার ব্যবস্থায় সম্পদের পরিপূর্ণ সুষ্ঠু বণ্টনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা প্রতীয়মান হয়। অর্থ সংকটের কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জনগণের বড় একটি অংশ চাইলেই বাজার থেকে তার চাহিদামতো পণ্য কেনার সাধ্য রাখে না। এমনকি দুধ ও ওষুধের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বাজার কারো কারো জন্য অনেক সংকুচিত। কিন্তু যারা স্বাবলম্বী তারা চাইলেই প্রয়োজনাতিরিক্ত শৌখিন জিনিসপত্র কিনতে পারে অথচ অন্যদিকে অনেকের বেঁচে থাকার পণ্য ক্রয়ের সাধ্য নেই। ফলে প্রকৃত চাহিদা বাজারে প্রবেশ করতে না পারার কারণে অগ্রাধিকার নীতি নষ্ট হয়ে যায়। স্বাবলম্বীদের চাহিদামতো বাজারে শৌখিন পণ্যের মাত্রাতিরিক্ত পসরা থাকলেও বাজার বৈষম্যের কারণে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ তুলনামূলক অনেক কম পরিলক্ষিত হয় অথচ ইসলামী অর্থনীতি এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম।

ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতিই হলো তাওহিদ, খিলাফাহ ও ন্যায়বিচার। তাওহিদ সব মানুষকে এক স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে তাদের গুরুত্ব ও তাত্পর্যকে সমুন্নত করে, খিলাফাহ মানুষকে পাশ্চাত্যের ‘জন্মগত অপরাধী’র তকমা থেকে বের করে মানুষ হিসেবে তাদের পরিপূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে। এ দৃষ্টিভঙ্গি জমিনের সব নারী-পুরুষকে ভাই-বোন হিসেবে সমতার অধিকার নিশ্চিত করে। এক্ষেত্রে যাবতীয় সম্পদের মালিকানা আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ ও মানুষকে সেসবের আমানতদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এখানে সম্পদের বণ্টন ‘শক্তিমানদের বেঁচে থাকা’ তত্ত্বের ভিত্তিতে নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে হয়ে থাকে। ন্যায়বিচারের আলোকে ইসলাম সবার জন্য সম্মানজনক সম্পদ অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়। সে আলোকে সবার কাছে সম্পদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করার জন্য ইসলাম তার কৌশল নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে শারীরিক বা অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতার কারণে যারা সম্পদ অর্জনে অক্ষম তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য ইসলাম পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বভার অর্পণ করে।

ইসলামী অর্থনীতির প্রাসঙ্গিকতা ও কাঠামো
আধুনিক ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার ধারণা এই নয় যে ১৪০০ বছর আগে মুসলিমদের মাঝে যেসব নিয়ম ছিল সেসব নিয়মকে হুবহু অন্তর্ভুক্ত করা, যেটি একটি অমূলক ধারণা। মূলত অর্থনৈতিক লেনদেনে ইসলামের নির্দিষ্ট মূলনীতি ও মূল্যবোধকে সংযোজনের সমন্বয়ে এ ব্যবস্থার পরিচালনা করাকে আধুনিক ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা বলা হয়। এসব মূলনীতির আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো একই সমস্যাকে নিজ দেশের পরিস্থিতি (কনটেক্সট) ও প্রয়োজনের (ডিমান্ড) আলোকে ভিন্ন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করার সুযোগ রাখে। আর এ বৈচিত্র্যই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতাকে আরো বেশি সুসংহত করে। যার কারণে এটি আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি, প্রযুক্তি বিদ্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কোনো কিছুকেই সাংঘর্ষিক নয় বরং পরিপূরক মনে করে থাকে। কারণ সময় ও পরিস্থিতির আলোকে কৌশল ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি ভিন্ন রকম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুতরাং এসব পদ্ধতি যদি মৌলিকভাবে ক্ষতির কারণ না হয়, তাহলে যেকোনো আদর্শের জন্যই তা পরিপূরক হতে পারে।

আরও দেখুন:
ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস
ইসলামী ব্যাংকিং কি এবং কেন?

অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতির মানবিক লক্ষ্যগুলোও এ ব্যবস্থাটিকে ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। সার্বিক অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা (কুরআন: নাহল ৯০), নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ (কুরআন: কাসাস ৫-৯), অর্থনৈতিক সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উত্খাত (কুরআন: হজ ৪১), জনগণের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতকরণ (কুরআন: আরাফ ১৫৭), সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার ও যথাযথ বণ্টনের (কুরআন: হাশর ৭) মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সার্বিক প্রতিষ্ঠা করাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার তুলনায় এটি অনেকাংশে বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম একটি মূল্যবোধভিত্তিক স্বাধীন অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, যাতে উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা থাকবে, শ্রমিক অধিকারের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হবে এবং বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হবে অংশীদারিত্বের (মুদারাবা ও মুশারাকা) ভিত্তিতে। অভাবগ্রস্তদের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি জাকাতসহ অন্যান্য সম্পদকে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথাযোগ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ইসলাম তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায় বিধায় এটি মাইক্রো (ছোট পরিসর) ও ম্যাক্রো (বৃহৎ পরিসর) অর্থনৈতিক ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে।

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় ইসলামী অর্থনীতির বাজার অনেক বেশি বিস্তৃত ও সুবিশাল। ইসলামী অর্থনীতিতে শুরু থেকেই বাজার ব্যবস্থা উন্মুক্ত থাকলেও সেখানে হালাল-হারামের নীতিগুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করা হতো। এদিক থেকে ইসলামের বাজার ব্যবস্থাকে স্বাধীন বাজার ব্যবস্থা বলা যায়। তবে মুক্তবাজারের নামে শ্রমিকরা যাতে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য ইসলাম শ্রমিকের অধিকারকে স্পষ্টভাবেই নিশ্চিত করে। সুতরাং ইসলামের স্বাধীন বাজার ব্যবস্থার অর্থ এই নয় যে ইসলামী শরিয়ার বাইরে গিয়ে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণ করা; বরং উৎপাদক ও শ্রমিকের ভারসাম্যপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইসলামী শরিয়ার মূল্যবোধকে সামনে রেখে যে বাজার ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ইসলাম সেটিকেই প্রকৃত স্বাধীন বাজার ব্যবস্থা বলে স্বীকৃতি দেয়।

তবে আধুনিক ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ কাঠামো অনুধাবন করার জন্য খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ব্যাপারে ধারণা রাখা খুব জরুরি। মূলত মদিনায় পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার একটা প্রায়োগিক কাঠামোর গোড়াপত্তন হয়। সময় ও চাহিদার পরিক্রমায় খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে এসে এটি পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আরো পূর্ণতা লাভ করে। যে কাঠামোয় নাগরিক হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম সবার স্বাধীন বাণিজ্য অধিকারসহ কৃষি ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হওয়ার অবাধ সুযোগ ছিল। মূলত সে ব্যবস্থায় স্বাধীন জোগান ও চাহিদা ছিল এবং এ দুয়ের ওপর নির্ভর করেই মূল্য নির্ধারিত হতো। জোগান ও চাহিদায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করা নিষিদ্ধ ছিল বলে ফাটকাবাজি বা কৃত্রিম মূল্য নির্ধারণের কোনো সুযোগ সেখানে ছিল না। তাই আধুনিক ইসলামী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন জোগান ও চাহিদায় কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে যদি অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করার আশঙ্কা থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে বাজার কর্তৃপক্ষ সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।

মূলত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে নৈতিক স্বাধীনতা দিলেও পুঁজিবাদের মতো লাগামহীন করে দেয় না। বরং উপার্জন, ব্যয়, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাদিতে ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু কাঠামো অনুসরণ করেই তাকে সে স্বাধীনতা ভোগ করতে হয়। ব্যক্তিমালিকানা, পরিপূর্ণ বাণিজ্যনির্ভর সুদমুক্ত অর্থনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অধিকার নীতি যেমন শ্রমিক অধিকার ও তাদের স্বাধীন কর্ম পছন্দের অধিকর নিশ্চিতকরণ এবং ওশর, খারাজ, জাকাত ও বাণিজ্য শুল্ককে অর্থনীতির কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার আলোকেই প্রাথমিক যুগের অর্থনীতি পরিচালিত হতো। পাশাপাশি এসবের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য ‘হিসবা’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণেরও উদাহরণ পাওয়া যায়। সুতরাং ইনসাফ ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থে মদিনা ও খোলাফায়ে রাশেদিনের মডেলের আদলেই ইসলামী অর্থনীতির উত্কর্ষের বলয় গড়ে তুলতে হবে। কারণ কুরআন ও হাদিসের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে তারাই সবচেয়ে বেশি উপযোগী ও কাছাকাছি।

ইসলামী অর্থনীতির প্রায়োগিক নীতি, মাধ্যম ও চ্যালেঞ্জ
দারিদ্র্য বিমোচন ইসলামী অর্থনীতির মূল প্রয়োগক্ষেত্র। দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম নানাবিধ বৈধ লেনদেন, কৃষি অর্থনীতি, জাকাত ও আওকাফের মতো টুলসকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়। বহুবিধ ব্যবস্থাপনার কারণে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট দারিদ্র্য বা দুর্ভিক্ষ ছাড়া তেমন কোনো দারিদ্র্য পরিলক্ষিত হয় না। বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও দারিদ্র্য দেখা দিলেও সেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে রাজস্ব দিয়ে তা বিমোচন করা হতো। দারিদ্র্যের হার অনেক কম থাকার কারণে মানুষ প্রচুর বিত্তবৈভবের অধিকারী ছিল, এমনকি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে যায়, একপর্যায়ে জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ সেই সময়ে আগ্রাসী দারিদ্র্য দূরীকরণে জাকাতভিত্তিক সফলতার হার ছিল প্রায় শতভাগ। অন্যদিকে ওয়াকফও ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিশেষ করে উমাইয়া শাসন থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদ উত্থানের আগ পর্যন্ত দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি, জনকল্যাণ ও শিক্ষা সম্প্রসারণে ওয়াকফ ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

বর্তমানে দেশী ও বিদেশী এনজিওগুলোর সুদভিত্তিক ঋণের বিপরীতে জাকাত নিঃসন্দেহে একটি টেকসই বিকল্প। এনজিওগুলোর দেয়া শর্তসাপেক্ষ সুদভিত্তিক ঋণ টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে অক্ষম। কারণ একদিকে ঋণ ফেরতের ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকিকে আরো প্রসারিত করে, অন্যদিকে শর্তহীন দান হওয়ার কারণে গ্রহীতার কাছ থেকে জাকাতদাতার কোনো বিনিময় প্রাপ্তির সুযোগ নেই, উল্টো বিশেষজ্ঞরা বলেন জাকাতদাতাকে এ পরিমাণ জাকাত আদায় করা উচিত যাতে জাকাতগ্রহীতা পরবর্তী সময়ে আবার জাকাত গ্রহণ করার প্রয়োজন না হয়ে বরং কোনো এক পর্যায়ে সে নিজেই জাকাত দান করার সক্ষমতা অর্জন করে। সেক্ষেত্রে দারিদ্র্য দূরীকরণে এনজিওগুলোর সদিচ্ছা থাকলে শর্তহীন অর্থ স্থানান্তর বা সুদমুক্ত ঋণ ব্যবস্থা চালু করার কোনো বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সহনীয় মাত্রার সেবা ফি বা সার্ভিস চার্জ আদায় করা যেতে পারে।

মূলত হাজার বছরের মুসলিম শাসন পতনের পর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপক পিছিয়ে পড়ল, অধিকৃত মুসলিম দেশগুলোয় দখলদাররা মদের ব্যবসা ও সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার প্রসারসহ নানাবিধ অবৈধ লেনদেনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করল। অর্থনীতিতে নতুন সংয়োজন হিসেবে সেখানে তারা সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাও চালু করল। যার নেতিবাচক প্রভাবে ইসলামী অর্থনীতির ধারণা অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল। পরবর্তী সময়ে অনেকগুলো মুসলিম দেশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে সেসব দেশে আবার ইসলামী জাগরণের প্রসার ঘটে। সেসব দেশে অন্যান্য ইসলামী আইনের পাশাপাশি ইসলামী অর্থনৈতিক আইনের ধারাও সংযুক্ত হয় এবং পর্যায়ক্রমে ইসলামী ব্যাংকিংয়েরও প্রবর্তন হয়। বিশ্বব্যাপী তিন শতাধিক ইসলামী ব্যাংক ও তাদের অসংখ্য শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং এক যুগোপযোগী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে নিরলস কাজ শুরু করে। সেসব লক্ষ্যের মধ্যে পূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়। তবে সেটি অর্জন করতে হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ সামনে রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থনীতি, শহুরে বৃহত্ ও ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা করাসহ আত্মকর্মসংস্থানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ন্যায়বিচার, প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা যেতে পারে।

এ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইসলামী জ্ঞানের দুর্বলতা। ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সাবলীলভাবে তুলে ধরতে না পারার কারণে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ইসলাম ভীতি কাজ করে প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে ইসলামের প্রায়োগিক প্রয়োজনকে তাদের কাছে সাবলীলভাবে তুলে ধরার কোনো বিকল্প নেই। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার অনীহা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তবে সেক্ষেত্রে মুসলিমদের সম্পদে পরিণত হওয়াই একমাত্র বিকল্প হতে পারে, যাতে পাশ্চাত্য সভ্যতা তাদের প্রতি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারে। উপরোল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথভাবে কাটিয়ে উঠে নিজেদের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করে সব ধরনের বাহুল্য চিন্তা পরিহার করতে পারলে নিশ্চয়ই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ক্রমাগত শক্তিশালী হতে থাকবে।

সুদ অর্থনীতির মেরুদণ্ড বিনাশকারী
ইসলামী সমাজ বা অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুদ একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সেজন্যই আল্লাহ তায়ালা সুদকে পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছেন (কুরআন: বাকারা ২৭৮-২৭৯; ইমরান ১৩০)। তারই আলোকে রাসুল (সা.), খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এবং অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসনামলে সুদবিহীন শক্তিশালী ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ অর্জন করুক বা না করুক যেকোনো অবস্থাতেই নির্দিষ্ট হারে ঋণদাতাকে সুদ আদায় করতে হয়, যা মূলত জুলুমকেই প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানতকারীদের সুদ গ্রহণ নিয়ে ধূম্রজাল থাকলেও মূলত ব্যাংক আমানতকারীর আমানতকে অন্যত্র অতিরিক্ত মোটা সুদে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে সুদের একটা অংশ আমানতকারীকে দিয়ে থাকে, ‍সুতরাং এখানেও একই জুলুম বিরাজমান। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতা কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান যদি ঋণ প্রদানে অক্ষম হয় তখন ঋণগ্রহীতার শিল্প বা বন্ধক দেয়া সম্পত্তির ওপর ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে, ফলে স্তরে স্তরে অর্থনৈতিক লোকসানসহ নানা ধরনের সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সুদভিত্তিক অর্থ ব্যববস্থার অন্যতম গুরুতর সমস্যা। উত্পাদক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক নিয়মে যৌক্তিক লভ্যাংশ সংযুক্ত করে পণ্য বাজারজাত করলে সেটা ক্রয় করা গ্রাহকের জন্য অনেক সময় সহনীয় পর্যায়ে থাকে, তবে সুদভিত্তিক ঋণ নিয়ে পণ্য উত্পাদন করলে সেখানে সুদের হার সংযুক্ত করে লভ্যাংশ নির্ধারণ হয় বলে স্বাভাবিক নিয়মেই দ্রব্য‍মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাতে অনেকের পক্ষেই প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায় পরিশ্রম ব্যতিরেকেই সমাজে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর কাছে প্রচুর পরিমাণে অর্থ জমা হতে থাকে। এতে বাজারে ব্যবসাবান্ধব পুঁজির সংকট তৈরি হয়। কোনো রকম পরিশ্রম ব্যতিরেকেই এক শ্রেণীর মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়, অন্যদিকে ঋণগ্রহীতা দরিদ্র শ্রেণী শুধু রক্ত নিঃসৃত ও ঘর্মাক্ত পরিশ্রমই করে যায়, যেটি সমাজে ধনী ও দরিদ্রদের মাঝে মোটা দাগের বৈষম্য তৈরি করে। এছাড়া ফাটকাবাজারি ও বিনিয়োগ পরবর্তী পুঁজি সংরক্ষণে ঋণগ্রহীতার প্রতি সুদভিত্তিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রকম দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে না, যা পুরোপুরি ইসলামী অর্থনীতির বিপরীত।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার আলোকে সামাজিক নিরাপত্তা
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অর্থনৈতিক মুক্তি বা নিরাপত্তা অন্যতম প্রধান বিষয়। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ইসলাম তিন ধাপে দায়িত্ব বণ্টন করে। প্রাথমিক ধাপে ব্যক্তি নিজে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, দ্বিতীয়ত সামাজিক পদক্ষেপের আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও তৃতীয় ধাপে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

সামাজিক নিরাপত্তায় অর্থনৈতিক মাধ্যম হিসেবে প্রথমে বাধ্যতামূলক দান হিসেবে জাকাতের বিষয়টি আসে। কুরআনের বর্ণিত (কুরআন: তাওবাহ ৬০) জাকাতের খাতগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব খাতের সিংহভাগ খাতে দুর্বলতার কারণে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। আবার সেসব খাত স্থিতিশীল থাকলে সামাজিক নিরাপত্তাও অনেকাংশে স্থিতিশীল থাকে। বিশেষ করে জাকাতের উত্পাদনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিপূর্ণভাবে সামগ্রিক অভাব দূর করে তাদের যথাযথ পুনর্বাসন করা সম্ভব। একটি সর্বনিম্ন হারের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা যায় শুধু বাংলাদেশেই প্রতি বছর বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ৫,২৫০ কোটি টাকার জাকাত আহরণ হতে পারে, যা দিয়ে মাত্র কয়েক বছরেই দেশ থেকে আগ্রাসী দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। জাকাতের মাধ্যমে সঠিকভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সময়ের দাবি। একই সঙ্গে এ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করাও জরুরি।

ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে বায়তুল মাল। কোনো কারণে জাকাত ও সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে যদি দারিদ্র্যের পরিপূর্ণ বিলুপ্তি না ঘটে, তাহলে বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য পরিস্থিতির আলোকে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে আধুনিক অর্থ ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, ইসলামী ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থাপনার ব্যাপক সম্প্রসারণও অপরিহার্য।

অন্যদিকে ওশর বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ফসলের জাকাত ফরজ হলেও বাংলাদেশের মতো ওশর আদায়ে সম্ভাবনাময়ী দেশে এর আদায়ের গুরুত্ব, প্রশিক্ষণ, জ্ঞান বা সচেতনতা কোনো কিছুই না থাকার কারণে অর্থনীতির বিশাল একটি ক্ষেত্র থেকে দেশ ও দরিদ্র মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছে। ওশরের যথাযথ আদায় ও যুগোপযোগী ব্যবহার করতে পারলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এ খাত ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। ওশরের সর্বনিম্ন হার যথা ৫ শতাংশ ধরেও যদি ওশর আহরণ করা হয়, তাহলেও বাংলাদেশে একেকটি ফসল মৌমুমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ওশর আহরণ সম্ভব, যদিও ১০ শতাংশ হার হিসাব করলে এর পরিমাণ আরো অনেক গুণ বাড়বে। তবে ওশরের পাশাপাশি খারাজও দারিদ্র্য বিমোচনে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।

ইসলামী অর্থনীতিতে ঐচ্ছিক দান হিসেবে ওয়াকফের ভূমিকা যুগ যুগ থেকেই প্রমাণিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ খাতের মাধ্যমে পর্যটন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ইয়াতিম লালন-পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মূলধারার অর্থনীতির জোগানদাতার ভূমিকা পালন করত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ঔপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রায় ১০-১৫ শতাংশ ভূখণ্ড ওয়াকফ সম্পত্তির অধীনে ছিল। বাংলাদেশেও একসময় ওয়াকফের চর্চা থাকলেও নতুন করে উল্লেখযোগ্য হারে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান বা সম্পত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাংলাদেশে অনেক স্বাবলম্বী মানুষ আছে যারা বিলিয়নোর্ধ্ব টাকার পরিমাণ সম্পদের মালিক। এদের মাধ্যমে দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে অকল্পনীয় হারে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন হওয়া একেবারেই সম্ভাব্য একটি বিষয়। ব্যক্তিগত ও সরকারি তত্ত্বাবধানে পর্যটন সুবিধা গড়ে তোলা, অসহায়দের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, নানামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বয়স্ক নিবাস ও বিধবা পুনর্বাসনসহ ওয়াকফের মাধ্যমে বহুমাত্রিক পদক্ষেপের সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করা যায়। যদিও এরই মধ্যে ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ওয়াকফের নতুন সংযোজন ‘ক্যাশ ওয়াকফ’-এর কিছু প্রচলন লক্ষ করা যাচ্ছে।

তবে এরই মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলোকে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক আশা জাগানিয়া অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সুদভিত্তিক লেনদেনের এত বেশি প্রচলন ও প্রভাব ছিল যে একসময় বাংলাদেশের জনগণ সুদমুক্ত অর্থ ব্যবস্থা আছে বা থাকতে পারে সেটি কল্পনাও করতে পারত না। আশির দশকের আগ পর্যন্ত যারা ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকার করত না, ধীরে ধীরে তাদের মন ও মননে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করল, তারা তাদের বদ্ধমূল ধারণা থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার দৃশ্যমান সফলতা অবলোকন করার পর সেটিকে স্বীকার করা শুরু করল। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্ব ও বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্র ইসলামী অর্থনীতিকে স্বীকার করে তার প্রসারে ভূমিকা রাখা শুরু করল, যার কারণে সেসব অমুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার জনপ্রিয় প্রচলন লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, চীন, বাহামা, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। বাণিজ্যিক অর্থায়ন, শিল্প অর্থায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পসহ বহুমুখী বিনিয়োগ সফলতা ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার নানাবিধ পরিভাষার সঙ্গে অভিজাত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকরা পর্যন্ত পরিচিত হচ্ছে, যেটিকে খুবই আশাব্যঞ্জক বলা যায়। মূলত সম্পদের পূর্ণ মালিকানা আল্লাহর—এটিই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি। আর সেসব সম্পদ ব্যবহার হবে সব মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য। তাই মনুষ্যসৃষ্ট জুলুম, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বকে সামগ্রিকভাবে দূর করে আর্থসামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্পে সুদকে কঠোরভাবে দমন করার লক্ষ্যে লাভ-লোকসান ও অন্যান্য অনুমোদিত বিনিয়োগ ও চুক্তির আলোকে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার
তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমান্তরাল অবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বৈদেশিক মুদ্রানির্ভর আগাম চুক্তির বাণিজ্যগুলো। যেহেতু প্রধান সারির আন্তর্জাতিক মুদ্রাগুলোর কোনোটিরই মান নির্দিষ্ট নয়, সেহেতু আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে শক্তিশালী মুদ্রার প্রচলন বলে রফতানি ও আমদানীকৃত পণ্য হাতে পৌঁছতে যে সময় লাগে, সে সময়ের মধ্যে মুদ্রার মান ব্যাপক ওঠানামা করে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আগাম বুকিংয়ের প্রয়োজন হয়, কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শরিয়া অনুমোদন না থাকায় সে আগাম চুক্তির মাধ্যমে মুদ্রার মানের তারতম্যের ঝুঁকি এড়াতে পারে না। ইনল্যান্ড বিল বা ফরেন পারচেজও ইসলামী ব্যাংকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলমান সমস্যা।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা এখনো স্কলাররা দাঁড় করাতে পারেননি বলে অনেকের মধ্যেই এখনো এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল পরিলক্ষিত হয়। তাই বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক বিস্তার সত্ত্বেও এখনো তাদের মধ্যে এটির ধারণা পরিচ্ছন্ন নয়। অনেকেই গতানুগতিক ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মধ্যে প্রার্থক্য বুঝতে পারে না। সুতরাং এ অজ্ঞতা ইসলামী ব্যাংকের পণ্য বা চুক্তিগুলোকে নতুন গ্রাহকদের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকের অপ্রত্যাশিত উত্তোলন, প্রত্যাহার বা অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজনে তারল্য আহরণ করার জন্য সুদমুক্ত কোনো মাধ্যম বা পুঁজিবাজারের মতো তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আবার স্বাতন্ত্র্যিক ইসলামী বাজার ব্যবস্থা না থাকার কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সুবিশাল উদ্বৃত্ত তহবিল বিনিয়োগ না করতে পারার কারণে এ বিশাল তহবিল অলস টাকা হিসেবে উত্পাদনহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। একইভাবে সুদমুক্ত বন্ড বাজার না থাকাও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার অগ্রগতিতে বড় প্রতিবন্ধকতা।

বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যাংকিং আইনে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা হয়। যার কারণে ইসলামী ব্যাংকিং নীতি ভিন্ন হলেও তার বিকাশ, আইন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও মনোভাব সবকিছুই অভিন্ন পরিবেশে চর্চা হয়ে আসছে। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও মূলত দেওয়ানি আইনের দ্বারস্থ হতে হয় অথচ দেখা যায় সেসব আইন বা আইনজ্ঞ কোনো কিছুই ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মেজাজ ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত নয়। যা ইসলামী ব্যাংকের নিরঙ্কুশ পথচলাকে ব্যাহত করে। অন্যদিকে তহবিল জোগান ও সেসবের যথাযথ বিনিয়োগ ক্ষেত্র তৈরি বা খুঁজে বের করাও অনেকটা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তারল্য ব্যবস্থাপনা সংকটও ইসলামী ব্যাংকগুলোয় বেশ প্রকট। তারল্য ঘাটতি ও অতিরিক্ত তারল্য প্রয়োজনীয়তা সামাল দেয়ার জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোয় লিকুইডিটি ইনস্ট্রুমেন্টের ঘাটতিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি প্রচলিত বলে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না।

অন্যদিকে গবেষণা ও উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার ঘাটতিও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার পথচলায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোয় এখনো ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ পেশাদার ব্যবস্থাপক এবং ব্যাংকারের অপ্রতুলতা বিদ্যমান। এখানে বেশির ভাগই প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেই অভ্যস্ত বলে এসব জনবল নিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য গ্রাহকদের মধ্য থেকে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ব্যাংকগুলোর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার স্বল্পতা, বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যথাযথ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ব্যর্থতার মতো চ্যালেঞ্জগুলোও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা। সুতরাং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ খাতের পেশাদারদের শিল্প, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আরো গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই।

টেকসই অর্থনীতি নিশ্চিতকরণে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতা
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রায়োগিক ভিত্তি মূলত অংশীদারিত্বভিত্তিক। যার কারণে নানা ধরনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও এ ব্যবস্থা তার কার্যক্রমে টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। ১৯৩০ সালের মতো অর্থনৈতিক মন্দা ব্যাংকগুলোকে অচল না করলেও বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমাহীন অর্থ সংকটে পতিত করেছে। আইএমএফের তথ্যমতে, তার সদস্য দেশগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নানাভাবে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশও সময়ে সময়ে মারাত্মক মুদ্রা ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধসে পড়ে অসহনীয় বেকারত্ব সৃষ্টি করে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া ও লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলো দীর্ঘ সময় থেকেই সীমাহীন মুদ্রাস্ফীতিতে পতিত হয়ে আছে। মূলত সামগ্রিকভাবে দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ, অস্বচ্ছতা, জালিয়াতি এবং যথাযথ ব্যাংকিং তদারকির অভাবে এসব আর্থিক সংকট তৈরি হয়। যার কারণে পরমর্শকরা সংকট উত্তরণের জন্য মুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে নমনীয় বিনিময় অনুসরণ করা, বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবাহকে আরো ঘনিষ্ঠ তদারকি ও ব্যবহার ঝুঁকি কমানোসহ আর্থিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের নির্দেশ দেন।

তবে ইসলামী ব্যাংকিং অবকাঠামোয় যেকোনো কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার মানদণ্ডকে মৌলিক উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া উল্লেখিত সমস্যা সামনে রেখে বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অধিকতর কল্যাণকর। উন্নত ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধানের দিক থেকে ইসলামী ব্যাংকিং একটি শ্রেষ্ঠ নমুনা হিসেবে স্বীকার করে লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট দাবি করেছে, ‘পাশ্চাত্য আধুনিক যুগেও ইসলামের কাছ থেকে ইকুইটি বা অংশীদারিত্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিতে পারে’ (দি ইকোনমিস্ট, আগস্ট ১৯৯৪, ষষ্ঠ সংখ্যা)। মূলত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেকোনো বিনিয়োগের ব্যাপারে খুঁটিনাটি তত্ত্বাবধান থাকে বলে মন্দ বিনিয়োগের সম্ভাবনা অনেকাংশেই হ্রাস পায়। কারণ অংশীদারীত্বের দায়বদ্ধতার কারণে ব্যাংক বিনিয়োগের সর্বশেষ ক্ষেত্র ও সেখান ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লভ্যাংশ অর্জন পর্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পুরো বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। অন্যদিকে অংশীদারিত্বের জবাবদিহিতার কারণে বিদেশী তহবিলের ও যেকোনো সময় সেখান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনুমান (স্পেকুলেশন) কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারণ অনুমাননির্ভর বিনিয়োগ অনেকটা জুয়ার মতো, যেটি ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই যেকোনো অনুমাননির্ভর ব্যবস্থা বা বিনিয়োগকে ইসলাম নিরুত্সাহিত করে বলে এ ব্যবস্থার আলোকে পরিচালিত বিনিয়োগ বা ব্যবসা আনুপাতিক হারে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চেয়ে বেশি টেকসই ও ধাতস্থ।

ইসলামী অর্থনীতির জাতীয়করণ তত্ত্ব
ইসলামী অর্থনীতির জাতীয়করণ বলতে মূলত পরোক্ষ মালিকানা নীতিকে বোঝানো হয়েছে। মৌলিকভাবে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের অভিন্ন মতৈক্য হচ্ছে যাবতীয় সম্পদের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তায়ালা। মানুষ শুধু সেসব সম্পদের আমানতদার হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনের আলোকে সীমা-পরিসীমার মধ্যে থেকে ভোগ করার অনুমোদনপ্রাপ্ত। সে জন্যই তাকে পরকালীন জীবনে প্রদেয় সম্পদ ব্যবহারের ব্যাপারে যথাযথ জবাবদিহি করতে হবে। তবে ব্যক্তিগত সম্পদের পর সরকারি মালিকানা ইসলামের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হলেও এ দুটোর মধ্যে ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো সীমা-পরিসীমা নিরূপণ করেনি। বরং পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের আলোকে কতগুলো মূলনীতির আলোকে তা বাস্তবায়নের সুযোগ রেখেছে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগের অর্থনীতিবিদরা সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, কারণ তত্কালীন সময়ে সম্পদের অধিকারীদের অনেকেই কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী ছিলেন। কুরআন, হাদিস ও স্কলারদের মধ্যে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা নিয়ে কোনো বিরোধ পাওয়া যায় না। ইসলামী অর্থনীতির অনেকগুলো খাতই ব্যক্তিগত মালিকানার বৈধতাকে প্রমাণ করে। যেমন ব্যবসাকে সাধারণভাবে হালাল ঘোষণা করা, উত্তরাধিকারের আলোকে সম্পদ বণ্টনের অনুমতি এসবই সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকৃতি দেয়।

তবে কোনো কোনো ইসলামী অর্থনীতিবিদ সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার কেন্দ্রীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক ও পরামর্শদাতাদের সমন্বয়ে সম্পদ ব্যবহারের উপায় উপকরণ সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ করার এখতিয়ার সমাজের রয়েছে। তাদের মতে, আল্লাহ তায়ালা সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্যই সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সেসব সম্পদ ব্যক্তির নয় বরং সমাজের প্রয়োজনে সমাজের কাছেই সেসবের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। সমাজের নীতিনির্ধারক শ্রেণী জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে সম্পদের ব্যক্তি মালিকানাকে রহিত করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যক্তিকে তার ‍উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে হবে। তাদের মতে, ইসলাম ব্যক্তি মালিকানায় নিরঙ্কুশ অনুমোদন দিলেও জনকল্যাণের কথা চিন্তা করে সমাজ সেখানে সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার এখতিয়ার রাখে।

তবে মুসলিম স্কলাররা প্রধানত দুটি কারণে জাতীয়করণ করার ক্ষেত্রে একটি মধ্যমপন্থী অবস্থানের সূত্রপাত করেছেন। প্রথমত, ইসলাম একদিকে যেমন পেশা নির্বাচন, সম্পদ উপার্জনের অধিকার নিশ্চিত করে (কুরআন: বাকারা ২৭৫) পাশাপাশি কারো ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপকেও নিষিদ্ধ করে (কুরআন: নিসা ২৯), যা ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের বৈধতাকে প্রমাণ করে। অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়বিচার, অন্যের অধিকার নিশ্চিতকরণ (কুরআন: বাকারা ১৭৭; তাওবা ১০৩) এবং সম্পদের সর্বাধিক বণ্টন নীতি ইসলামে সম্পদের সামাজিক মালিকানার নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। ‍দ্বিতীয়ত, বিগত সময়ে বিশ্বব্যাপী জাতীয়করণের অভিজ্ঞতা। জাতীয়করণ যেমনভাবে অন্যায় ও বেআইনিভাবে সম্পদ অধিগ্রহণের সমাজতান্ত্রিক নীতিকে প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও শোষণের অবসানে ভূমিকা রেখেছে, আবার এই জাতীয়করণই অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম, অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও উত্পাদন ঘাটতি সৃষ্টি করার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা হরণ করেছে। ফলে মুসলিম অর্থনীতিবিদরা শুধু সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণকল্পে ও বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থেই জাতীয়করণের পক্ষে মত দিয়েছেন।

ইসলামী অর্থনীতি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব মালিকানাকেই ভারসাম্যপূর্ণ আঙ্গিকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, যার প্রকৃত চর্চা ইসলামের প্রাথমিক সময়ে পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের বনভূমি, খনিজ ও পানিসম্পদের মতো পুরো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর খাতগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। চারণভূমি ও সমাধিস্থলের মতো সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় খাতগুলো সমাজের মালিকানাধীন ছিল এবং কৃষি ভূমি, ঘর-বাড়ি, পশুসম্পদ ও শিল্প-কারখানা ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতো।

তবে জনগণের প্রতি অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও জুলুমের অবসানকল্পে অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সেসব ব্যবহারের ক্ষমতায়নে ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় অধিকার দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র সেসব আইনের প্রয়োগ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না। এ অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র সব ধরনের মুনাফাখোরি, মজুতদারি, মনোপলি, চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেবে। যেহেতু কুরআন ও হাদিস সাধারণভাবে সব ধরনের অপরাধ ও অন্যায়কে প্রতিহত করার অনুমোদন দিয়েছে, সেক্ষেত্রে অর্থনীতিতে যদি এমন কোনো অপরাধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, যার সরাসরি বর্ণনা কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্র সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে গবেষণার (ইজতেহাদ) ধারা অব্যাহত রেখে সেসব অন্যায় ও অপরাধকে প্রতিহত করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি ও তা প্রয়োগ করার সুযোগ গ্রহণ করবে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমের ঐতিহাসিক বাণীটি এক্ষেত্রে উল্লেখ করা খুব জরুরি:

‘আল্লাহ তায়ালার নবী পাঠানো ও কিতাব নাজিল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, যা মূলত গোটা সৃষ্টির মূলনীতি। আল্লাহর নাজিল করা প্রতিটি বিষয়ে এ কথাই প্রমাণ করে যে এসবের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃত ইনসাফ এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। যেভাবেই আইন রচনা করা হোক না কেন আইনকে সত্য ও ইনসাফের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের আসল লক্ষ্য কীভাবে আইন পাওয়া গেল তা নয়। কিন্তু আল্লাহ আমাদের কিছু আইন দিয়ে কতগুলো উদাহরণ স্থাপন করেছেন এবং আইনের কয়েকটি যুক্তিসংগত যুক্তি দিয়েছেন। আমরা তাই ন্যায়সংগত সরকারি নীতি ও আইনকে শরিয়তের অংশ মনে করি, শরিয়তের বরখেলাপ হওয়া মনে করি না। এসবকে রাজনৈতিক নীতিমালা বলা কেবল পরিভাষার ব্যাপার। আসলে এগুলো শরিয়তের অংশ। তবে শর্ত এই যে এগুলোকে ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।’

ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমের এ চিন্তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামী আইন রচনার ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের বিষয়টি শরিয়ার ‘ফরজে কেফায়ার’ ওপর ভিত্তি করেও গ্রহণ করার সুযোগ থাকে। ফরজে কেফায়া মূলত যা ব্যক্তিগত নয় বরং সামাজিক দায়বদ্ধতা। যার মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজকে অব্যাহত রাখা হয় এবং সেটির অনুপস্থিতিতে ব্যক্তিস্বার্থবাদও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি এটি মূলত ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা বা ফরজগুলোকে পূর্ণতা দান ও শক্তিশালীকরণে ভূমিকা পালন করে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সমাজ ও সাধারণ মানুষের অধিকারকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের জায়গা থেকে মূল্যায়ন করে বলে আল্লাহ তায়ালা সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর তদারকি সমাজের ওপর অর্পণ করেছেন। এটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ভিত্তি। সুতরাং অর্থনৈতিক শিক্ষা, সেবা ও জনকল্যাণে শিল্প প্রতিষ্ঠা করাও ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের অনেক স্কলার, ইমাম গাজ্জালি ও আলজাওজিসহ অনেক ইসলামী পণ্ডিতও একমত পোষণ করেছেন। কারণ অর্থনৈতিক শিক্ষা প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ক্ষমতা ও অধিকারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া সম্ভব নয় বলেও অর্থনীতিতে রাষ্ট্র বা সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়।

অন্যদিকে ইসলাম যেহেতু মানুষকে হালালনির্ভর কর্মসংস্থান জোগাড় ও সৃষ্টি করার অনুমতি দিয়েছে, সেসব কর্মসংস্থান ও সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার বিষয়টিও ইসলাম বিভিন্ন মাত্রায় জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে আসে, সে আলোকেও অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়টি পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। একইভাবে ‘হিজর’ আইনও অর্থনীতিতে ইসলামী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। যদি কোনো ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক আইন অমান্য কিংবা সম্পদের অপব্যবহার করে তখন রাষ্ট্র তাকে সেখান থেকে নিবৃত্ত রাখার নিমিত্তে তার প্রতিষ্ঠান বা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার অধিকার রাখে, যেটি ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় ‘হিজর’ নামে পরিচিত। এ আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও অর্থ ব্যবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের অংশগ্রহণকে প্রয়োজনীয় করে তোলে।

শ্রম অধিকার নিশ্চিতকরণ ও তার বাস্তবায়ন ইসলামী অর্থনীতিতে মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২০ শতাংশ কর্মক্ষম জনশক্তি বিভিন্ন শিল্প, কৃষি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। তুলনামূলক শিল্পোন্নত মুসলিম দেশগুলোয় এ হার আরো বেশি। সুতরাং এ বিশাল শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের কথা ইসলাম কোনোভাবেই অস্বীকার করে না, বরং তাদের অধিকার আদায়ে নানা ধরনের বৈধ পদক্ষেপকে উত্সাহিত করে। আবার এ বিশালসংখ্যক মানুষের অধিকার যদি নিরঙ্কুশ না হয় তাহলে পুরো অর্থনীতিসহ সমাজে ব্যাপক অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ সমাজ থেকে সব ধরনের অশান্তিকে যৌক্তিক পদ্ধতিতে দূরীভূত করতে ইসলাম শুরু থেকেই ভূমিকা পালন করে আসেছে। সুতরাং শ্রমিকদের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজকে শান্তিময় রাখা রাষ্ট্র ও সরকারের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এদিক থেকে ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্য মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মজুরি কমিশন গঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের সহযোগিতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সুরক্ষা দেয়ার জন্য ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণকে ন্যায্যতা দান করে।

ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীভূত করা। দারিদ্র্য দূরীভূত করার অন্যতম দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে কুফরি করা কিংবা কুফরির দিকে ধাবিত করতে পারে এমন সব বিষয় থেকে সমাজকে সুরক্ষা দিয়ে সমাজের মানুষের ইসলামী বিশ্বাসকে সংরক্ষণ করা। রাসূল (সা.) এর হাদিস অনুযায়ী দারিদ্র্য মানুষকে কুফরির দিকে ধাবিত করে। এবং বাস্তবিক অর্থে এটিই সত্য বলে প্রমাণিত। দারিদ্র্য মুসলিমদের বড় একটি অংশকেই ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ ও চর্চা করা থেকে বিরত রেখেছে। এটি তাদের এমন এক জীবন সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছে যার কারণে তারা ইসলামী জিন্দেগি বিনির্মাণের চিন্তাও করতে পারে না। এমতাবস্থায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যেটি ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার বিষয়কে স্পষ্ট করে।

জাকাত ইসলামের অন্যতম মৌলিক অর্থনৈতিক হাতিয়ার। যার ব্যবহার ইসলাম মূলত রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত করেছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মুসলিম দেশেই জাকাত সংগ্রহের নির্ধারিত আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে জাকাত প্রদানকারীদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে জাকাত আদায় করেন। অথচ জাকাতের প্রকৃত সুফল পেতে এটিকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্রোতে সংযুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই বলেই জাকাত যুগে যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আহরণ ও বণ্টন হতো। এদিক থেকেও ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়টি দালিলিক হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্রের বেকারত্ব দূরীকরণের অংশ হিসেবে মূলত সরকারকেই ব্যাপকভাবে শিল্প উদ্যোগ নিতে হয়। শুধু বেসরকারি ‍উদ্যোগে পরিপূর্ণ বেকারত্ব দূর করা অসম্ভব। এজন্য অর্থনীতিতে সরকারের অংশগ্রহণ অনেক জরুরি হয়ে পড়ে। মূলত ব্যাপক আকারে মৌলিক শিল্প উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহণ করা উচিত, কারণ মূল শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সরকারিভাবে এসব শিল্প গড়ে তোলা ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রধান ও মূল শিল্প সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও নিয়ন্ত্রণে থাকা অপরিহার্য। বেসরকারি খাত তুলনামূলকভাবে দক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও কর ফাঁকি দেয়ার দোষে অনেক সময়ই বেসরকারি উদ্যোগ দুষ্ট হয়ে পড়ে। অথচ এটি জনগণের সম্পদ, যা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। সুতরাং যেসব সম্পদ বা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিলে জনগণের অনিষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে সেসব খাত বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। তবে কোন কোন শিল্প বা ব্যবসা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিলে জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে এবং জুলুম বন্ধ হবে তা নির্ধারণ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের সংসদ। সুতরাং এসব থেকেই ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়টির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।

ইসলামী অর্থনীতির দর্শন
আমানত রক্ষা ও তার যথাযথ সংরক্ষণ ইসলামের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য নীতি। যেকোনো আমানতই ইসলামের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে, হোক সেটা অর্থনৈতিক কিংবা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদও এক সুবিশাল আমানত। এসব আমানতের সংরক্ষণে কুরআন বিভিন্নভাবে মানুষকে আদেশ করে (কুরআন: আল ইমরান ৭৫-৭৬)। আমানত রক্ষা করাকে আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার মানদণ্ডের অধিভুক্ত করার পাশাপাশি আমানত রক্ষাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা বলেও আয়াতে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুতরাং অঙ্গীকার রক্ষা করাও (কুরআন: মায়িদা ১১) অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ। সুতরাং আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইসলাম অনুমোদন করে। কারণ সব প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর সমাজ ও অর্থনীতির ভারসাম্যতা নির্ভর করে এবং এর ব্যতিক্রম হলেই সমাজ ও অর্থনীতিতে বিপর্যয় শুরু হয়। সুতরাং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে যারা স্বেচ্ছায় শরিয়তসম্মত কোনো অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবে তখন আমানত হিসেবে তা পালন করতে তারা বাধ্য। মূলত অর্থনীতিতে যদি আমানত শক্তভাবে প্রতিপালিত হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ দান ও গ্রহণ, বিনিয়োগ সবকিছুই নিরাপদ ও টেকসই হয়।

ইয়াতিম ও নারীবান্ধব অর্থনীতির ধারণা ইসলামী অর্থনীতির একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাপনা। ইসলামে ব্যাপকভাবে পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, নারী ও ইয়াতিমদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করেছে (কুরআন: নিসা ১২৭-১২৮)। এখানে একাধারে পরিবার ব্যবস্থাপনা, ইয়াতিম ও নারীদের ব্যাপারে কুরআন সমাধান ব্যক্ত করছে। পারিবারিক কাঠামোকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং সে আলোকে পরিবারে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম নানাবিধ বিধান দিয়ে রেখেছে। এটির অর্থনৈতিক তাত্পর্যও অনেক সুদূরপ্রসারী, কারণ পারিবারিক শান্তি কেবল সামাজিক শান্তিই নিশ্চিত করে না, বরং সমাজে যদি পারিবারিক কাঠামো টেকসই হয়, তাহলে দুস্থ ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা হয়, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেকাংশে লাঘব করতে সহযোগিতা করে। অন্যদিকে ইয়াতিমদের অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়েও ইসলাম সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। উল্লেখিত সব শ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ইসলাম প্রয়োজনীয় আইন ও কাঠামো তৈরিকেও উত্সাহিত করে।

মিরাস বা উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকারও ইসলামী অর্থনীতিরই বণ্টন নীতির অংশ। এ সম্পদ অনেক দরিদ্র নিকটাত্মীয়ের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের একটি ফলপ্রসূ বিকল্প ব্যবস্থা করে দেয়। উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন সমাজ থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও বঞ্চনার মনোবৃত্তি দূরীভূত করে সামাজিক সৌহার্দ্য ও শান্তি বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যা পরোক্ষভাবে সমাজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ও টেকসই করার পাশাপাশি পুঁজিহীন মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনে এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ ও প্রগতিশীল ধারাকে অব্যাহত রাখে।

আখেরাতমুখী দর্শন ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের সফলতা উপযোগী করে সাজানোর জন্য ইসলামের দিকনির্দেশনা অনেক বিস্তৃত। তাই দুনিয়ার জীবনে বৈরাগ্যবাদিতা নয় বরং পার্থিব জীবনের সবকিছুকেই সঠিক উপলব্ধির আলোকে সাজানো, ব্যবহার ও পরিচর্যাই মূলত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। সুতরাং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বৈষয়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি হবে ইসলাম। তা না হলে মানুষ পার্থিব ভোগ-বিলাসে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হবে এবং যেকোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করবে না। এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার ভুলুণ্ঠিত হবে এবং সাম্য, ত্যাগ ও সহযোগিতাও নিবৃত্ত হবে। পরকালনির্ভর জীবনদর্শন মূলত একজন মানুষকে জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ ও সংকীর্ণ স্বার্থবাদিতা থেকে আড়াল করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেয়ালের ভূমিকা পালন করে। সুতরাং পরকালনির্ভর জীবনদর্শন বাস্তবায়িত হলে কোনো ধরনের শোষণ ও জুলুমের মাধ্যমে কেউ অপ্রয়োজনীয় ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকার অবকাশ পাবে না। এ চিন্তায় অভ্যস্ত মানুষেরা জাতীয় পরিকল্পনায় এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করবে না, যাতে সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন নির্বাসিত হয়ে গুটিকয়েকের স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করবে। কারণ এটি এমন এক চিন্তা, যা ভোগবাদের মূলোত্পাট করে একটি সরল ও মধ্যমপন্থী জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজকে অনুপ্রাণিত করে।

কতিপয় বিষয়ের ক্ষেত্রে আদেশ ও নিষেধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতনতা ও মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ থেকে বিরত থাকতে ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধারাবাহিকভাবে আদায় করার ব্যাপারে মানুষকে নির্দেশনা প্রদান করেন। যেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আঙ্গিকে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক তাত্পর্য বিদ্যমান। প্রথমেই আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করার নির্দেশের মধ্য দিয়ে মূলত আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অর্থনীতি গড়ে তোলার শিক্ষা ও মূলনীতি যে তার কাছ থেকেই নিতে হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। পিতা-মাতার সঙ্গে সদয় হওয়ার অর্থনৈতিক সংজ্ঞা হচ্ছে নিজেদের ভরণপোষণে অক্ষম এমন পিতা-মাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব মূলত সন্তানদেরই নিতে হবে। ইসলাম এমন এক মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় যেখানে পিতা-মাতার বিপদাপন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না, বার্ধক্য বয়সে এসে যাতে বৃদ্ধদের চাপ সরকারকে ব্যাপকভাবে বহন করতে না হয় সেটি ইসলাম নিশ্চিত করতে চায়। পাশাপাশি রিজিকদাতা হিসেবে অর্থনীতির মূল কর্তৃত্ব আল্লাহর কাছে এটিই ইসলামী অর্থনীতির মূল বক্তব্য, যা আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত আয়াতে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।

দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাত্ অর্থনৈতিক ভীতি থেকে জনশক্তি পরিকল্পনায় যেকোনো ধরনের গর্ভপাত বা ভ্রূণ হত্যা ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলামে অশ্লীলতাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতির উত্পাদন নীতি পরিচ্ছন্ন ও নিষ্কলুষ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে অশ্লীল পণ্য উত্পাদন, বিপণন এবং বিনিয়োগ সবই ইসলাম কঠোরভাবে অবৈধ ঘোষণা করে। ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম দর্শন হচ্ছে ইয়াতিমদের সম্পদ সুরক্ষা ও প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণ। ইয়াতিমদের সম্পদ সুরক্ষায় প্রয়োজনে রাষ্ট্র স্বাতন্ত্র্যিক আইন করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না।

সঠিক ওজনের লেনদেন ইসলামী অর্থনীতির অপরিবর্তনশীল নীতি। এর ওপর অর্থনীতির অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে। সঠিক পরিমাপ ও পরিমাণ উত্পাদক ও গ্রাহকের পারস্পরিক আস্থার প্রতিচ্ছবি। যারা এ নীতির ব্যত্যয় ঘটাবে ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার বিষয়ে অনেক ইতিবাচক অবস্থান স্বীকার করে। কুরআনের আয়াতে বাহ্যিক বর্ণনায় পরিমাপ বা ওজন করার ক্ষেত্রে ওজন করা যায় এমন পণ্যকে বুঝিয়েছে মনে হলেও এখানে পরোক্ষভাবে শ্রমিক-কর্মচারীর কাজে ফাঁকি দেয়া এবং শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি আদায় না করাও একই মানদণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে অবশ্যই কোনো কিছুই যাতে কারো সাধ্যাতীত না হয়ে যায়, সেদিকেও কুরআন স্পষ্টভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছে। কারণ ইসলামী অর্থনীতিতে কর আরোপ, কাজের সময় ও পারিশ্রমিক নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়ে ব্যক্তির সামর্থ্যের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে বলেই কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন ও সংসদ সবাইকে এ নীতির প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক তত্ত্ব বোঝার জন্য সুরা আল-আরাফের ৩১ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতগুলোও আমাদের বিশ্লেষণ করা দরকার। যেখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অপব্যয় না করে ভোগ ও পানাহারের অনুমোদন দিয়েছেন এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো ইসলামের বৈধ বিষয়াবলিকে অবৈধ করার ব্যাপারে সতর্ক করছেন। পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা বান্দার মধ্যে তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রতিফলন দেখতে পছন্দ করেন বলে ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেন। ইসলামী অর্থনীতিতে ভোগের পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, খাওয়া ও পানাহারকে উত্সাহিত করার মধ্য দিয়ে ইসলাম বৈরাগ্যবাদের নীতিকে অগ্রাহ্য করে। ইসলামের এ নীতির ফলে ইসলামী সমাজে ‍উত্পাদ, বিপণন ও আল্লাহর নির্দেশের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুন্দর জীবন পরিচালনা করাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

তবে এক্ষেত্রে অবৈধ ভোগ ও অপ্রয়োজনীয় পানাহার থেকে দূরে থাকতে স্পষ্ট আদেশ দেয়া আছে, যেটিকে কুরআনের ভাষায় ‘ইসরাফ’ বলা হয়ে থাকে। এবং এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা, আমদানি-রফতানি, উত্পাদন ও বণ্টন নীতি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে এসবের আলোকে কোনো ধরনের ‘ইসরাফ’ উত্সাহিত না হয়। আর তাই কনজিউমারিজমকে ইসলামী নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। এতে মানুষ অতিরিক্ত বস্তুবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রবল করে তোলে। এক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা নীতিই হবে ইসলামী অর্থনীতির নীতি প্রণয়নের মানদণ্ড। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলাসী প্রকল্প গ্রহণের মানসিকতা বাদ দিয়ে বরং দারিদ্র্য বিমোচন ও দুর্বলদের পুনর্বাসনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়াই এই আয়াতের মূল দাবি, তাতে মানুষের ওপর আরোপিত অপ্রয়োজনীয় করের বোঝাও অনেকাংশে কমে আসবে। আয়াতগুলোর মধ্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে ‘পবিত্রতা’র গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কারণ ইসলামী অর্থনীতিতে অপবিত্র, অস্বাস্থ্যকর কিংবা অকল্যাণকর কোনো কিছুরই যেমন জায়গা নেই, ঠিক তেমনি শরিয়ত প্রদত্ত বৈধ কোনো কিছুকে অবৈধ করারও কারো অধিকার নেই। এটিই ইসলামী অর্থনীতির মূল্যবোধ ও নীতি।

সুরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতেও ইসলামী অর্থনীতির ধারণা পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে ঈমানের পথকে পরিহার করে বাবা-মা, সন্তান-সন্তুতি, স্বামী বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, সহায়সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিজেদের বাসস্থানের গুরুত্বকে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়, সেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ আল্লাহর পথে জিহাদ উপরোল্লেখিত সব কাজ থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির গুরুত্বকে ইসলাম স্বীকার করলেও সেই অর্থনৈতিক কার্যক্রম যাতে আল্লাহ ও রাসুলের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সতর্ক থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অর্থসম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো কিছু্ই যাতে আল্লাহ ও রাসুলের নির্ধারিত আইন, বিধান, সীমা ও নির্দেশনার গণ্ডি অতিক্রম না করে। সম্পদের ভোগ, ব্যবহার, উন্নয়ন, বিনিময় ও ব্যয় সবকিছুই যাতে আল্লাহ ও রাসুলের প্রদর্শিত বিধানের আলোকে বাস্তবায়িত হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

অর্থনীতি বিষয়ক যেকোনো আইন প্রণয়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়গুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে, এর ব্যত্যয় হলে কুরআনের আলোকে তারা আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হবেন। জিহাদের সঙ্গে অর্থনীতির সামঞ্জস্যতার বিধানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নীতিকে এ আয়াত স্পষ্ট করে জিহাদের সময় অর্থনৈতিক বিন্যাসের ‍দৃষ্টিভঙ্গি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জিহাদের প্রয়োজনে মুমিন তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে পরিহার করার মানসিকতা পোষণ করবে এবং সম্পদের প্রতি ভালোবাসা কাউকে জিহাদ থেকে বিরত রাখতে পারে না এ নীতিই এ আয়াত প্রমাণ করে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেমনটি প্রযোজ্য ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও। ইসলামী রাষ্ট্র ও কখনো কখনো জিহাদের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক লোকসানের মানসিকতা পোষণ করতে হবে এটিই আয়াতের দাবি। কিংবা জিহাদের সময় পরিস্থিতির আলোকে রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে ঢেলেও সাজাবে, যাতে সফলতার সঙ্গে জিহাদ পরিচালনা করা যায়।

খিলাফাহ বা প্রতিনিধিত্বশীল জীবন ধারণ ইসলামের এক অনবদ্য দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়নে একে অন্যের জীবন-জীবিকা ও প্রয়োজন পূরণে সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসবে, এটাই ইসলামী অর্থনীতির দর্শন। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদেয় রিজিক থেকে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সুযোগ করে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম সরকারের এক্ষেত্রে দায়িত্ব আরো বেশি বিস্তৃত। অর্থনৈতিক প্রতিনিধিত্বশীলতা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন না করে জনগণকে অর্থনৈতিক মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করানোও প্রতিনিধিত্বশীল অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য।

বৈষম্যহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় নিম্নবিত্ত দরিদ্র ও অভিজাত ধনীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নিরূপণ করা হয়নি। মানুষ হিসেবে দুই শ্রেণীর অবস্থানই আল্লাহর কাছে সমান। এবং তার নবীকেও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নিরূপণে নিষেধ করেছেন। বরং তাদের মধ্যে প্রার্থক্য করা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে (কুরআন: হুদ ২৭-২৯)। কারণ ইসলামের প্রাথমিক যুগেও মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য ছিল আর ইসলামের প্রথম দিকে দরিদ্ররাই ইসলাম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রসরমাণ ছিল। ‍সুতরাং অর্থনৈতিক অধিকারে সমতার বিধান পরিপালন করা মূলত ইসলামের দাবি। তাই ইসলামী সরকার ‍শিল্প উদ্যোগ ও চাকরির মতো বিশেষায়িত ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ অর্থনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে দায়বদ্ধ থাকবে। সাধারণ মানুষকে অবহেলার দৃষ্টিতে না দেখে বরং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নয়নের মূল স্রোতে তাদের সম্পৃক্ত করানোর দায়বদ্ধতাও ইসলামী সরকারকে নিতে হবে।

ইসলামী অর্থনীতির মালিকানা নীতি পরিপূর্ণভাবে অন্যান্য মনুষ্যসৃষ্ট দর্শনের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। ইসলামী অর্থনীতির চূড়ান্ত মালিকানা আল্লাহর জন্য নিবদ্ধ। শোয়াইব (আ.)-এর কওমের লোকের এ দর্শনের পুরো বিপরীত বিশ্বাসী ছিল (কুরআন: হুদ ৮৭)। তারা নিজেদের সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক ও সেসবের পরিপূর্ণ ভোগাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করত। এক্ষেত্রে তারা সব ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতার নিয়ন্ত্রণহীন মনে করত। এসবের সঙ্গে ধর্মীয় বিধানের সম্পৃক্ততা আছে তা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারত না। ফলে শোয়াইব (আ.) কে তাদের উপহাসের পাত্রও হতে হয়েছিল। তবে ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শন কোনোভাবেই আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর নির্দেশনার বাইরে গিয়ে নিজেকে সুসংহত করে না। বরং শর্তহীনভাবেই মুসলিম রাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও নীতিনির্ধারণে ইসলামের বিধানাবলি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে। যেটি প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে অগ্রাহ্য করে এবং ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতির দুটি ধারা যথা পজিটিভ ও নরমেটিভ ইকোনমকিস দুটোকেই অপ্রাসঙ্গিক ও অনুপযোগী মনে করে। ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতির এ দুটি ধারার একটি ধারা আগে নির্ধারিত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিতে সংযোজন-বিয়োজন করে আর অন্যটি কল্পিত কারণ তৈরি করে তার কাঠামোতে সম্ভাব্য যুক্তি দাঁড় করায়। এই আধুনিক অর্থনীতির কাঠামোগুলো মানুষের অর্থনীতিবহির্ভূত সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ এবং চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করে বিজ্ঞানের রূপ দিতে চায়। অথচ সে বিজ্ঞান তত্ত্বকে মানুষের উপযোগী করার জন্য কোনো পদ্ধতি তৈরি করে না। যা ইসলামী মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামী মূল্যবোধ নৈতিকতা, ইসলামী মৌল বিশ্বাস এবং বিধান পরিপালনকে ব্যাপকভাবে অনুশীলন ও গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করে।

দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দান করা। ইসলাম সত্ পথে দান করাকে কল্যাণপ্রাপ্ত মানুষের গুণাবলি হিসেবে নির্ণয় করেছে। ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যয়ের দুনিয়াবি লক্ষ্যের পাশাপাশি পরকালীন পুরস্কার পাওয়ার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ধর্তব্য করতে বলা হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ও সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে অগ্রাধিকারের বিষয়টি বিভিন্নভাবে উত্সাহিত করা হয়েছে। এ ব্যয়কে আল্লাহ তার সঙ্গে ব্যবসার তুলনা করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পরোক্ষভাবে ব্যবসার বৈধতার পাশাপাশি সেটির মর্যাদাও প্রমাণ করেছেন।

ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই (কুরআন: ইবরাহিম ৩৮)। আল্লাহ প্রদত্ত সব নিয়ামতকেই ইসলাম অর্থনৈতিক সম্পদ বিবেচনা করে। সব দৃশ্যমান সম্পদই চূড়ান্ত নয়, বরং বিশ্বে অনাবিষ্কৃত ও সৌরমণ্ডলে ছড়িয়ে থাকা নিয়ামতগুলোও ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় সেসবকে মানুষের নাগালের ভেতরে নিয়ে এসে তাদের সার্বিক কল্যাণে ব্যবহার করাই ইসলামী অর্থনীতির দর্শন। তবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের সময় মজুদ থাকা সম্পদের ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনা প্রণয়ন ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি।

পশুসম্পদ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবেই পশুসম্পদের গুরুত্ব অনুধাবনে আয়াত নাজিল করেছেন। পশুসম্পদ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের এক অনবদ্য সংযোজন (কুরআন: নাহল ৫-৮)। পশুসম্পদ থেকে মানুষের জীবনধারণ ও তার ক্রমাগত উন্নতির উপকরণসহ প্রয়োজনীয় আমিষের আঞ্জাম দেয়া হয়। অন্যদিকে পশুসম্পদের মাধ্যমে মানুষের পোশাক তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়। বাহন ও কৃষিকাজের অবলম্বন হিসেবে এ পশুসম্পদ অতীতে যেমনিভাবে বিভিন্নভাবে অর্থনীতি ও সভ্যতা বিনির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে এখনো এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলছে। বিশ্বব্যাপী ডেইরি শিল্পের যে প্রয়োজনীয়তা তার পুরোটাই এ পশুসম্পদ সরবরাহ করে চলেছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও হল্যান্ডের মতো দেশ এ পশুসম্পদ থেকে ডেইরি পণ্য উত্পাদনে নিজেদের বিশ্ববাজারে নেতৃত্বের জায়গায় আসীন করেছে। অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির পরতে পরতে পশুসম্পদের অবদান দৃশ্যমান। এখানে পশুসম্পদ নিজেকে পুঁজির জায়গায় স্থিত করেছে। কৃষি খামারের মাটি তৈরির কাজ, হালচাষ, মই টানা, সেচ উত্তোলন এবং শস্য মাড়ানোসহ পুরো অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই পশুসম্পদের অংশগ্রহণ। জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতিও এ পশুসম্পদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে, পাশাপাশি পশু লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ গ্রামীণ অর্থনীতিকে মানবিক আমেজের সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত করে তোলে।

ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যয়নীতি খুব তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কুরআন ব্যয়নীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থী পদ্ধতি মানুষকে বাতলে দিয়েছে (বনি ইসরাইল ২৯-৩১)। যেখানে তাদের কৃপণতা ও অপচয় পরিহার করতে বলা হয়েছে, যাতে করে তারা নিন্দিত ও নিঃস্ব কোনোটাই না হয়ে পড়ে। কারণ কৃপণতা ধনসম্পদের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে আর অপচয় কোনো এক পর্যায়ে ব্যক্তির অর্থনৈতিক সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। কিন্তু কুরআন প্রদত্ত ব্যয়নীতি অবলম্বন করলে প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে যেমনি সমস্যা তৈরি হবে না, ঠিক একইভাবে বেহুদা খরচে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে যথাযথভাবে পরিচালিত করতে হলে ব্যয়নীতিকে একটি ‍সুনির্দিষ্ট কাঠামোর আলোকে পরিচালিত করতে হয়। সে জন্যই ব্যয়নীতিতে অমিতচারী, অমিতব্যয়ী ও অপচয় সবই নিন্দনীয়। একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনীতির সুস্থতা ও অসুস্থতা এবং সে আলোকে মানুষের কর্মসংস্থান, উপার্জনক্ষমতা, ‍উত্পাদন ও সরবরাহের সন্তোষজনক ধারাবাহিকতা, দ্রব্যমূল্যের হার এবং সর্বোপরি সব মানুষের জীবন ধারণে স্থিতিশীলতার বহুবিধ পরিণতি নির্ভর করে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে তার নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী ব্যয় ও বণ্টন করার ওপর।

কুরআনের এ ব্যয়নীতির আলোকে প্রচলিত অর্থনীতির যে ব্যয় ও সঞ্চয় নীতি সেটি মানুষের কতটুকু কল্যাণকর তা পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ম্যাক্রো অর্থনীতির তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে দেখানো হয় যে সম্পদের বৃত্তাকার আবর্তনের ফলে অর্জিত আয় থেকে দুটো প্রক্রিয়া তৈরি হয়। সেগুলো হলো ব্যয়ের মাধ্যমে ভোগ এবং সঞ্চয়, আর সঞ্চয় থেকে আসা পুঁজি বিনিয়োগ ও পুঁজি সংগঠন। এখানে মূলত বেশির ভাগ সময়ই ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। অনেকেই অর্জিত আয় সামান্য পরিমাণ ব্যয় করে এবং অব্যবহূত আয়কে স্বর্ণ-রৌপ্যে রূপান্তর করে বছরের পর বছর অনুত্পাদনশীল হিসেবে গচ্ছিত রাখেন, যেটি বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি সরবরাহের প্রবাহকে ব্যাহত করে উত্পাদন ধারায় ধীরে ধীরে জটিল রুগ্ণতা সৃষ্টি করে। এবং পর্যায়ক্রমে এটি অর্থনীতিতে ব্যাপক আকারে পণ্য দুর্ভিক্ষ তৈরি করে। আর এখানেই কুরআনের ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতির প্রয়োজনকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। যার মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষ নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ নিশ্চিত হয়। সেজন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনীতির ব্যয়নীতিতে ভারসাম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

সমুদ্র অর্থনীতি ইসলামী অর্থনীতির মৌল ধারায় অন্তর্ভুক্ত। কুরআন সমুদ্র অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য মানুষকে স্পষ্ট উত্সাহ প্রদান করে (বনি ইসরাইল: ৬৬)। বিশাল পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন দেশ ও অঞ্চলগুলোকে অর্থনৈতিক ধারায় সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে সমুদ্র যোগাযোগ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আধুনিক সময়ের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি কিন্তু এই সমুদ্র অর্থনীতি। সমুদ্র অর্থনীতির প্রাথমিক ধারণা মূলত কুরআন থেকেই পাওয়া যায়। যোগাযোগ সুবিধা ছাড়াও মত্স্য সম্পদকেন্দ্রিক অর্থনীতির যে কর্মযজ্ঞ সেটিরও বেশির ভাগ আসে এই সমুদ্র থেকে। সমুদ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার তলদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়টিও উঠে আসে। সমুদ্রের তলদেশে মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালা নেয়ামত ভাণ্ডার ঢেলে রেখেছেন যাকে আল্লাহ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করবে।

সহজতা ইসলামের স্বভাবজাত প্রকৃতি। কুরআন বিভিন্নভাবেই মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে নিষেধ করেছে (হজ: ৭৮)। ‍কুরআনের এ নীতি মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থনীতিতেও ইসলামের এ বিধান বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। এ আয়াতের আলোকে ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় কারো ওপর কেউ অহেতুক অর্থনৈতিক কাঠিন্য চাপিয়ে দেবে না। অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে দূরে থাকবে। অহেতুক কঠোরতা, মানুষের সাধ্যাতীত কর ব্যবস্থা প্রচলন, শিল্প উত্পাদনে ও বাণিজ্যে অহেতুক কল্যাণ পরিপন্থী নিয়ন্ত্রণ আরোপ ইসলাম কখনো অনুমোদন করে না। মোদ্দা কথা সব ক্ষেত্রেই কঠোরতা পরিত্যাজ্য মনে করা, হোক অর্থনীতি কিংবা জীবনের অন্য কোনো দিক বা বিভাগ। এটাই কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি।

উপসংহারে বলা যায় ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপ্তি অনেক বেশি বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। জীবন ও জগতের প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই ইসলামী অর্থনীতি ধারণ করে। প্রবন্ধের আলোকে ইসলামী অর্থনীতিকে প্রচলিত অর্থনীতির সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে উপলব্ধি করা যায়। এর প্রতিটি নীতি অনেক ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্মুক্ত। এটি সমাজ থেকে জুলুম, অনিয়ম, অবৈধ বাণিজ্য ও বৈষম্য দূর করে সবার অধিকার নিশ্চিতকরণে সমাজের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের জন্য একটি কল্যাণমুখী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যার কারণে ইসলামী অর্থনীতির তুলনামুলক ঝুঁকি কম এবং স্থায়িত্ব বেশি। ব্যতিক্রমী অবস্থানের কারণে মুসলিম-অমুসলিম সবার কাছেই সমাদৃত এ ব্যবস্থাটি। এর দর্শন ও কৌশল অনেক বেশি মানবিক ও পৃথিবীবান্ধব, তাই এটিকে মানবিক অর্থনীতিও বলা যেতে পারে।

ইসলাম অর্থনীতির কৌশল হিসেবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ, সম্পদ ভোগে নৈতিকতা চর্চা এবং দুনিয়া ও পরকালীন স্বার্থকে সামনে নিয়ে সমন্বিত অর্থনীতির কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। তবে আধুনিক ইসলামী অর্থনীতির কৌশলে আর্থসামাজিক ও আর্থিক পুর্নগঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যেখানে ব্যাংকিং, রাজস্ব ও মুদ্রা প্রণয়ননীতিকে পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলে। সর্বোপরি সরকার ও জনগণের সমন্বয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, সমাজতান্ত্রিকতার মতো সরকারের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নয় আবার পুঁজিবাদের মতো পরিপূর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রিতও নয়, বরং সরকার ও জনগণের সমন্বয়মূলক অংশগ্রহণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক অর্থনীতির মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে এ অর্থ ব্যবস্থা।

ড. কবির হাসান: অধ্যাপক, নিউ অরলিন্স ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র ও মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button