ইসলামী অর্থনীতি

সফল জীবনের কল্পকথাঃ যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি-৩

জিএম সরওয়ার বিশ্বাসঃ  যাকাত ইসলামের প্রধান আর্থিক ইবাদাত। সুষম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি ও ইসলামের মৌল স্তম্ভের উল্লেখযোগ্য একটি বুনিয়াদ। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদাত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মাজীদে বহু স্থানে সালাত ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সাওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন।” [সূরা বাকারা: ১১০]

আর্থ-সামাজিক দিক থেকে যাকাতের ভূমিকা ও গুরুত্ব
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। যাকাত আদায় করা আমাদের জন্য অপরিহার্য করণীয় কাজ এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি যাকাত। যে ব্যাপারে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। যাকাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নরূপ:

১. ধনী দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান দূর করে:
যাকাত ধনী দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান দূর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠন করে। যাকাত দরিদ্রের প্রতি ধনীদের করুণা নয়, বরং ধনীদের সম্পদে রয়েছে দরিদ্রের অধিকার। যেমন- আল্লাহর বাণী: এবং তাদের ধন সম্পদে রয়েছে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার।

২. সামাজিক নিরাপত্তা বিধান:
সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যাকাতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সমাজের যে সকল লোক অর্থ উপার্জনে অক্ষম এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করে, যাকাত ব্যবস্থা তা দূরীকরণে অনন্য ভূমিকা পালন করে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

৩. দারিদ্র বিমোচন:
দারিদ্র বিমোচনে যাকাত ব্যবস্থা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের ধনী শ্রেণী যদি সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে তাহলে সমাজে কোনো অভাবী মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

৪. সামাজিক অন্যায়-অনাচার নির্মূল:
অর্থের অভাব হলে মানুষ সামাজিক অন্যায়-অবিচার তথা চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই ও সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে সামাজিক অবকাঠামো। যাকাত ব্যবস্থা এসব সামাজিক অনাচার নির্মূলে অনন্য ভূমিকা পালন করে।

৫. ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণ:
যাকাত মানুষের মধ্যে বিশেষ করে ধনী-দরিদ্রের মাঝে সেতুবন্ধন ও গভীরতম ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

৬. সহানুভূতি সৃষ্টি:
যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের অন্তরে দরিদ্রদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। ধনীরা দরিদ্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে।

৭. জনহিতকর কার্যাবলী:
যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সমাজের অসংখ্য জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করা যায়।

৮. ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকারত্ব দূরীকরণ:
ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। যাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র শ্রেণীর কল্যাণ ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকারত্ব নির্মূল করতে সাহায্য করে থাকে।

যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
মানব সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য সংরক্ষণে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আবার হালাল-হারামের শর্ত, বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা, ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে এক সুবিচার ও ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। যা নিম্নে তুলে ধরা হল:

১. ইসলামী অর্থনীতির মূল ভিত্তি:
ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো যাকাত। আর পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূলভিত্তি ব্যক্তিগত সম্পদের প্রাধান্য যেমন- সুদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি যেমন সকল সম্পদ জাতীয়করণ।যাকাত ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সেতু-বন্ধন।

২. রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস:
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস যাকাত। ইসলামি রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থই যাকাত থেকে সংগৃহীত হয়ে থাকে।

৩. জাতীয় আয় বৃদ্ধি:
যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কে বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের সাথে যাকাতের অর্থ একত্রিত হয়ে জাতীয় আয় বহুলাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

৪. অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও মজবুত করে:
কোনো রাষ্ট্রকে উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি। যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সেই ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।

৫. অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টিতে অবদান:
রাষ্ট্রে ধনী-দরিদ্রের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। যাকাত ব্যবস্থা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা নিরসন করে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

৬. অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ:
যাকাত অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের মহৌষধ। কেননা যাকাত ব্যবস্থার কারণে বিত্তশালীদের অর্থ এক স্থানে সঞ্চিত থাকতে পারে না। সম্পদ সমাজের দরিদ্রদের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে।

৭. দারিদ্র্য বিমোচন:
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সঠিকভাবে যাকাতের অর্থ দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হতে বাধ্য।

৮. ঋণমুক্তি:
যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়।

৯. চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি:
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত উত্তোলন ও বিতরণের ব্যবস্থা করলে যাকাত বিভাগে অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

১০. পুঁজিবাদের অবসান:
যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা যাবে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার এ মূলনীতিকে সামনে রেখেই আল্লাহর ঘোষণা হলো: যাতে ধন ও ঐশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্ত্বশালীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়।

১১. বেকারত্ব দূরীকরণ:
বেকার জীবন অভিশপ্ত জীবন। ইসলামী যাকাত ব্যবস্থা সমাজ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাকাতের অর্থ দিয়ে বেকার লোকদের কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায়।

১২. অর্থিক প্রতারণা থেকে মুক্তি:
যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মাঝে প্রচলিত অর্থনৈতিক প্রতারণা মক্ত করা যায়। কেননা ইসলাম শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন করা শিখায় না অর্থ উপার্জনে নৈতিকতাও শিক্ষা দেয়। আধুনিক কর ব্যবস্থায় ফাঁকির প্রবণতা থাকলেও যাকাত ব্যবস্থায় ফাঁকি অকল্পনীয়। কেননা বিত্তশালীরা একান্তই ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় যাকাত দিয়ে থাকে।

১৩. কর্মসংস্থানের সৃষ্টি:
যাকাতের অর্থ একত্রিত করে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।

১৪. সমবায় সমিতি গঠন:
যাকাতের অর্থ একত্রিত করে দরিদ্র জনসাধারণের মাঝে যদি সমবায় সমিতি গঠন করা যায়, তাহলে এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন করতে পারে।

১৫. বীমা ব্যবস্থার প্রচলন:
আর্থিক নিরাপত্তাবিধানের জন্য ইসলামী বীমা কোম্পানী গঠনের মাধ্যমে জনগনের জীবনের ঝুকি ও আর্থিক ঝুকি মোকাবেলা করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

১৬. জনকল্যাণমূলক কাজ:
যাকাতের অর্থে এতিমখানা, বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কার্য-সম্পাদন করা যায়।

লেখকঃ জিএম সরওয়ার বিশ্বাস, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। 

আরও দেখুন:
সফল জীবনের কল্পকথাঃ যাকাতভিত্তিক অথনীতি-১
সফল জীবনের কল্পকথাঃ যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি-২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button