ইসলামী অর্থনীতি

ইসলামী অর্থনীতিতে উদ্যোক্তা উন্নয়ন

এম কবির হাসানঃ ইসলামী উদ্যোক্তার বিষয়ে তত্ত্ব নির্মাণ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ের ওপর লভ্য গবেষণাপত্রের প্রস্থ ও গভীরতা খুব সীমিত এবং নিবেদিত মাঠ-গবেষণা প্রায় নগণ্য। ইসলাম উন্নয়নের পথে অন্তরায় এবং প্রবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক—‘প্রচলিত’ এ হাইপোথিসিস (অনুমান) পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন নোল্যান্ড (২০০৩)। বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে এমন তিনটি বহু-জাতিগত সমাজের (ভারত, মালয়েশিয়া ও ঘানা) উপাত্ত ব্যবহার করে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক নিষ্পাদনে ধর্মীয় মনোভাবের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছিলেন। একইভাবে এ বিশ্লেষণগুলো একক দেশ পর্যায়ে করা হলে দেখা যায় তিনটি দেশের মধ্যে এবং প্রতিটি দেশের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন জুড়ে ফলাফলগুলো বিপরীতমুখী। ‘পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বা একই দেশের বিভিন্ন স্তরের মধ্যকার উপাত্ত’ নিয়ে পরীক্ষা করা হলে উভয় ধরনের গবেষণার ফলাফল এ দাবিকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে যে ইসলাম প্রবৃদ্ধির জন্য প্রতিবন্ধক।

‘যেভাবে অভিযোগ করা হয়, ইসলামকে দেখা যাচ্ছে না যে এটি প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বা উন্নয়নের নোঙর হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে’, নোল্যান্ড বলেন, ‘আর যাই হোক এর বিপরীত কিছু সত্য বলে মনে হয়’ (নোল্যান্ড, ২০৩, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)।

পশ্চিমা মিডিয়া, রাজনীতিবিদ এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা আধুনিকায়ন তত্ত্বগুলোর বেশির ভাগ মতামতকে সমর্থন করেছিল যে ইসলাম ও উন্নয়নের মধ্যে একটি ঋণাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এছাড়া ধর্মের ওপর তাদের সমালোচনাকে মনোনিবেশ করে তারা মুসলিম দেশগুলোর উন্নয়নের অভাব বা অনুন্নয়নকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল। তারা ইসলামকে দেখে এমন একটি ধর্ম হিসেবে যা উৎপাদনক্ষম নয় এবং উন্নয়ন-বিরোধী। তাদের দাবি, অনেক মুসলিম দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভাব বা অনুন্নয়নের পেছনে ইসলামই প্রধানত দায়ী। তারা যুক্তি দেয় যে মুসলমানরা স্বতন্ত্রভাবে অক্ষম এবং তাদের নৈতিক মান ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি ‘আবশ্যক’ শর্ত হিসেবে বিবেচিত।

মুসলমানরা, ইসলামের কারণে, আধুনিক হতে যা লাগে তা তাদের নেই। ইসলামের সমালোচকরা সমৃদ্ধ অর্থনীতি বিনির্মাণে ও আধুনিকীকরণে ইসলাম সমর্থ নয় দাবি করে এর স্বপক্ষে একটি দীর্ঘ তালিকা সংকলন করেছে। অন্যদিকে, মুসলমানরা ইসলামী যুগের অতীত কৃতিত্বের বয়ান পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তালিকাভুক্ত করেছে যেখানে বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি ও সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই বিশেষত পশ্চিমা সভ্যতায় মুসলমানদের অমূল্য অবদান বর্ণনা করার প্রয়াস লক্ষণীয়। মুসলমানদের সর্বজনীন জ্ঞানে অবদানগুলো ধ্রুপদী গ্রিস ও রোমের কাজকে রক্ষা করার বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। তারা জ্ঞানের এ কলেবরকে বাড়িয়ে তোলার জন্য তাদের নিজস্ব কাজ সংরক্ষণ, অনুবাদ, উন্নত ও যুক্ত করেছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন এক সময়ে পৃথিবীর পরিধিটি সঠিকভাবে পরিমাপ করছিলেন যখন ইউরোপীয়রা বিশ্বকে সমতল মনে করেছিল। বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও লগারিদমের বিকাশ হয়েছিল তাদের মাধ্যমে। এবং আরবরাই হলো তারা যারা আমাদের বর্তমান সংখ্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল (ব্রেট, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৩)।

বহু পাশ্চাত্য পণ্ডিত বিভিন্ন উপলক্ষে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন এবং বিশ্বসভ্যতা সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ওয়াট যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমরা যে এক বিশ্বের যুগে চলেছি এ সময়ে পশ্চিম ইউরোপীয়দের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আরব ও ইসলামিক বিশ্বের প্রতি আমাদের ঋণ পুরোপুরি স্বীকার করা’ (ওয়াট, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮৪)। তবে, মুসলিম এবং পাশ্চাত্য ভাষ্যকাররা যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান বহু শতাব্দী আগে ছিল (সলিম, ২০০৫) এবং সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল ১৪০৬ সালে (লেসি, ২০০৫)। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে তারা তাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করার চেষ্টা না করে তাদের বর্তমান ব্যর্থতার ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

তারা ইসলামের গতিশীলতা ও প্রগতিশীল প্রকৃতির প্রমাণ হিসেবে এবং ইসলাম আধুনিকীকরণে অক্ষম এ দাবি খণ্ডন করতে তাদের ইতিহাস ও পূর্ববর্তী সাফল্যকে ব্যবহার করেছেন। ব্যাপারটা হচ্ছে যে এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো বহু শতাব্দী ধরে একই ধর্মের মধ্যে উপলব্ধি করা হয়েছিল এবং টিকে ছিল—এটি ইসলামের যুক্তিযুক্ততার এক বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য। তারা আরো যুক্তি দিয়েছিল যে ইসলাম, একটি ধর্ম এবং মূল্যবোধনির্ভর ব্যবস্থা হিসেবে, একটি গভীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দ্বারা সমর্থিত যা আধুনিকায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; মুসলমানদের সম্ভাবনা এবং নৈতিক চালনা উভয়ই রয়েছে আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে, তবে আধুনিকায়ন হতে হবে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে।

ইসলামের সমালোচকরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের (বাধাজনক) ভূমিকা সম্পর্কে প্রায়ই উত্থাপন করে এমন অনেক দাবির মধ্যে রয়েছে: প্রথমত, ইসলাম স্থির ও অনগ্রসর ধর্ম, যা ‘অপরিবর্তনশীলতার পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল’ (কোরআন, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৯)। লুইসের মতে, আধুনিকায়নে ইসলামের অক্ষমতা এবং আধুনিকায়নের পথে ইসলামের প্রতিরোধমুখী অবস্থান ইসলামের ঐতিহ্যবাদ এবং পাশ্চাত্যের আধুনিকতার মধ্যে মৌলিক দ্বন্দ্বটিই প্রমাণ করে (লুইস, ২০০২; ওট, ২০০২) । তাই এ দেশগুলোতে উদ্যোক্তার উত্থানে এবং কার্যকর অর্থনীতিগুলোর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথাগত ইসলামী মূল্যবোধগুলো বাধা সৃষ্টি করে (কুলসন, ১৯৬৪; ল্যাবহোম, ২০০৩; পাইপস, ১৯৮৩)।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো উপস্থাপনে ইসলামী অর্থনীতি মূলত অপ্রাসঙ্গিক। কোরআন (২০০৪-এ) যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিকতা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় অর্থনৈতিক দিক থেকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। ইসলামী অর্থনীতির আসল উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের মধ্যে ধন-সম্পদ তৈরি করা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়ানো নয়, বরং সংস্কৃতি বিশ্বায়নের মোকাবেলায় মুসলমানদের পরিচয় রক্ষা করা এবং সংরক্ষণ করা। পাইপ (১৯৮৩) এবং পারকিনস (২০০৩) ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থার ওপর অনুযোগ করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে সুদকে নিষেধ করলে তা মুক্ত বাজারের সঠিক ক্রিয়াকলাপকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং ব্যবসায়ের লেনদেনের ব্যয় করার অদক্ষতা বাড়িয়ে তোলে।

তৃতীয়ত, মুসলমানদের উচ্চ অর্জনকারী হতে অনুপ্রাণিত করতে ইসলামের ব্যর্থতা কম উৎপাদনশীলতা ও অনুন্নয়নেরই নামান্তর। মুসলমানদের মধ্যে সাধারণত সাফল্যলাভের প্রেষণার অভাব দেখা দেয়, ফলে তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার যে চেতনা ও সক্রিয়তার প্রয়োজন তার মাত্রাও কম (ম্যাকক্লেল্যান্ড, ১৯৬১; সুতক্লিফ, ১৯৭৫)। আল-কোরআনের কতিপয় আয়াত ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐতিহ্য (সুন্নাহ) কিছুটা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সম্পদশালী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নিরুৎসাহিত করে। তারা দাবি করেন যে সনাতনপন্থী ইসলাম ধন সম্পদকে এ পার্থিব জীবনের সঙ্গে অত্যধিক ভালোবাসা এবং সংযুক্তির নিদর্শন হিসেবে চিত্রিত করে এবং বস্তুগত লাভের সন্ধান করতে পারে এমন ক্ষতিকারক পরিণতিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় জোর দেয় (পারকিনস, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৬; ; জাপালস্কা, ব্রজিক ও শুকলিয়ান, ২০০৫)।

চতুর্থত, ইসলাম মুসলমানদের পরকালীন জীবনের জন্য প্রস্তুত করে এ পার্থিব জীবনে তাদের সুখ পরিত্যাগ করার বিনিময়ে, এভাবে আখেরাতের প্রতি ইসলামের জোর এবং সর্বজনীন গুরুত্ব মুসলমানদের উদ্যোক্তা চেতনার উন্মেষের বিরুদ্ধে কাজ করে (টেসলার, ২০০২)। বস্তুবাদের সঙ্গে ইসলামের খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে এবং বর্তমান জীবনে বস্তুগত লাভের সঙ্গে ইসলামের প্রান্তিক উদ্বেগ শিথিলতার ফলে কল্যাণ এবং সাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের অসাবধানতা ও অগ্রাহ্যতা ফুটে ওঠে। তদুপরি, সম্পদ সৃষ্টি ও সম্পদ বণ্টনের উপায় নির্ধারণে ইসলাম আরোপিত কঠোর নির্দেশিকাগুলো অবশ্যই মুসলিম দেশগুলোতে উদ্যোক্তা বিকাশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে (পারকিনস, ২০০৩)।

পঞ্চমত, যারা ইসলামী মানদণ্ড ও নীতি-নৈতিকতাভিত্তিক জীবন ধারণ করে তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার মতো ব্যবসায়ের সুযোগ সীমাবদ্ধ। তদুপরি, শারীরিক ধর্মীয় কর্তব্যগুলো যেমন প্রতিদিনের নামাজ, রমজান মাসে রোজা রাখা এবং হজযাত্রার চাহিদা উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে যেহেতু এর মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা খুব কম সময় পেয়ে থাকে তার শিল্পোদ্যোগ অনুশীলনের জন্য (পারকিনস, ২০০৩)।

ষষ্ঠত, ইসলামী শিক্ষার সারবত্তা এবং পদ্ধতি সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনকে সীমাবদ্ধ করে এবং মুক্তমনা নাগরিকদের, যারা তাদের চূড়ান্ত সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ ও সজ্জিত, উত্থানের পথে বাধা সৃষ্টি করে (কোরআন, ১৯৯৭; কামগুয়ান, ২০০০)। অবশেষে, বহু সংখ্যক ইসলামী দেশে সহায়ক সংস্থার দৃশ্যমান অনুপস্থিতির সঙ্গে অদক্ষ ও দ্ব্যর্থক আইনি অবকাঠামো যার ভিত্তি হলো সেকেলে ইসলামিক আইন যেমন উত্তরাধিকার আইন; সম্পত্তির অধিকার এবং চুক্তি সম্পাদন উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে (কোরআন, ২০০৪ বি)।

লেখকঃ এম কবির হাসান: অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সের শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স, লুইজিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।

আরও দেখুন:
অর্থ ব্যবস্থাপনার পাঁচ পরামর্শ
ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ জরুরি
অর্থনৈতিক লেনদেনে ধোঁকা ও প্রতারণা
নিম্ন সুদহার নীতি আর উচ্চ সুদহার ঝুঁকির চক্রে ব্যাংক
বিধ্বংসী পুঁজিবাদের বিকল্প কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button