ইসলামী অর্থনীতি

উন্নয়নে গতি আনবে ইসলামী বন্ড

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে এ বছরই সরকার নতুন একটি শরীয়াহ ভিত্তিক ইসলামী বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আধুনিক ইসলামী বন্ড বা সুকুকের ব্যবহার সর্বসাম্প্রতিক কয়েক দশকে বেশ জনপ্রিয় হলেও এর ইতিহাস আসলে অনেক পুরানো। সপ্তম শতাব্দীতে সিরিয়ার দামেস্ক নগরীতে সুকুকের প্রথম প্রচলন হয়। তবে এটি প্রচলিত, সাধারণ বা ট্রেজারি বন্ড নয়। এটি এমন একটি শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী বন্ড যেটি বিশ্বব্যাপী চালু আছে এবং এ ধরণের বন্ড ‘সুকুক’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত।

তাই অর্থায়নের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সরকার সুকুক ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ২২ ডিসেম্বর ২০২০ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রথম দফায় আট হাজার কোটি টাকার এই ইসলামি বন্ড ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ এর মধ্যেই চালু করতে চায় সরকার। এটাই হবে সরকারের উদ্যোগে চালু হওয়া প্রথম ইসলামী বন্ড। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’-এর সম্পদের বিপরীতে ছাড়া হচ্ছে এই সুকুক। বাংলাদেশ ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুকের সার্টিফিকেট বিক্রি করবে। বিপরীতে তারা মুনাফা পাবে।

মূলত সুকুক আরবি ‘সকক’ শব্দের বহুবচন। আরবি অভিধানে কোনো সিলমোহরযুক্ত দলিলের মাধ্যমে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব অর্পণ করার ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। আবার লিখিত কাগজপত্র, অর্থনৈতিক চুক্তিপত্র, সম্পদের সনদ, নথি ইত্যাদি বোঝানোর ক্ষেত্রেও শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। কোনো সম্পদ ও সেবার মালিকানায় অথবা নির্দিষ্ট প্রকল্পের সম্পদে বা বিশেষ বিনিয়োগের অবিভাজ্য শেয়ারের প্রতিনিধিত্বকারী সমমূল্যের কোনো সার্টিফিকেটকে সুকুক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সুকুক কেনার মাধ্যমে ভূমি, ভবন, কারখানা বা অন্য কোনো সম্পদে বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ওই সম্পদ থেকে অর্জিত মুনাফার অংশ লাভ করা যায়। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী সূদ, ফাটকা ইত্যাদি অবৈধ এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণ। তাই ইসলামী আইনে প্রচলিত পদ্ধতির বন্ড, ঋণপত্র, ডিবেঞ্চার অবৈধ। সুকুক হলো ইসলামী আইনের আলোকে গঠিত প্রচলিত ঋণপত্রের বিকল্প।

মূলত যেকোন বন্ড হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেওয়ার আইনি দলিল। সাধারণ বন্ডের উপরে সুদ হার নির্ধারিত উল্লেখ থাকলেও ইসলামী বন্ড বা সুকুকের ক্ষেত্রে মুনাফার হার প্রাক্কলিত বা পরিবর্তনশীল বিবেচিত হয়। যেকোন কোম্পানির শেয়ারে মালিকানা স্বত্ব নিহিত থাকলেও যেকোন বন্ডে সেটা থাকে না। কারণ বন্ড হচ্ছে এক ধরণের ঋণপত্র বা বিনিয়োগের নিশ্চয়তাপত্র, কোন মালিকানা স্বত্ব নয়। এ কারণে বন্ডধারী কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশ নিতে পারে না এবং ভোটদান ক্ষমতাও থাকে না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সুকুক প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি) সুকুক, মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি) সুকুক, মুরাবাহা (লাভে বিক্রি) সুকুক, ইস্তিসনা (পণ্য তৈরি) সুকুক, সালাম (অগ্রিম ক্রয়) সুকুক, ইজারা (ভাড়া) সুকুক, মুযারা’আ সুকুক, মুসাকাত সুকুক, প্রাইভেট সুকুক, মানবকল্যাণ সুকুক, করজ হাসানা (উত্তম ঋণ) সুকুক। আবার ইস্তিসনা, মুরাবাহা ও ইজারার সমন্বয়ে হাইব্রিড ধরনের কিছু সুকুকের ব্যবহারও বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। যেকোন প্রতিষ্ঠানের তারল্য বাড়ানো, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প সম্প্রসারণ বা কোনো বৃহৎ প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুশারাকা, মুদারাবা, ইস্তিসনা, সালাম ও ইজারা সুকুকের ব্যবহার বেশি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইজারা সুকুকের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে সুকুক চালুর কার্যক্রমে জোর পায় প্রায় এক যুগ আগে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে পুঁজিবাজারে সুকুক ব্যবহারে নীতিমালা তৈরি করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ২০১৯ সালের ২২ মে সরকার ঐ নীতিমালা গ্যাজেট আকারে প্রকাশ করে। নীতিমালা জারির পর পরই ১০০ কোটি টাকার সুকুক ছাড়তে বিএসইসিতে আবেদন জানিয়েছিল শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল। কিন্তু সুকুকের নীতিবিরুদ্ধ উপাদান থাকায় সে আবেদন বিএসইসি অনুমোদন দেয়নি। একইভাবে কয়েকমাস আগে বিএসইসির কাছে বড় অংকের সুকুক বাজারে ছাড়ার মৌখিক প্রস্তাব দিয়েছিল করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসিআই। তবে এখনও এসিআইয়ের ইসলামী বন্ড দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি।

ইসলামিক বন্ড বা সুকুক ব্যবহার করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। দেশ দুটির বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখছে এ ইসলামিক বন্ড। তাছাড়া, অন্তত এক ডজন মুসলিম প্রধান দেশের পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুকুক। মুসলিম বিশ্বের গণ্ডি পেরিয়ে সুকুক ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপ আমেরিকায়। চালু হয়েছে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও। অন্যদিকে এখনো এ বন্ডের ব্যবহারে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। অথচ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক বৃহৎ অর্থনীতির দেশে সুকুক চালু হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসির মতো বহুজাতিক ব্যাংকও যুক্ত হয়েছে সুকুকের সঙ্গে।

মালয়েশিয়া বিশ্বের মোট সুকুকের ৬৭ ভাগের ইস্যুকারী হিসেবে নেতৃত্বের স্থানে রয়েছে। দেশটির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ১৯৯০ সালে প্রথম স্থানীয় মুদ্রায় ১২৫ মিলিয়ন মূল্যের ইজারা সুকুক ইস্যু করে। এরপর দেশটিতে ২০০২ সালে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বৈশ্বিক সুকুক বাজারে ছাড়া হয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকায় মালয়েশিয়ায় সুকুকের বাজার ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে।

ইসলামী বন্ড সুকুক চালু হলে সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উৎস তৈরি হবে। সাধারণত বাজেটের খরচ মেটাতে প্রতিবছর রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও ব্যাংক ঋণের ওপর ভরসা করে আসছিল। তবে সরকার সর্বশেষ ২০১৯–২০ অর্থবছরে সরকারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত তহবিল থেকেও ১৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল।

সাধারণত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো দীর্ঘ মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎস হিসেবে সুকুক ইস্যু করা হয়। যেমন, ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। প্রকল্প মালিক কিংবা কোনো সংস্থা এ প্রকল্পে অর্থসংস্থানের জন্য সমপরিমাণ অর্থের সুকুক ইস্যু করতে পারে। বিনিয়োগে আগ্রহী যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের সুকুক কিনে প্রকল্পের ঘোষিত অংশ বা অংশবিশেষের মালিক হতে পারেন। প্রকল্পটির আয় থেকে সুকুকহোল্ডারগণ তাদের মালিকানার আনুপাতিক হারে মুনাফা পাবে।

সুকুক চালুর পক্ষে যুক্তি দিয়ে সরকার বলছে, অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এখন পর্যন্ত তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। এর ফলে ব্যক্তিগত খাতের বিনিয়োগ সংকোচিত হয় এবং অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত এর সমালোচনা করে থাকে অথচ এ প্রক্রিয়ায় ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শরিক হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা সহজেই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে।

পরিসংখ্যান বলছে, সুকুকের বৈশ্বিক বাজার এখন প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বহুজাতিক অ্যাকাউন্টিং ফার্ম আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াংয়ের পূর্বাভাস বলছে, আগামী পাঁচ বছরে সুকুকের বৈশ্বিক চাহিদা ৯০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। বৈশ্বিক চাহিদার এ ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে বাংলাদেশেও। দেশে সুকুক নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর হলে পাঁচ বছরের মধ্যে এর বাজার ব্যাপ্তি দাঁড়াবে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকায়।

দেশে ইসলামী ব্যাংকিং সেবার জনপ্রিয়তা ও পরিধি বাড়লেও এখাতের সেবায় বৈচিত্র্য বাড়ছে না। অনেক অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস মুদ্রাবাজারে সুকুকের কার্যক্রম শুরু হলে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এবং তাদের অতিরিক্ত তারল্যের সুষম বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরী হবে। ইসলামী ব্যাংকগুলো এসএলআর সংরক্ষণের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকা অতিরিক্ত অর্থ থেকে ২ শতাংশের বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। আবার সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার সুনির্দিষ্ট হওয়ায় এ খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। ফলে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মতে, সুকুক পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বহু আগে থেকেই সুকুক প্রবর্তনের দাবি জানানো হচ্ছিল। এটি কার্যকর হলে ব্যাংক, গ্রাহক ও সরকার সবাই উপকৃত হবে। সুকুক প্রবর্তন হলে সরকার চাইলেই তারা মেগা প্রকল্পের জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ নিতে পারবে।

তবে অতিরিক্ত তারল্য ব্যাবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী শরিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এমন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদী বাংলাদেশ সরকার ইসলামী বিনিয়োগ বন্ডের (ইসলামী বন্ড) ব্যবহার করে আসছে।

সরকারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, পুরো ব্যাংকব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনো উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে, অন্যদিকে সরকার তার ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। অর্থ বিভাগের মতে, ঘাটতি অর্থায়ন সুকুকের মাধ্যমে করা হলে সরকারের সুদের ব্যয়ও কমবে, বাড়বে ব্যক্তি বা ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব। মজবুত হবে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি ও চাকা। তৈরি হবে একটি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ খাতের।

মোঃ জিল্লুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button