ইসলামী অর্থনীতি

আর্থিক লেনদেন বা মুয়ামালাত কি? মুয়ামালাতের উদ্দেশ্য

ড. ইকবাল কবীর মোহনঃ সাম্প্রতিক কালে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে আর্থিক লেনদেন বা মুয়ামালাত বিষয়টি বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে।

মুয়ামালাত কি?
‘মুয়ামালাত’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ লেনদেন। এর ব্যাবহারিক অর্থ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে যেকোনো ধরনের লেনদেনকেই মুয়ামালাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য ভাষায় পণ্যসামগ্রী বিনিময় বা যেকোনো ধরনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়, বিক্রয়, সমন্বয়, উপহার ও অনুদান ইত্যাদি বিষয়ে লেনদেনকে মুয়ামালাত বলে। মুয়ামালাতের মূল বিষয় বুঝতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল পবিত্র, পরিচ্ছন্ন এবং সংরক্ষিত। তাঁর সুযোগ্য সাহাবিরা নবীজির প্রত্যেকটি কথা, কাজ ও নির্দেশনাকে সংরক্ষণ করেছেন।

আরও দেখুন:
ইসলামী বন্ড সুকুক কী ও কেন

মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম ছিল খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা। মহানবী (সা.)-এর ব্যবসায় লেনদেন নির্ভেজাল ব্যবসার অন্যতম দৃষ্টান্ত। ব্যবহারকারীর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বদা স্বচ্ছতা এবং তাঁর পরিপূর্ণ সততা তাঁকে ইসলামপূর্ব যুগে আল আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

মুয়ামালাতের উদ্দেশ্য
মুয়ামালাতের মুখ্য উদ্দেশ্যগুলো হলো: বিশ্বাস ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে মানবজাতির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ইসলামী আইন সব সময় মানুষের মনন ও কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনয়নে গুরুত্বারোপ করে থাকে। মুয়ামালাত এ ক্ষেত্রে মানবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে ভূমিকা পালন করে। মুয়ামালাত যেকোনো বিনিময় কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সততা, ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্ববোধের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। প্রাত্যহিক লেনদেনসহ শরিয়াহ যেকোনো বিষয়ে সীমা লঙ্ঘনকে মহান আল্লাহ অপছন্দ করেন। আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৯০)

মুয়ামালাত মানুষকে ব্যাবসায়িক লেনদেনে উৎসাহিত করে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সহায়তা করে। মহানবী (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘জীবিকার ১০ ভাগের মধ্যে ৯ ভাগই রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে।’ (ইমাম গাজ্জালি, এহইয়াউ উলুমিদ্দিন)

লেনদেনে কিছু মৌলিক নির্দেশনা
লেনদেনের ক্ষেত্রে পক্ষদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি এড়াতে মুয়ামালার মূলনীতি কিছু মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করে। পক্ষরা যদি লেনদেনের ক্ষেত্রে এগুলো অনুধাবন করে তাহলে তারা যেকোনো ধরনের অপরাধ, অসততা ও জালিয়াতি প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যতবার তারা যুদ্ধের আগুন জ্বালায়, ততবার আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন এবং তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়; আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা: মায়েদা, আয়াত: ৬৪)

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠা বজায় রাখার ব্যাপারে ইমাম আল রাজি বলেন, ‘ভারসাম্য ও ওজনের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করো, মালামাল বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সত্য বলো এবং কোনো কিছু গোপন করবে না।’ তাঁর এ কথা কোরআনি আদেশের অনুবর্তী। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে— ‘মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম ও পরিণামে উত্কৃষ্ট।’ (সুরা: ইসরা, আয়াত: ৩৫)

লেনদেনের ক্ষেত্রে বেআইনি পথ পরিহার করে বৈধতার ধারা বজায় রাখতে হবে। লেনদেন চুক্তিতে চুক্তির কোনো শর্ত বা বিধান ভঙ্গ করার পরিণতি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের উল্লেখ থাকতে হবে। মুয়ামালাতের বিধান মোতাবেক যেকোনো লেনদেনের পক্ষগুলোর ওপর চুক্তি পূর্ণ করা বাধ্যতামূলক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে।’ (সুরা: মায়েদা, আয়াত: ১)

যেকোনো পক্ষ লেনদেনের কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা পক্ষকে শর্ত ভঙ্গের পরিণতি ভোগ করতে হবে। শাস্তি হিসেবে তা হতে পারে কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্পাদন, কোনো ক্ষতি স্বীকার, কোনো সুবিধা বা অধিকারের মেয়াদ স্থগিতকরণ অথবা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণ প্রদান।

মুয়ামালাতের বিধান সম্পৃক্ত পক্ষদের অধিকার ও দায়িত্ব নিরূপণ ও কার্যকর করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। একটি চুক্তিভিত্তিক লেনদেনে এক পক্ষের দায়িত্ব মূল্য পরিশোধ করা এবং অন্য পক্ষের দায়িত্ব পণ্য বা মালামালের মালিকানা হস্তান্তর করা। এভাবে চুক্তিভুক্ত পক্ষরা নির্ধারিত শর্তাবলি পালন করতে বাধ্য থাকে। মুয়ামালাতে উভয় পক্ষ এভাবে দায়বদ্ধ থাকে যেকোনো পক্ষ চুক্তিতে বর্ণিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে যেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ঐশী বিধানের সব দিক মেনে যেকোনো লেনদেন চুক্তি সম্পাদনে শরিয়াহ সবার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে। চুক্তিভুক্ত পক্ষের মধ্যে এ ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কেননা আল্লাহ চান না মানুষ কোনো অসুবিধায় পড়ুক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা-ই চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টদায়ক তা চান না।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

পক্ষদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা লালন করা লেনদেন চুক্তির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। কেননা, পারস্পরিক উপকারের স্বার্থেই মানুষ লেনদেন করে। আর এ থেকেই লেনদেনে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের জাগৃতি ঘটে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না; অবশ্য তোমরা মিলেমিশে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করতে পারো। আর তোমরা একে অপরকে হত্যা কোরো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান।’ (সুরা: নিসা, আয়াত: ২৯)

মুয়ামালাতের গুরুত্ব
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একজনকে অপরের ওপর নির্ভরশীল করে। এটা সত্য যে, কোনো মানুষের পক্ষে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু অর্জন সম্ভব নয়। একজনের যা রয়েছে, সে তা অন্যের জন্য ছেড়ে দিতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে তারও এমন জিনিসের প্রয়োজন হতে পারে, যা পেতে তাকে তা ক্রয় করতে হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষকে পণ্যসামগ্রী ও সেবা পরস্পরের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বিনিময় করাকে উৎসাহিত করেছেন। এটা এ জন্য যে, এ ধরনের লেনদেন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং মানুষকে উৎপাদনশীল কাজে উৎসাহিত করে।

আরবদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লেনদেন ও বিনিময়ের প্রচলন ছিল। মহানবী (সা.) এসব লেনদেনের যেগুলো শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় সেগুলো অনুমোদন ও নিশ্চিত করেছেন। আর যেগুলো আংশিক বা পুরোপুরি শরিয়ার বিপরীত সে ধরনের চুক্তি নিষিদ্ধ করেছেন। এসব নিষিদ্ধ হওয়ার কতগুলো নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেআইনি খাদ্যের ব্যবসা, প্রতারণানির্ভর লেনদেন, আত্মসাৎ বা অতিরিক্ত লাভ কিংবা চুক্তির যেকোনো পক্ষের প্রতি অবিচার ইত্যাদি।

মুয়ামালাতে যা নিষিদ্ধ
মুয়ামালাতের মধ্যে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো হলো: কোনো নিষিদ্ধ পণ্য যেমন—মদ, শূকরের গোশত বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ পদার্থ ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি করা যাবে না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের আমি যে পবিত্র বস্তু দিয়েছি, তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, আর তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করো।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৭২) এ আয়াত এটাই নির্দেশ করে যে কোনো নিষিদ্ধ বস্তু বা মালামাল গ্রহণের অধিকার মানুষের নেই।

সুদভিত্তিক চুক্তি নিষিদ্ধ
ইসলামে সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৭৫)

জুয়াসংশ্লিষ্ট চুক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, উভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ এবং কিছুটা উপকার; কিন্তু এর উপকারের চাইতে গুনাহ বেশি।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২১৯)

যেসব চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা বা ধোঁকার অস্তিত্ব আছে, তা নিষিদ্ধ এবং বড় ধরনের ধোঁকা বা অনিশ্চয়তা (গারার) সম্পৃক্ত চুক্তি ত্রুটিপূর্ণ এবং বাতিল বলে গণ্য। যেসব বস্তুর কোনো ব্যবহার নেই বা মূল্য নেই তা উৎপাদন বা বিক্রয় করাও ইসলামে নিষিদ্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button