ব্যাংক গ্রাহকব্যাংকিং

আমানতকারীর অবর্তমানে ব্যাংক হিসাবের অর্থ উত্তোলনে করণীয়

আমার শ্বশুর স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মারা গেছেন প্রায় দেড় বছর আগে। একমাত্র মেয়ের ব্যাংকার জামাতা হিসেবে আমার ওপর পড়ল তার তিনটি ভিন্ন ব্যাংক হিসাবের অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব। ব্যাংকার হওয়ায় এ-সংক্রান্ত নিয়ম আমি জানি। প্রথমেই জানতে হবে হিসাবগুলোর নমিনি কে বা কারা? নমিনি মনোনীত করা থাকলে হিসাবের অর্থ উত্তোলন করাটা যতটা সহজ, মনোনীত করা না থাকলে ততটা সহজ নয়। কিন্তু আমার শ্বশুরের পরিবারের কোনো সদস্যই জানেন না, কাকে জীবদ্দশায় ব্যাংক হিসাবের নমিনি মনোনীত করে গেছেন তিনি। ব্যাংক শাখাগুলোর ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম দুটি হিসাবের নমিনি হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে শ্বশুরের মেয়ে (আমার স্ত্রী) ও তার স্ত্রী (আমার শাশুড়ি)। ফলে ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী খুব সহজেই নমিনিরা আমার শ্বশুরের দুই ব্যাংক হিসাবে রেখে যাওয়া স্থিতি উত্তোলন করতে পারলেন।

তৃতীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপক কর্মী দিয়ে আমার শ্বশুরের হিসাব ফরমটি বের করে জানালেন তাতে নমিনি মনোনীত করা নেই। ওই সময় নমিনি মনোনয়ন ছাড়াও ব্যাংক হিসাব খোলা যেত। নিজে ব্যাংকার হওয়ায় আমি যদিও এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের করণীয় কী, তা জানি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি যেহেতু আমার ব্যাংক নয়, তাই ব্যবস্থাপকের কাছে অর্থ উত্তোলনে আমাদের করণীয় কী এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা জানতে চাইলাম। তিনি কয়েক দফা করণীয় বলার পাশাপাশি সংযুক্তি হিসেবে ‘আদালত প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ’ চাইলেন, যা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য। অথচ ওই ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী এ ক্ষেত্রে আদালত প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ’ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল না।

ব্যবস্থাপকের কাছে যাওয়ার আগেই আমি ওই ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে মৃত ব্যক্তির নমিনিবিহীন হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের নিয়ম-বিষয়ক সার্কুলার দেখলাম। সেটির ভাষ্যমতে আমার শ্বশুরের হিসাবে যে পরিমাণ স্থিতি আছে, তা উত্তোলনে ওয়ারিশ সনদ লাগবে, তবে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রদত্ত হলেও চলবে। সার্কুলার মতে, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দেওয়া সনদই যথেষ্ট। আমার শ্বশুরের ওই হিসাবটিতে এক লাখ টাকারও কম স্থিতি ছিল। তাই ব্যবস্থাপককে তারই ব্যাংকের সার্কুলারের রেফারেন্স দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ নিয়ে টাকা প্রদানের অনুরোধ করলাম, কিন্তু তিনি আদালত প্রদত্ত ওয়ারিশ সনদ দাখিল করে টাকা নিতে আসতে বললেন!

ব্যবস্থাপকের এমন মনোভাবে যতটা না অসহায় বোধ করেছি, তার চেয়ে বেশি লজ্জিত হয়েছি তার সেবার আয়নায় আমার নিজের ব্যাংকার চেহারাটা দেখতে পেয়ে। ছোট হয়ে গেলাম শ্বশুরালয়ের স্বজনদের কাছে আমি নিজে ব্যাংকার হয়েও তাদের সাধারণ সমস্যার সমাধান করতে পারলাম না!

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এটি ঠিক, ব্যবস্থাপক তার সন্তুষ্টির স্বার্থে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাইতেই পারেন। তবে চাহিদার বাহুল্য যদি ‘মশা মারতে কামান দাগা’র মতো হয়, অথবা সেবাপ্রত্যাশী ওয়ারিশের পরিচয় ও সত্যতা যাচাইয়ে নিরঙ্কুশ কাগজপত্র এবং শনাক্তকারী হিসেবে স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের (আমার মরহুম শ্বশুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু) নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সার্কুলারের বাইরে কাগজপত্র দাবি করাটা শুধু হয়রানিই নয়, কিছুটা অপরাধও বোধ হয়। কারণ মৃত ব্যক্তির স্বজনরা মৃতের ব্যাংক-ব্যালান্স নিয়ে উল্লাস করতে নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হঠাৎ থমকে যাওয়া পরিবার নামক চালকশূন্য রেলগাড়িটার গতি ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় রসদের জোগান দিতে এবং পারিবারিক বিভিন্ন দায় মিটাতেই সেই অর্থ উত্তোলন করতে চান। তাই এক্ষেত্রে আইনি ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ব্যাংকারের কাছ থেকে মানবিক ব্যাংকিংও কাম্য।

ব্যাংকারদের ক্ষেত্রে অতিপালনীয় হলো ‘ব্যাংকারস ডিল উইথ ডকুমেন্টস’। আর এক্ষেত্রে মৃত গ্রাহকের নমিনি/ওয়ারিশদের অর্থ প্রদানে ব্যাংকার ডকুমেন্টের (কাগজপত্র/দলিলাদি) ওপর ভিত্তি করেই কাজ করবেন। প্রথমত, হিসাবধারীর মারা যাওয়ার সপক্ষের দলিল, অর্থাৎ মৃত্যু সনদপত্র; দ্বিতীয়ত, নমিনি বা ওয়ারিশদের মনোনয়ন/উত্তরাধিকার ও পরিচিতির সপক্ষের দলিলপত্র, যেমন ওয়রিশ সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আরও কিছু প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র গ্রহণ করে ব্যাংকারকে তার গ্রাহকের মৃত্যু এবং নমিনি/ওয়ারিশদের মনোনয়ন/উত্তরাধিকার ও পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই নমিনি/ওয়ারিশকে মৃত গ্রাহকের হিসাবের স্থিতি গ্রহণ করতে দিতে হবে।

তবে নমিনি/ওয়ারিশদের কাছ থেকে যাচিত কাগজপত্রের তালিকা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে, অথবা কাগজপত্রের চাহিদায় ব্যাংকারের বাড়াবাড়ি কিংবা ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে এবং সর্বোপরি কোনো কোনো ব্যাংকারের অসহযোগিতার কারণেও ভোগান্তিতে পড়েন মৃতের স্বজনরা। ব্যাংকার হওয়া সত্ত্বেও নিজের মৃত শ্বশুরের ব্যাংক হিসাবের অর্থ উত্তোলনে আমাকে এবং আমার শ্বশুরের ওয়ারিশদের অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা যেন আমাদের সম্মানিত গ্রাহকদের বা তাদের মনোনীত নমিনি/ওয়ারিশদের না হয়, তাই তাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার প্রয়োজন ছাড়াও দায়িত্ব অনুভব করছি।

‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’ অনুসারে যদি কোনো ব্যাংক হিসাবে নমিনি মনোনীত করা থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের মৃত্যুর পর তার হিসাব থেকে সমুদয় অর্থ উত্তোলনের অধিকার রাখেন একমাত্র নমিনি/নমিনিরা; আর নমিনি মনোনীত করা না থাকলে অর্থ উত্তোলনের অধিকার রাখেন মৃত হিসাবধারীর বৈধ ওয়ারিশ/ওয়ারিশরা। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের সমসাময়িক সার্কুলারে একই নির্দেশনারই পুনরাবৃত্তি করেছে। তবে অর্থ উত্তোলন পদ্ধতি এবং নমিনি বা ওয়ারিশদের কাছ থেকে গৃহীতব্য কাগজপত্রাদির কোনো তালিকা বাতলে না দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালা ও সার্কুলারের আলোকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি আদায় করে থাকে। তাই ব্যাংকভেদে কাগজপত্রের চাহিদায় কিছুটা ভিন্নতাও দেখা যায়। শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সার্কুলার এবং প্র্যাকটিসের আলোকে নমিনি/ওয়ারিশদের কাছ থেকে ব্যাংক সাধারণত যে কাগজপত্র গ্রহণ করে থাকে, তার একটি তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।

নমিনি মনোনীত থাকলে
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত) ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক কোম্পানির কাছে রক্ষিত কোনো আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহলে ওই একক আমানতকারী এককভাবে বা ক্ষেত্রমতে যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে নির্ধারিত পদ্ধতিতে এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারবেন, যাকে বা যাদেরকে একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর আমানতের অর্থ দেওয়া যেতে পারে। তবে আমানতকারী চাইলে যেকোনো সময় নমিনি পরিবর্তন করতে পারবে।’ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৬ এবং ২০১৭ সালের ১২ জুন ডিএফআইএম সার্কুলার নং-০২-এর মাধ্যমে বিষয়টি আবার স্পষ্ট করেছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনি বা নমিনিগণকে আমানতের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তাই আমানতকারীর মৃত্যুর পর অর্থের মালিকানা নিয়ে সুরাহা হলেও অর্থ উত্তোলনের সঠিক পদ্ধতি না জানা ও মনোনয়নের সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে না পারার কারণে অর্থ উত্তোলনে নমিনিকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এই বিড়ম্বনা লাঘবে নমিনি ও ব্যাংকার উভয়ের করণীয়র পাশাপাশি নমিনির কাছ থেকে গৃহীতব্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা নিচে উল্লেখ করা হলো:

এক. হিসাবধারী গ্রাহকের মৃত্যু, নিজের নমিনেশন (মনোনয়ন) উল্লেখপূর্বক অর্থ উত্তোলনের জন্য নমিনির আবেদন;
দুই. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কমিশনার)/প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকারি ডাক্তার/রেজিস্টার্ড ডাক্তার/সিভিল সার্জন কর্তৃক প্রদত্ত হিসাবধারী আমানতকারীর মৃত্যু সনদপত্র (ডেথ সার্টিফিকেট);
তিন. প্রবাসে মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক স্বাক্ষরিত মৃত্যু সনদপত্র;
চার. নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা জন্ম নিবন্ধন সনদ (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত)। জন্ম নিবন্ধন সনদ দাখিল করলে সঙ্গে ছবিযুক্ত অন্য যেকোনো গ্রহণযোগ্য আইডিও (যেমন স্কুল/কলেজের রেজিস্ট্রেশন সনদ) জমা দিতে হবে;
পাঁচ. নমিনির মনোনয়ন ও পরিচিতির সপক্ষে ব্যাংকের দুই সম্মানিত গ্রাহক অথবা ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা অথবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রদত্ত শনাক্তকরণ সনদপত্র;
ছয়. নমিনির নিজ নামের স্বাক্ষরযুক্ত সদ্যতোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত);
সাত. ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য দুই সাক্ষীর (সাধারণত ব্যাংক গ্রাহক) স্বাক্ষরসহ উপযুক্ত মূল্যের নন-জুডিশিয়াল/অ্যাডেসিভ স্ট্যাম্পে নমিনি কর্তৃক ইনডেমনিটি বন্ড প্রদান;
আট. মৃত গ্রাহকের হিসাবের অব্যবহƒত চেকবই, ডেবিট কার্ড (সঞ্চয়ী হিসাবের) বা আমানত রসিদ (এফডিআর, স্কিম প্রভৃতি হিসাবের ক্ষেত্রে) ফেরত প্রদান;
নয়. মৃত গ্রাহকের হিসাবে স্থিত অর্থের পরিমাণ ম্যানেজারের বিজনেস ডেলিগেশনের ঊর্ধ্বে হলে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন;
দশ. নমিনিকে অর্থ প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট শাখায় মৃত আমানতকারীর কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঋণ নেই বলে ব্যাংকারকে নিশ্চিত হতে হবে;
এগারো. অধিকতর স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে নমিনির ব্যাংক হিসাব। মৃত ব্যক্তির হিসাবের স্থিতি নমিনির নামে ‘অ্যাকাউন্ট পেইয়ি’ পে-অর্ডারের মাধ্যমে প্রদান করা হবে, যা পরে নমিনির ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কালেকশন হবে।

নমিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকাবস্থায় যদি হিসাবধারী গ্রাহক মৃত্যুবরণ করে থাকেন এবং নাবালক নমিনির পক্ষে হিসাবধারী গ্রাহক কর্তৃক হিসাব খোলাকালে অথবা হিসাবধারীর জীবদ্দশায় ইতোমধ্যে কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করা থাকে, তাহলে মনোনীত ব্যক্তি অর্থ উত্তোলনের জন্য যোগ্য হবেন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক নমিনির পক্ষে কোনো ব্যক্তি মনোনীত করা না থাকলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মাননীয় আদালত) কর্তৃক নির্ধারিত স্বাভাবিক/আইনগত অভিভাবক অর্থ উত্তোলনের জন্য যোগ্য হবেন। এভাবে নির্ধারিত স্বাভাবিক/আইনগত অভিভাবককে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি/ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ‘ন্যাচারাল/লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট’ গ্রহণ করতে হবে।

উল্লেখ্য, গ্রাহকের মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পরক্ষণেই ব্যাংকারকে মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির সময় ও উৎস রেকর্ডকরণসহ মৃত গ্রাহকের হিসাবকে ‘ডিসিজড অ্যাকাউন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং এই হিসাবের কোনো চেক পরিশোধ করা যাবে না, এমনকি উপস্থাপিত চেক গ্রাহকের মৃত্যুর আগে ইস্যুকৃত হলেও।

একক নামে পরিচালিত হিসাবে বিশেষ নির্দেশে যদি নমিনি হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করা হয়, তবে ওই ব্যক্তি হিসাবটি পরিচালনাকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট হিসাবে গচ্ছিত অর্থ যথারীতি শনাক্তকরণ সাপেক্ষে নিয়মানুযায়ী উত্তোলন করতে পারবে। তবে টাকা উত্তোলনের সাথে সাথে হিসাবটি বন্ধ হয়ে যাবে। নমিনি হিসাব পরিচালনা করতে চাইলে তাকে নিয়মানুযায়ী নতুন হিসাব খুলতে হবে।

যৌথ হিসাবের ক্ষেত্রে যদি একজনের মৃত্যু হয় এবং হিসাবটি যদি যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালনার নির্দেশ থাকে, অথবা বিশেষ নির্দেশনায় বলা থাকে যে, ‘যেকোনো একজন হিসাব পরিচালনা করতে পারবেন (এনি ওয়ান ক্যান অপারেট দ্য অ্যাকাউন্ট),’ তবে যেকোনো একজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসাবটিতে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ওয়ারিশান সনদের মাধ্যমে ওই হিসাবে গচ্ছিত অর্থ জীবিত ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের সঙ্গে যৌথভাবে আবেদন করা সাপেক্ষে উত্তোলন করতে পারবে।

যৌথ হিসাবের ক্ষেত্রে যদি একজনের মৃত্যু হয় এবং হিসাবটির বিশেষ নির্দেশনায় উল্লেখ থাকে যে, ‘যেকোনো একজন বা জীবিত ব্যক্তি (আইদার অর সারভাইভর ক্যান অপারেট দি অ্যাকাউন্ট) হিসাবটি পরিচালনা করতে পারবেন। তাহলে জীবিত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট হিসাবটি পরিচালনা করতে সুযোগ পাবেন এবং জীবিত ব্যক্তি ইচ্ছা করলে ওই হিসাবে গচ্ছিত অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন।

আরও দেখুন:
ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির আমানত কে পাবে?
ব্যাংক গ্রাহকের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ও নমিনী কর্তৃক টাকা উত্তোলনের নিয়ম
মৃত ব্যক্তির হিসাবে গচ্ছিত টাকা কে পাবে নমিনী নাকি ওয়ারিশ?

নমিনি মনোনীত না থাকলে
এক. টাকা উত্তোলনের জন্য ওয়ারিশ/ওয়ারিশদের একক বা যৌথ আবেদনপত্র (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক প্রতিস্বাক্ষরিত);
দুই. হিসাবধারী আমানতকারীর মৃত্যুর সনদপত্র;
তিন. মৃত আমানতকারী ব্যক্তির উত্তরাধিকার/ওয়ারিশ সনদপত্র;
চার. ওয়ারিশদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা জন্ম নিবন্ধনের কপি (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত);
পাঁচ. ওয়ারিশদের নিজ নিজ নামের স্বাক্ষরযুক্ত সদ্যতোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত);
ছয়. মৃত গ্রাহকের হিসাবের অব্যবহƒত চেকবই, ডেবিট কার্ড (সঞ্চয়ী হিসাবের) বা আমানত রশিদ (এফডিআর, স্কিম ইত্যাদি হিসাবের ক্ষেত্রে) ফেরত প্রদান;

সাত. ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য দুই সাক্ষীর (সাধারণত ব্যাংকগ্রাহক) স্বাক্ষরসহ উপযুক্ত মূল্যের নন-জুডিশিয়াল/অ্যাডেসিভ স্ট্যাম্পে ওয়ারিশদের ইনডেমনিটি বন্ড সম্পাদন করতে হবে। তবে একাধিক ওয়ারিশ হলে প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রাপ্য অংশ আলাদাভাবে গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক প্রত্যেকের কাছ থেকে পৃথক ইনডেমনিটি বন্ড গ্রহণ করবে। একাধিক ওয়ারিশ (সাবালক/নাবালক) হলে সব ওয়ারিশের পক্ষে একজন সাবালক ওয়ারিশ স্থিতি গ্রহণ করতে পারবেন। তবে নাবালক ওয়ারিশের অর্থ গ্রহণের জন্য অর্থগ্রহণকারী ওয়ারিশকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি/ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ‘অথারাইজেশন সার্টিফিকেট’ এবং সাবালক ওয়ারিশদের অর্থ গ্রহণের জন্য অর্থ গ্রহণকারী ওয়ারিশকে অন্যান্য সাবালক ওয়ারিশ কর্তৃক প্রদত্ত ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ ব্যাংকে জমা করতে হবে। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারি পাবলিকের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রদানের বিষয়ে ওয়ারিশরা হলফনামা সম্পাদন করবেন। এক্ষেত্রে স্থিতি গ্রহণে যাকে ক্ষমতার্পণ করা হয়েছে, ব্যাংক শুধু তার ইনডেমনিটি বন্ড গ্রহণ করবে। যদি সব ওয়ারিশই নাবালক হয়, অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী বা অপ্রকৃতিস্থ হয়, তাহলে তাদের স্বাভাবিক অভিভাবক (ন্যাচারাল গার্ডিয়ান) স্থানীয় জনপ্রতিনিধি/আদালত প্রদত্ত ‘ন্যাচারাল গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট’ প্রদান ও ইনডেমনিটি বন্ড সম্পাদন সাপেক্ষে স্থিতি গ্রহণ করতে পারবেন। ন্যাচারাল গার্ডিয়ান কেউ না থাকলে আদালত বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মনোনীত আইনগত অভিভাবক (লিগ্যাল গার্ডিয়ান) ‘লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট’ দাখিল করা সাপেক্ষে স্থিতি গ্রহণ করতে পারবেন;

আট. ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন গ্রাহকের গ্যারান্টি (ইনডেমনিটি) বন্ড;
নয়. ‘ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় বা অন্য কোনো শাখায় মৃত গ্রাহকের নামে কোনো ঋণ নেই, অথবা ঋণ থাকলে তা পরিশোধে ওয়ারিশরা বাধ্য থাকবেন’ মর্মে ওয়ারিশদের কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্যের স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারপত্র;
দশ. অর্থ গ্রহণকারী ওয়ারিশের ব্যাংক হিসাব;
এগারো. ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবীর মতামত (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে);
বারো. ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের/ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে);
তেরো. বিশেষ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা আদালত যদি মৃত ব্যক্তির পক্ষে কাউকে অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটর নিয়োগ করে থাকেন, তাহলে ‘লেটার অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গ্রহণ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটর উল্লিখিত কাগজপত্র সম্পাদন করবেন ও স্থিতি গ্রহণ করবেন।

ব্যাংকভেদে কাগজপত্রের চাহিদায় কিছুটা হেরফের হতে পারে। তবে আশা করা যায়, উল্লিখিত কাগজপত্রের অতিরিক্ত চাহিদা কোনো ব্যাংকেরই থাকার কথা নয়।

লেখকঃ মোশারফ হোসেন
প্রিন্সিপাল অফিসার ও ব্যবস্থাপক
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড
পাকুন্দিয়া শাখা, কিশোরগঞ্জ

একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button